ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু যখন বছর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন বিপরীত চিত্র প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের। গত পাঁচ বছরে প্রবাসে মারা গেছেন অন্তত ১৫ হাজার ৩০৩ জন বাংলাদেশি শ্রমিক। ৯৪ শতাংশ মৃত্যুই অস্বাভাবিক। বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭০ ছাড়ালেও প্রবাসে মৃত্যুবরণকারীদের গড় বয়স মাত্র ৩৮!
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে সরকারি হিসাবে বিদেশে মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার ৩৯২জন বাংলাদেশি শ্রমিকের। প্রতিদিন গড়ে ১০টি লাশ আসছে বিদেশ থেকে। তবে সরকারি হিসাবের বাইরেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিকের মৃত্যু হচ্ছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ইতালিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় কাসেম আলীর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৫। এর আগের দিন সৌদি আরবের দাম্মামে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সালাহউদ্দিন নামে এক যুবক। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরে। তার একদিন আগে ব্রুনাইয়ে ভবন নির্মাণের কাজ করার সময় ছাদ থেকে পড়ে সিলেটের কুনু মিয়া মারা যান।
এমন মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল, এই পাঁচ বছরে ১৫ হাজার ৩০৩ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। সর্বোচ্চ চার হাজার ২০৯ জন মারা গেছে সৌদি আরবে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মালয়েশিয়া থেকে লাশ এসেছে দুই হাজার ৩২৭ জনের।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপ-পরিচালক জাহিদ আনোয়ার জানিয়েছেন, প্রবাসে মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের লাশ ফেরাতে সব খরচ বহন করে সরকার। একজন শ্রমিকের লাশ ফেরাতে ১০ লাখ টাকা খরচেরও নজির রয়েছে। দেশে মরদেহ ফেরার পর ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয় লাশ বাড়ি নিতে ও সৎকার করতে। এরপর তিন লাখ টাকা দেওয়া হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ। তবে শুধু বৈধ শ্রমিকরাই এ সুবিধা পেয়ে থাকেন। প্রবাসে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হলে যে প্রতিষ্ঠানের কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে সহায়তা করে সরকার।
ব্রুনাইয়ে মৃত কুনু মিয়ার লাশ এখনো দেশে ফিরেনি। তার বাবা আব্বাস মিয়া বলেছেন, তার ছেলের বয়স মাত্র ২৪। চার মাস আগে তিনি বিদেশ গিয়েছিলেন পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে। সহায়-সম্বল বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলেন। তিন লাখ টাকা পেলে কি হবে? ছেলেকে তো আর পাবেন না। ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছেন, সেখানে ছাদ থেকে পড়ে ছেলের মৃত্যু হবে- তা মানতে পারছেন না।
গত বছর বিদেশে থেকে লাশ এসেছে তিন হাজার ৬৭৬ জনের। ২০১৭ সালে তিন হাজার ২৬৩, ২০১৬ সালে দুই হাজার ৯৫১, ২০১৫ সালে দুই হাজার ৫৯৫, ২০১৪ সালে দুই হাজার ৭১৮ জনের লাশ আসে দেশে। অর্থাৎ বছর বছর বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা।
তবে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, প্রবাসীর সংখ্যার তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা খুব বেশি নয়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি হাজারে মৃত্যুর সংখ্যা ছয়জনের কম।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলছেন, ‘সরকার প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয়টিকে সবসময়ই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। তারা যেন ভালো পরিবেশে বসবাসের সুযোগ পায়, তার জন্য সরকার সম্ভাব্য সব চেষ্টাই করে। কেউ আহত বা নিহত হলে, যে কোম্পানির অধীনে কাজ করত, তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করে। তবে এটাও মানতে হবে, ৮০ লাখ প্রাবাসীর বিপরীতে বছরে তিন হাজার নিহত হওয়া খুব বড় সংখ্যা নয়।’
কিন্তু এখানেও প্রশ্ন থেকে যায়। বিদেশ যাওয়ার আগে বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। রোগাক্রান্ত বা সংক্রামক ব্যাধি থাকলে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় না। ভারী, শ্রমসাধ্য কাজ করতে যারা সক্ষম, তারাই সুযোগ পান স্বপ্নের বিদেশ যাওয়ার। তারপরও কেন এই অকালে মৃত্যু?
এর জবাবে টেলিফোনে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের দীঘা গ্রামের সিঙ্গাপুর প্রবাসী আবু আলা নেসার উদ্দিন আহমেদ ছোটন জানান, ভারি ও শ্রমসাধ্য কাজই মৃত্যুর কারণ। এর সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা তো আছেই। বাংলাদেশি শ্রমিকদের কোম্পানিগুলো যেখানে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে, সেগুলো অস্বাস্থ্যকর। গুদামের মতো এক একটি ঘরেই থাকে ২৫ থেকে ৩০ জন। কেউ ছোঁয়াছে রোগে আক্রান্ত হলে হলে তা অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে।
ছোটন জানান, বিদেশ যাওয়ার খচর তুলতে দৈনিক ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। এই অমানসিক পরিশ্রম ও বাড়িতে টাকা পাঠানোর দুশ্চিন্তা তিলেতিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাবে, বিদেশ থেকে যাদের লাশ আসছে, তাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ৩০ শতাংশ মারা গেছেন হৃদরোগ অথবা স্ট্রোকে। অন্যদের বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা অথবা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। খুন ও আত্মহত্যার সংখ্যা প্রায় ৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। ১৫ হাজার ৩০৩ জনের প্রায় ৭০ শতাংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, লিবিয়া, ইরাক থেকে।
প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের হিসাবে ২০১৭ ও ২০১৮ সাল, এই দুই বছরে ছয় হাজার ৯৬৯ জনের লাশ এসেছে। এর মধ্যে মাত্র ৪১৬ জনের অর্থাৎ শতকরা ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক কারণে।
অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, ‘যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের গড় বয়স মাত্র ৩৮ বছর। এটাই সবচেয়ে ভাবনার বিষয়। এত অল্প বয়সে সুস্থ সবল মানুষের একের পর এক অস্বাভাবিক মৃত্যু গ্রহণযোগ্য নয়।’
মধ্যপ্রাচ্যে মৃত্যুর উচ্চ হার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশেষত সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ‘আকামার’ নামে কফিল (মালিকরা) আধুনিক দাস প্রথার সৃষ্টি করেছে। শ্রমিকরা চাইলেও চাকরি পরিবর্তন করতে পারেন না। অত্যাচার সহ্য করেই কাজ করতে বাধ্য। ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তীব্র গরমে শ্রমসাধ্য কাজ করালেও বাধা দেওয়ার উপায় নেই। অধিকাংশ শ্রমিক জমি বিক্রি করে নয়ত ঋণ করে বিদেশ যাওয়া খরচের টাকা তোলার চাপও রয়েছে। একদিকে হাড় ভাঙা খাটুনি, অন্যদিকে মানসিক চাপ- এতেই বাড়ছে মৃত্যু। এ বিষয়ে সরকারিভাবে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’