
সাফ ফুটবলের শিরোপা জয়ী বাংলাদেশের মেয়েরা। ছবি: সংগৃহীত
সালাউদ্দিনের ‘ভিশন ২০২২’
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ২০১৩ সালে ঘোষণা করেছিলেন ‘ভিশন ২০২২’। বলেছিলেন, কাতার বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলবেই খেলবে! কিন্তু তার ঘোষণা স্রেফ ফাঁকা আওয়াজ হিসেবেই রয়ে গেছে।
‘ভিশন ২০২২’ ঘোষণার পর থেকেই যেন বাংলাদেশের ফুটবলে অভিশপ্ত সময় শুরু হয়। ২০২২ সালের শুরুতে বাংলাদেশ শুরু করেছিল ১৮৬তম স্থানে থেকে। বছরের শেষে যা ফের ঠেকেছে ১৯২তম স্থানে। র্যাংকিং অবনতি বলে দিচ্ছে, ২০২২ সাল বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য ছিল ব্যর্থতার বছর।
বছরের শুরুতেই বাংলাদেশের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় স্পেনের হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরাকে। বার্সেলোনা ও ডেপোর্টিভো আলাভেসের হয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ক্যাবরেরার অধীনেও সাফল্য আসেনি। বরং স্প্যানিশ কোচের অধীনে আটটি ম্যাচ খেলে পাঁচটি হেরেছে বাংলাদেশ। যার শুরুটা হয়েছিল মার্চে মালদ্বীপের কাছে ০-২ গোলে হেরে। আর শেষ হয়েছে নেপালের কাছে ১-৩ গোলের পরাজয়ে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ একটি মাত্র জয় পেয়েছে কম্বোডিয়ার বিপক্ষে ১-০ গোলে। জুনে বাংলাদেশ অংশ নেয় এএফসি ২০২৩ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে। ‘ই’ গ্রুপে বাংলাদেশ তিনটি ম্যাচেই হেরে যায় বাহরাইন, তুর্কেমেনিস্তান আর মালয়েশিয়ার কাছে। সব মিলিয়ে ২০২২ সাল বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য ছিল হতাশার বছর।
এতক্ষণ পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছে বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবল নিয়ে। যেখানে সাফল্য এখন সোনার হরিণ। বিপরীতে মেয়েদের ফুটবল পেয়েছে অভাবিত সাফল্য। সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতে পুরো দেশকে উৎসবে ভাসিয়েছে সাবিনা খাতুনরা। অথচ নারীদের সাফ ফুটবলে পূর্ববর্তী পাঁচ আসরে ছিল ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য। কিন্তু এবার ভারতকে গ্রুপ পর্বে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করে বাংলাদেশের মেয়েরা। আর ফাইনালে হারিয়েছে স্বাগতিক নেপালকে।
অধিনায়ক সাবিনা খাতুন তো এখন বাংলাদেশের লিওনেল মেসি। টুর্নামেন্টের পাঁচ ম্যাচে দুই হ্যাটট্রিকসহ আট গোল করে তিনি আসরের সেরা খেলোয়াড় আর সেরা গোলদাতা। এ ছাড়া বাংলাদেশের হয়ে ৪৬ ম্যাচে ৩১ গোল করে তিনি সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক গোলের মালিক। তবে দেশের নারী ফুটবল এখনো পেশাদার রূপ পায়নি। বলতে গেলে, এখনো শৈশবের হাঁটা শেখার মধ্যেই আছে মেয়েদের পেশাদার লিগ। এর মধ্যেই উঠে এসেছেন সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া মান্ডা, সিরাত জাহান, শামসুন্নাহারের মতো ফুটবলার। আর্থ-সামাজিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে যাদের ফুটবলার হয়ে বেড়ে ওঠা। তাই এই মেয়েদের সাফ ফুটবলে শিরোপা জয় অবশ্যই বিশেষ কিছু।
নারীদের ফুটবলে বাংলাদেশের বর্তমান ফিফা র্যাংকিং ১৪৭। সাম্প্রতিক সময়ে র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়া, ভারত আর নেপালকে হারিয়েছে মেয়েরা। কোচ গোলাম রাব্বানি ছোটন আর পল স্মলির তত্ত্বাবধানে মেয়েরা এশিয়ান লেভেলে খেলার টার্গেট করতে পারে। যদিও এশিয়া অঞ্চলে নারী বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা চীন ছাড়াও জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম শক্তিশালী দল। তবে নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে এশিয়ান লেভেলে না হলেও কাছাকাছি যাওয়ার সামর্থ্য মেয়েদের রয়েছে নিঃসন্দেহে।
বিশ্বকাপ উন্মাদনা
২০২২ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলের সব উত্তেজনা ছিল বিশ্বকাপকে ঘিরে। ৩২ দল নিয়ে কাতারে আয়োজিত বিশ্বকাপে বাজিমাত করেছে আর্জেন্টিনা। যা তাদের ইতিহাসে তৃতীয় আর ১৯৮৬ সালের পর প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি। লিওনেল মেসি আসরের সেরা খেলোয়াড় আর ফাইনালে হ্যাটট্রিকসহ আট গোল করা কিলিয়ান এমবাপ্পে হয়েছেন সেরা গোলদাতা।
বিশ্বকাপ ছাড়াও ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত হয় ফুটবলের আরও কিছু বড় আয়োজন। ৯ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ‘আফ্রিকান কাপ অব নেশন্স’ টুর্নামেন্ট। ক্যামেরুনের মাটিতে আফ্রিকার শ্রেষ্ঠত্বের আসরে অংশ নেয় ২৪টি দেশ।
ফাইনালে মিশরকে হারিয়ে সেনেগাল জিতে নেয় নিজেদের প্রথম আফ্রিকান ট্রফি। করোনা মহামারির কারণে এক বছর পিছিয়ে যাওয়া আসরে আট গোল করে ‘গোল্ডেন বুট’ জেতেন স্বাগতিক দেশের ভিনসেন্ট আবুবকর। আর সেনেগালের সাদিও মানে নির্বাচিত হন আসরের সেরা ফুটবলার। ২০২২ সালে তিনি আফ্রিকা মহাদেশের বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাবও জিতেছেন। কিন্তু ইনজুরির কারণে আফ্রিকার মেগাস্টার খেলতে পারেননি কাতার বিশ্বকাপে।
জুনে অনুষ্ঠিত হয় ল্যাটিন আমেরিকা আর ইউরোপের সেরা দুই দেশের মধ্যে ‘লা ফিনালিসিমা’। কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা আর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন ইতালি অংশ নেয় এক ম্যাচের ট্রফি লড়াইয়ে। লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে একচেটিয়া ম্যাচে আর্জেন্টিনা ৩-০ গোলে হারিয়ে দেয় ইতালিকে। চূর্ণ করে ইউরোপের দম্ভ। ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন হয়েও আজ্জুরিরা প্লে-অফ বাধা টপকাতে না পেরে টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপের বাইরে ছিল।
জুন থেকে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় ইউরোপের দ্বিতীয় সেরা টুর্নামেন্ট উয়েফা নেশন্স লিগের গ্রুপ পর্ব। ইউরোপের দলগুলোকে র্যাংকিংয়ের ভিত্তিতে চার ধাপে ভাগ করে আয়োজিত হচ্ছে এই আসর। শীর্ষ ধাপের চার গ্রুপ থেকে সেরা চার দল ২০২৩ সালের জুনে অনুষ্ঠিতব্য সেমিফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। সেমিতে জায়গা করে নেওয়া চার দেশ হচ্ছে- ক্রোয়েশিয়া, ইতালি, হল্যান্ড আর স্পেন। নভেম্বর-ডিসেম্বরে কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে শিরোপা জয়ের পরও বছর শেষে আর্জেন্টিনা ফিফা র্যাংকিংয়ের শীর্ষে উঠতে পারেনি। ব্রাজিল কোয়ার্টার থেকে বাদ গেলেও র্যাংকিংয়ের শীর্ষ দল হিসেবে শেষ করেছে ২০২২ সাল। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা দ্বিতীয় আর রানার্স-আপ ফ্রান্স রয়েছে তৃতীয় স্থানে।
পুরুষদের আসর ছাড়াও ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত হয় মেয়েদের ফুটবলের একাধিক বড় আসর। বছরের শুরুতেই নারীদের এএফসি এশিয়া কাপের শিরোপা জয় করে চীন। ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টের ফাইনালে চীন হারায় দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়েদের। জুলাই মাসে ইংল্যান্ড নারী দল জয় করে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ। তারা ফাইনালে হারায় জার্মানিকে। ১৯৬৬ সালে ববি চার্লটনদের বিশ্বকাপ জয়ের পর ফুটবলে এটাই ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শিরোপা।
জুলাইতেই অনুষ্ঠিত হয় নারীদের কোপা আমেরিকা। ফাইনালে স্বাগতিক কলম্বিয়াকে হারিয়ে ল্যাটিনের সেরা ছিল ব্রাজিলের মেয়েরা। আগস্টে নারীদের ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জয় করে স্পেন। ফাইনালে হারায় এশিয়ান প্রতিনিধি জাপানকে। টুর্নামেন্ট স্বাগতিক ছিল কোস্টারিকা। অক্টোবরে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ ট্রফিও জিতে নেয় স্পেন।
২০২২ সাল শেষ হয়েছে বিশ্বকাপ আসর দিয়ে। এবারেই প্রথম জুন-জুলাইয়ের পরিবর্তে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে বছরের শেষে। কাতারের গরমের কথা বিবেচনা করে ছিল এই সিদ্ধান্ত। নানা অঘটন আর জাঁকজমক আয়োজনে কাতার বিশ্বকাপ শুধু ২০২২ সাল নয়, স্মরণীয় হয়ে থাকবে ফুটবল ইতিহাসের আলোচিত টুর্নামেন্ট হিসেবে। আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে মরক্কোর সেমিফাইনাল আর এশিয়ার তিনটি দেশের প্রথমবারের মতো নকআউট পর্বে খেলা ছিল চমক। সব মিলিয়ে ভক্তদের পুরো এক মাস মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা বিশ্বকাপ দিয়েই শেষ হয়েছে ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যালেন্ডার।