‘সেভেন সিস্টার্স দখল’, ফজলুরের বক্তব্য সরকারের নীতি নয়: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ মে ২০২৫, ২০:৩৭

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমান। ফাইল ছবি
ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য আক্রমণ করে দখল করে নেওয়ার বিষয়ে বিডিআর হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্ত কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমানের বক্তব্য সরকার কোনোভাবেই অনুমোদন করে না, এবার বলেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
শুক্রবার মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে সরকারের এই অবস্থান তুলে ধরা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, সম্প্রতি তার ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টে যে মন্তব্য করেছেন, তা সম্পূর্ণরূপে তার ব্যক্তিগত মতামত। সংশ্লিষ্ট মন্তব্যগুলো কোনোভাবেই সরকারের নীতি বা অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না।’’
বিডিআর হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্ত কমিশন প্রধানের বক্তব্যের সঙ্গে কোনোভাবেই রাষ্ট্রের অবস্থান গুলিয়ে না ফেলার অনুরোধও করা হয় এতে।
ফজলুর কী বলেছিলেন
ভারত পাকিস্তানে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দেশটির সরকারের তরফে বক্তব্য আসার পর ফজলুর রহমান এমনটি হলে বাংলাদেশকে ভারতের সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে আক্রমণের পরামর্শ দেন।
তিনি লেখেন, “ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে বাংলাদেশের উচিৎ হবে উত্তর পূর্ব ভারতের সাত রাজ্য দখল করে নেওয়া। এ ব্যাপারে চীনের সাথে যৌথ সামরিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন বলে মনে করি।”
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ফজলুর রহমান ২০০০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০১ সালের ১১ জুলাই পর্যন্ত সীমান্তরক্ষী বাহিনী সে সময়ের বিডিআরের মহাপরিচালক ছিলেন।
বিডিআর হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্ত কমিশনের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমানের আলোচিত সেই স্ট্যাটাস।
তিনি এই পদে থাকার সময় ২০০১ সালের এপ্রিলে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তে বিএসএফের সঙ্গে বিডিআরের সংঘাতের ঘটনায় তাকে বিডিআরের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীতে ফেরত নেওয়া হয়। এরপর বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ২০০২ সালের ১৭ মার্চ তাকে আগাম অবসরে পাঠানো হয়।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদরদপ্তর পিলখানায় এক বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭১ জনের প্রাণহানির ঘটনা পুনঃতদন্তে ফজলুরকে প্রধান করে একটি কমিশন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ২৩ ডিসেম্বর দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টাকে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে এই কমিশন।
প্রেস সচিব আগেই সরকারের অবস্থান জানিয়েছেন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কাছ থেকে এমন বক্তব্য আসার পরপর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফেসবুক স্ট্যাটাসে বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরেই সরকারের অবস্থান জানিয়েছেন।
নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনিও লেখেন, ‘‘মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের ব্যক্তিগত মতামতকে সরকারের মতামত হিসেবে বিবেচনা না করার জন্য আমরা সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’’
ফজলুর রহমান ফেসবুকে স্ট্যটাস দেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম আগেই সরকারের অবস্থান জানিয়েছেন।
শফিকুল আরও লেখেন, আরও লেখেন, “বাংলাদেশ সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করে এবং অন্যদের কাছ থেকেও একই ধরনের সম্মান প্রত্যাশা করে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আর কী কথা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফজলুরের বক্তব্যের বিষয়ে বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘বাংলাদেশ সরকার উক্ত বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয় এবং তা সমর্থন করে না। এ ধরনের মন্তব্য সরকার কোনোভাবেই অনুমোদন করে না।’’
যেন কেউ ফজলুর রহমানের ‘ব্যক্তিগত মন্তব্যের’ সঙ্গে রাষ্ট্রের অবস্থানকে গুলিয়ে না ফেলেন বা সরকারকে এর সঙ্গে যুক্ত না করেন, সেই অনুরোধও করা হয় বিবৃতিতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, “বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে সব জাতির সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, পারস্পরিক সম্মান এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে অটল রয়েছে।”
সেভেন সিস্টার্স নিয়ে সরকারের আগের বক্তব্যেও তোলপার
প্রধান উপদেষ্টা তার চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তা নিয়েও তুমুল আলোচনা তৈরি হয় ভারতে। পরে প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেনটেটিভ এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে একে ‘সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ আখ্যা দেন।
গত ২৮ মার্চ বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বেইজিংয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, “ভারতের সাত রাজ্য, ভারতের পূর্বাঞ্চলে, যেগুলোকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়ে থাকে… ভারতের ভূবেষ্টিত অঞ্চল। সমুদ্রে যাওয়ার কোনো উপায় তাদের নেই। এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক আমরা।
“ফলে, এটা বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। এটা চীনের অর্থনৈতিক বর্ধিতাংশ হতে পারে। বিভিন্ন জিনিস নির্মাণ, উৎপাদন করুন, বাজারজাত করুন; জিনিসপত্র চীন নিয়ে আসুন কিংবা সারাবিশ্বে পাঠিয়ে দিন।”
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে গিয়ে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পরে সরকার প্রধানের হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান গত ২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে এসে তার ব্যাখ্যা দেন। তার এই বক্তব্যে রীতিমতো হৈ চৈ শুরু হয় ভারতে। ইউনূসের সমালোচনামুখর হন ভারতের রাজনীতিক, সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা।
পরে গত ২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন।
সেদিন তিনি বলেন, “কানেক্টিভিটি এই অঞ্চলের সম্ভাবনার দুয়ারটা খুলে দেবে। বিশেষ করে, যাদের জন্য সমুদ্রে এক্সেস পাওয়াটা খুব কঠিন। আমরা কিন্তু কানেক্টিভিটি জোর করে চাপিয়ে দেব না। দেওয়ার অবস্থাও আমাদের নাই।”
ভারত এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে খলিলুর বলেন, “কেউ যদি নেন, খুব ভালো; আর না হলে কী করব আমরা? আমাদের কিছু করার নাই। অত্যন্ত সৎ-উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কথাই উনি (ইউনূস) বলেছেন।”
এই বক্তব্যের ভিন্ন ব্যাখ্যা ‘আমরা ঠেকাতে পারছি না‘ বলে মন্তব্য করে হাই রিপ্রেজেনটেটিভ বলেন, “আমরা শুধু এটুকু বলতে পারব, আমরা কানেক্টিভিটি সকলের ইকুইটেবল বেনিফিটের জন্য দিতে আগ্রহী আছি। কেউ নেবেন তো ভালো, না নিলে নেবেন না!”