বাংলাদেশের পুরুষদের জাতীয় ফুটবল দল ২০০৩ সালে সাফ শিরোপা জয়ের পর পায়নি আর কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা। বিপরীতে নারীরা গড়েছেন নতুন ইতিহাস। ২০২২ সালের পর ২০২৪-এর সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বাঘিনীরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে নারী কিংবা পুরুষ মিলিয়ে কোনো টুর্নামেন্টে শিরোপা অক্ষুণ্ণ রাখার অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত গড়েছেন সাবিনা খাতুনরা।
২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নেপালের দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের ফাইনালে হারিয়ে বাংলাদেশের নারীদের জাতীয় দল জিতেছিল প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি। ২০২৪ সালে সেই রঙ্গশালা স্টেডিয়ামেই ৩০ অক্টোবর স্বাগতিকদের ২-১ ব্যবধানে হারান বাংলার দামাল কন্যারা। অথচ টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল পাকিস্তানের বিপক্ষে ১-১ গোলের ড্র বাংলাদেশকে ফেলে দিয়েছিল শঙ্কায়। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে শক্তিশালী ভারতকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে দেওয়া বাংলাদেশ উঠে যায় সেমিফাইনালে। শেষ চারের লড়াইয়ে বাংলাদেশ ৭-১ গোলে হারায় ভুটানকে। আর ফাইনালে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর নেপালকে পরাজিত করে মেতে ওঠে শিরোপা জয়ের উল্লাসে।
পুরো আসরে অনবদ্য নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন বাংলাদেশের গোলরক্ষক রুপনা চাকমা। টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এ ছাড়া ঋতুপর্ণা চাকমা পেয়েছেন সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি। ফাইনালের ৮১ মিনিটে ঋতুপর্ণার অসাধারণ গোলেই বাংলাদেশ পায় অবিশ্বাস্য জয়ের দেখা। টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের পর বাংলাদেশ দলের কোচ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নাটকীয়তা। সিনিয়রদের সঙ্গে দূরত্বের অজুহাতে নারী দলের দায়িত্ব ছাড়তে চান কোচ পিটার বাটলার। যদিও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) তরফে বলা হয়েছে নারী ফুটবলের সঙ্গে থাকছেন বাটলার। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ওয়েস্টহ্যামের হয়ে খেলেছেন বাটলার। কোচ হিসেবে লাইবেরিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে জাতীয় দল এবং শীর্ষ ক্লাবে কোচিং করিয়েছেন। তার যোগ্যতা-সামর্থ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই কারও। গোলাম রাব্বান ছোটনের পর নারী দল যোগ্য কোচের হাতে পড়েছে বলে মনে করেন ফুটবলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাই নারী ফুটবলের উন্নয়নের স্বার্থেই বাটলারের সঙ্গে খেলোয়াড়দের দূরত্ব যত দ্রুত সম্ভব কমিয়ে আনা উচিত।
বাংলাদেশের নারী ফুটবল নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই। সাফ খেলতে যাওয়ার আগে সাবিনারা সেপ্টেম্বর মাসের বেতন পাননি। এক বছর ধরেই বেতন অনিয়মিত। দুই-তিন মাস পর এক মাসের বেতন পেয়েছেন। সাবিনা, কৃষ্ণা ও সানজিদারা মাসে ৫০ হাজার টাকা পান। বাফুফে নতুন চুক্তিতে একাদশে থাকলে ১০ হাজার টাকা ম্যাচ ফি নির্ধারণ করেছে। সেই ফিও থাকে বকেয়া। মেয়েরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগও ঠিকমতো পায় না। প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো নারী দল গঠনে অনাগ্রহী। তাতে পেশা হিসেবে ফুটবলকে বেছে নিতে ভরসা পান না মেয়েরা। সব মিলিয়ে নারীরা দেশের জন্য নিয়মিত সাফল্য এনে দিয়েও বড্ড বেশি অবহেলিত।
দেশে অবহেলিত হলেও বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের কদর বাড়ছে বিদেশি লিগে। এরই মধ্যে সাবিনা, সানজিদা খাতুন আর মনিকা চাকমারা ভারত ও ভুটানের ক্লাবে খেলেছেন। এবার তো সাবিনা আর ঋতুপর্ণার ডাক এসেছে ইউরোপের উত্তর ম্যাসেডোনিয়ান ক্লাব ব্রেরা তিভেরিজা থেকে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা নিজেই। ক্লাবটি নিজ দেশের চ্যাম্পিয়ন। পরবর্তী মৌসুমে নারীদের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের গ্রুপ পর্বে খেলবে দলটি। সাবিনা আর ঋতুপর্ণা দলটিতে যোগ দিলে বাংলাদেশের নারী ফুটবল বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পাবে নিঃসন্দেহে।
এদিকে সাফজয়ী নারী দলের সাক্ষাৎ হয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার কাছে নানা আকাঙ্ক্ষা ও দাবিদাওয়ার কথা তুলে ধরেন ফুটবলাররা। এ ছাড়া কৃষ্ণা রাণী সরকার স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনার সঙ্গে ম্যাচ আয়োজনের দাবি জানান। বার্সেলোনার নারীরা বর্তমান উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপাধারী। অর্থাৎ কৃষ্ণা রাণীরা খেলতে চাইছেন ইউরোপের সেরা ক্লাবের সঙ্গে। এটা দুঃসাহস নয়, আত্মবিশ্বাস। সুযোগ পেলে মেয়েরা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ফুটবলকে প্রতিষ্ঠিত করার সাহস রাখে, এটা তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh