নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৭ পিএম
আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৬ পিএম
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর তিন দিন পর ৮ আগস্ট দেশের হাল ধরে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২১ সদস্যের এই সরকারের পথচলা শুরু করেছিলো একমাস আগে। আজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস পূর্তি হলো।
একমাস সময় খুব বেশি না হলেও জনগণের চাওয়া অনেক। তার মধ্যে এটিও সত্যি যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শুরুতেই যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ নিরসনের কাজে। এ ছাড়া ভেঙেপড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন ফেরানোর উদ্যোগ নেয় নতুন সরকার। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে দেশের আর্থিক খাতসহ বেশকিছু খাতে সংস্কার প্রক্রিয়া চালানোর মধ্য দিয়ে সুশাসন ফেরানোর উদ্যোগ।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংকিংখাতে ‘নজিরবিহীন লুটপাট’ হয়েছে উল্লেখ করে এ খাতকে স্থিতিশীল করার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ব্যাংকিং খাতের টেকসই সংস্কারে এরইমধ্যে আলাদা ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। খুব শিগগিরই কমিশন গঠন করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া ‘লুটপাটে’র শিকার হওয়া বেশকিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে সেগুলো পুনর্গঠন করা হয়েছে।
অন্যদিকে অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকারি কোনো কাজে যেন আর দুর্নীতি না হয়, সেটি নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করার মধ্য দিয়ে আর্থিক ক্ষেত্রে যে সংস্কার প্রক্রিয়া চালু করেছেন সেটি খুবই গুরুত্ববহ। এ ছাড়াও বিগত সরকারের আমলে আর্থিক খাতের সব কেলেঙ্কারি উদঘাটন ও শ্বেতপত্র প্রকাশের লক্ষ্যে কমিটি গঠন একটি অনন্য পদক্ষেপ। ব্যাংক খাত সংস্কারের সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, অনিয়ম-জালিয়াতির ঋণ ও পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার। দেশের অর্থনৈতিক খাত সংস্কারের এসব গুরুত্বপূর্ণ দিক।
সরকার পরিবর্তনের ছোঁয়ায় দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেও নানা পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির লাগাম টানতে থানাগুলোর সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে নতুনদের।
গত এক মাসে প্রশাসনের শীর্ষপদে ব্যাপক রদবদলের মধ্য দিয়ে প্রশাসনে গতি আনার চেষ্টা আগামীর বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে একটি অনন্য পদক্ষেপ। সর্বোপরি দুর্নীতির লাগাম টানতে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব বিবরণী জমার নির্দেশের বিষয়টিও অবকাঠামোগত সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাস পূর্তিতে গত ৫ সেপ্টেম্বর এক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের তরুণ বিপ্লবীরা দেশের মানুষের মনে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে, তা পূরণে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। শহীদদের আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করতে চাই। এক নতুন যুগের সূচনা করতে চাই।’
সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। তার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমি মনে করি, এটি জনগণের সরকার, এই আস্থা তৈরি করতে পারাটাই এই সরকারের প্রথম ভালো কাজ। বিগত সরকারের আচরণ ছিল মানুষের প্রতি প্রভুসুলভ। আমরা জনগণের কাছে অল্প হলেও এই ধারণা দিতে পেরেছি যে, এটি আপনার সরকার, এই সরকার আপনাদের সেবা দিতে এসেছে। আপনি এই সরকারের যে কোনো সমালোচনা যখন ইচ্ছা করতে পারেন। এই মুক্তির পরিবেশ তৈরি করা গেছে। বৈষম্য ও বঞ্চনা দূর করতে সরকার বেশ কিছু কাজ করেছে। যেটা বাইরে থেকে ততটা বোঝা যাবে না।
নৌপরিবহন ও বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ববরেণ্য নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের সামনে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো, ভেঙে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করা ও বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার। চারদিকে সবার মাঝে, বিশেষ করে তরুণদের প্রত্যাশা হলো ‘রাষ্ট্র মেরামত’। এর জন্যই তাঁরা বুকের তাজা রক্ত দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তরুণ প্রজন্ম ও দেশবাসীরও আকাঙ্ক্ষা যে এই সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মেরামতে পথিকৃৎ হয়ে উঠবে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে সবমিলিয়ে প্রথম এক মাসে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সম্ভাবনা-জাগানিয়া। গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান বৈষম্য ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অনেক পরিকল্পনাই করেছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। পুলিশকে কাজে ফিরিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অচল থানাগুলোকে কাজের উপযোগী করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। সচিবালয়কে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে তথাকথিত আনসার বিদ্রোহ দমন করে তাদের ব্যারাকে ফেরত পাঠিয়েছে সরকার। পাশাপাশি সামনে চলার জন্য তার নিজের ঘর গোছানোর কাজও করতে হয়েছে মাসজুড়ে। এই কাজটিও শেষ হয়নি। তারপরও আগামীর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা সচিবদের সৃষ্টিশীল ও নাগরিকবান্ধব মানসিকতা নিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কর্মসূচির কর্মপরিকল্পনা দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে পুরোনো চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীল উপায়ে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সচিবদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সেভাবেই চলছে কাজ। তারপরও মানুষের অনেক প্রত্যাশা এ সরকারের কাছে। বিশেষত দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট ভেঙে দুর্নীতির রাশ টানা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। সাধারণ মানুষের চাহিদা যতটুকু সেটি সরকার সাধ্যের মধ্যে করলেই মানুষের চাওয়ার অধিকাংশই পূরণ হবে। সে ব্যাপারে সরকার আন্তরিক হবে এমন প্রত্যাশা সবার।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh