Logo
×

Follow Us

সরকার

পুরাতন দ্বিদলীয় বন্দোবস্ত টিকে গেছে: উপদেষ্টা মাহফুজ

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৫, ১৬:৫৫

পুরাতন দ্বিদলীয় বন্দোবস্ত টিকে গেছে: উপদেষ্টা মাহফুজ

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের নয় মাস পর তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মনে হচ্ছে ‘পুরনো দ্বিদলীয় বন্দোবস্ত’ অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে রাজনীতি ‘টিকে গেছে’।

তার মতে, সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র আপস করেছে, ব্যবসাতেও আওয়ামী লীগের আধিপত্য কমেনি।

বৃহস্পতিবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় ‘কৈফিয়ত কিংবা বাস্তবতা’ শিরোনামে এক পোস্টে তিনি এসব কথা বলেন, যদিও কোন পরিপ্রেক্ষিতে ৩৩৯ শব্দের এই স্ট্যাটাস, তার কারণ ব্যাখ্যা করেননি তিনি।

মাহফুজ লেখেন, “সামরিক- বেসামরিক আমলাতন্ত্র কম্প্রোম্পাইজড। মিডিয়া ও ব্যবসায়ে (আওয়ামী) লীগের আধিপত্য কমেনি। লীগের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে হাত দেওয়া যায়নি৷ পুরাতন দ্বিদলীয় বন্দোবস্ত টিকে গেছে। বিচার বিভাগ এখনো দ্বি-দলীয় বৃত্তে বন্দি।” (বানান পাল্টানো হয়েছে।

১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশ শাসন করেছে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এই সময়ে দুইবার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাস করে দুইবার এবং একবার জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ এর জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দুই বছর এবং গত বছরের ৮ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ শাসন করছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিকল্প হিসেবে তৃতীয় শক্তি হিসেবে নানা নাম নানা সময় আলোচনায় থাকলেও রাজনীতিতে তারা সুবিধা করতে পারেনি। আলোচনায় থাকলেও জামায়াতে ইসলামী ভোটের রাজনীতিতে দৃশ্যত অসফল, কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মীয় দলগুলো আরও বেশি ব্যর্থ।

ছাত্রদের সরিয়ে দিয়ে ‘দ্বিদলীয় বন্দোবস্তে’ ফেরার জন্য ক্ষমতাকেন্দ্রিক গোষ্ঠী অপেক্ষায় আছে বলেও মনে করেন মাহফুজ আলম। তার মতে, “ছাত্রদের পরিপূর্ণ অসহযোগিতার মুখে এরইমধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে।”

মাহফুজ যা লিখেছেন তার সার কথা দাঁড়ায়, ‘ভুল’ রাজনীতিতে জড়িয়ে ডানপন্থিরা প্রতিক্রিয়াশীল হয়েছে, অভ্যুত্থানের শক্তিদের মধ্যে বিভক্তি হয়েছে, ছাত্রদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে, জনতার মনোবল হারিয়েছে।

‘জোড়াতালি দিয়ে’ গণতান্ত্রিক রূপান্তর আর ‘নূতন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সম্ভব নয়’ বলেও মত প্রকাশ করেন তিনি। লেখেন, “ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অনেকগুলো। ফলে কাজের দায় সরকারের, কিন্তু কাজ করে ক্ষমতার অন্যান্য ভরকেন্দ্র।”

যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে মাহফুজকে গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ‘তুলে ধরেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস; অবশ্য কয়েক মাস পরে এই কৃতিত্ব নিতে অস্বীকার করেন তথ্য উপদেষ্টা।

গত ২৮ আগস্ট মাহফুজ আলমকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ১০ নভেম্বর তিনি উপদেষ্টা হিসেবে সরকারে যোগ দেন।

মাহফুজ আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে যে আন্দোলন, তার নেপথ্যে থাকা সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির ‘তাত্ত্বিক নেতা’ হিসেবে তার পরিচয় উঠে এসেছে সংবাদ মাধ্যমে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী নিয়োগের পর তার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আসে সংবাদ মাধ্যমে।

ওই বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে এক আয়োজনে মাহফুজকে সরকার পতন আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস; তবে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি ফেসবুকে লেখেন, “মাস্টারমাইন্ড নামক মিডিয়ার তৈরি হাইপকে আমি শুরুতেই প্রত্যাখ্যান করেছি।”

মাহফুজ সরকারে আমার পর থেকে ‘নতুন বন্দোবস্ত’ ও ‘মুজিববাদী’ আদর্শের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতের কথা বলেছিলেন একাধিকবার।

সরকার পতনের ৯ মাস পর আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে মতভেদ ও একে অপরের সমালোচনা দেখা যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে গঠন হয়েছে নতুন দল এনসিপি, যাকে আক্রমণ করে কথা বলছে বিএনপির মধ্যম সারির নেতারা। ঢাকার বাইরে এনসিপির নেতাদের ওপর একাধিক আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে।

আবার ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নানা সময় ঝটিকা মিছিল করছেন, শেখ হাসিনাকে ‘বীরের বেশে’ ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিচ্ছেন।

অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিতে বিভক্তির আক্ষেপ

মাহফুজের বক্তব্যে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা শক্তির এই বিভেদের বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি লেখেন, “রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের পর সহযোগী ভূমিকায় নেই৷ কিন্তু, ঠিকই প্রশাসন, বিচারবিভাগ, পুলিশে তারা স্টেইক নিয়ে বসে আছেন। এস্টাবলিশমেন্ট দ্বিদলীয় বৃত্তে ফিরতে এবং ছাত্রদের মাইনাস করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”

আবার কেবল এনসিপি নয়, গণঅভ্যুত্থানে থাকা ছাত্রদের নেতৃত্বে একাধিক দল ও মোর্চা গঠন হয়েছে। এতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরও শক্তিক্ষয়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনীতিতে।

মাহফুজের মতে ‘নাগরিক কমিটি’ নামে যে প্লাটফর্ম ছিল, সেটিই সবচেয়ে শক্তিশালী মোর্চা হতে পারত।

গত ২৮ আগস্ট মাহফুজ আলমকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ১০ নভেম্বর তিনি উপদেষ্টা হিসেবে সরকারে যোগ দেন।

তিনি লেখেন, “ছাত্রদের কয়েকটি দল হয়ে যাওয়াতে তারা এখন বিভক্ত, তদুপরি অন্য রাজনৈতিক দলের মতই তারা ট্রিটেড হচ্ছেন। এজন্য নাগরিক কমিটিই ছিল দীর্ঘমেয়াদে অভ্যুত্থানের ফোর্স হিসাবে টেকসই।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও তার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেনি বলে মনে করছেন তথ্য উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “(এই) প্লাটফর্ম দেশব্যাপী ছাত্রদের গুছিয়ে উঠতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অভ্যুত্থানের ছাত্র- জনতা বিভক্ত ও দ্বিধান্বিত। বাম-ডানের কালচারাল ক্যাচাল জুলাইকে দুর্বল করেছে এবং শাহবাগ- শাপলাকে চিরন্তন করে তুলেছে।”

সরকারে প্রতিনিধিত্ব নিয়েও আফসোস

সরকারে থাকা ছাত্র প্রতিনিধিদেরকে ‘কোণঠাসা’ করার আক্ষেপ উঠে এসেছে তথ্য উপদেষ্টার লেখায়।

তিনি বলেন, “প্রায় তিন ডজন নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ছাত্র মাত্র দুজন। ছাত্র প্রতিনিধিদেরকেও এস্টাবলিশমেন্ট রাষ্ট্রপতি অপসারণের ঘটনার পর থেকে কোণঠাসা করে রেখেছে। আমরা দুজন সর্বোচ্চ ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট করতে পারছি, কিন্তু প্রভাবক হিসাবে কাজ করতে হলে সরকারে সুষম ছাত্র প্রতিনিধিত্ব লাগবে।”

গত ৮ আগস্ট নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়ে সরকারে যোগ দেন। মাহফুজ যুক্ত হওয়ার পর সংখ্যাটি দাঁড়ায় তিনে।

তবে ফেব্রুয়ারির শেষে এনসিপি গঠনের আগে আগে নাহিদ সরকার থেকে সরে দাঁড়ান, এতে ‘ছাত্র প্রতিনিধি’র সংখ্যা কমে আবার দুইয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে শুরুতে ১৭ সদস্যের সরকারের আকার বেড়ে এখন হয়েছে ২৩ জনে।

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে শপথ নেন নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তবে নাহিদ সরকার থেকে সরে গিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি গঠন করে তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

‘ডানপন্থিরা প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায়’

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ডানপন্থিরা প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বলেও মনে করেন মাহফুর আলম।

তিনি লেখেন, “ডানপন্থিরা ভুল রাজনীতি করেছেন এবং নূতন বাস্তবতায় আবেগের বশে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা রেখেছেন।

“বামপন্থিরা প্রথম থেকেই সরকারের প্রতি স্কেপটিক্যাল (সংশয়বাদী) এবং অভ্যুত্থানের পক্ষে জোরদার ভূমিকা রাখতে অসফল।”


‘ছাত্র জনতা হতোদ্যম’

মাহফুজ লেখেন, “সবচেয়ে ডেডিকেটেড ছাত্রকর্মীরা ‘ক্রেডিট, দলবাজি আর কোরামবাজি’র খপ্পরে পড়েছেন। আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ হাতেগোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে, কিন্তু ডিমোরালাইজড (হতোদ্যম) হয়েছে সমগ্র ছাত্র- জনতা।”

ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পক্ষের প্রতিষ্ঠান ও নূতন সিভিল সোসাইটি গড়তে ব্যর্থ হয়েছে বলে মত দিয়ে তথ্য উপদেষ্টা লেখেন, “সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অ্যালায়েন্সের ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার কোন হিস্যা নেই।”

আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের ক্ষেত্রে এবং বিচারের প্রশ্নে সরকারসহ সব অংশীজন ‘অসফল’ বলেও মূল্যায়ন করেছেন মাহফুজ আলম।

তিনি লেখেন, “অভ্যুত্থান শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃত হয়নি৷ এস্টাবলিশমেন্ট ও রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থবাদী চিন্তা ও কর্মের সাথে সাথে ছাত্রদের অনভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাব এজন্য দায়ী।”

তাহলে সমাধান?

এই প্রশ্ন করে নিজেই লেখায় তার জবাব দেন মাহফুজ আলম।

তিনি লেখেন, “রাষ্ট্র ও এস্টাবলিশমেন্টে (ক্ষমতাকেন্দ্রিক গোষ্ঠী) ছাত্রদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা এবং ‘ফ্যাসিবাদী শক্তি’ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘আঘাত করা’।

তার মতে, “এগুলোর পূর্বশর্ত হলো, ছাত্রদের মধ্যে সততা, আদর্শ, নিষ্ঠা ও ঐক্য ফিরিয়ে আনা। পুরাতন বন্দোবস্তের ‘সৈনিকদের’ অকার্যকর করে তোলা।”

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫