
ছবি: সংগৃহীত
অদ্ভুত একটি রোগের নাম লুপাস বা এসএলই। মানুষের শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে, যে ক্ষমতা মানুষকে নীরোগ রাখে, সেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই কোনো কোনো মানুষের শরীরে রোগ ডেকে নিয়ে আসে। সেই রোগটিই লুপাস বা এসএলই। রোগটি পুরুষের চেয়ে নারীর মধ্যে বেশি।
সাধারণত ১৫ থেকে ৮৫ বছর বয়সীরা এই অসুখে আক্রান্ত হতে পারেন। এই অসুখের প্রধান শিকার নারীরা হলেও ইউএন ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্য অনুসারে, ভবিষ্যতে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকবে পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে। কারণ নির্মল পরিবেশ ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে উঠছে, দূষণ অজানা রোগের অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে কম হলেও ইউরোপ-আমেরিকায় এ রোগে আক্রান্তরা প্রচুর। এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই, ফলে রোগটি থেকে কখনো রোগী সুস্থ হয় না। তবে চিকিৎসকদের পরামর্শে রোগী কিছুটা সুস্থ থাকে। রোগটি হলে নারীদের নাকের দুই পাশে সুস্পষ্টভাবে প্রজাপতির মতো একটি লাল দাগ পড়ে। এটা দূর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যায়।
চিকিৎসকদের ভাষায় এর নাম সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথেমাটোসাস (এসএলই)। লুপাস কথাটির মানে প্রদাহ। আর ইরাইথেমাটোসাস শব্দটির অর্থ লাল হয়ে ফুলে যাওয়া। এটি একটি ক্রনিক অটো-ইমিউন রোগ। একবার রোগটিতে কেউ আক্রান্ত হলে মৃত্যু পর্যন্ত ওষুধ খেয়েই যেতে হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই রোগ সৃষ্টি করে
শরীরের মধ্যে থাকা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই এই রোগ সৃষ্টি করে থাকে। প্রতিটি মানুষের শরীরে প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকে। শরীরে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ইত্যাদি কিছু প্রবেশ করলে সেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এদের সঙ্গে লড়াই করে শরীরকে রোগমুক্ত রাখে। এই ইমিউনিটি শরীর থেকে অ্যান্টিবডি নিঃসরণ করে, শরীরে প্রবেশ করা সেসব জীবাণুকে বিনাশ করে দেয়, এটা ঘটে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। কিন্তু কোনো কোনো সময় এই অটো ইমিউনই রোগে পরিণত হয়ে থাকে। লুপাসে আক্রান্ত হলে শরীরের এই অটো ইমিউনই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করার সঙ্গে শরীরের সুস্থ কোষকে ভুল করে আক্রান্ত করে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। লুপাস হলে ইমিউন সিস্টেম শত্রু এবং সুস্থ কোষের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। তখন রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা উল্টো শরীরের সুস্থ কোষ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করে অসুস্থ করতে থাকে। লুপাস হলে মানুষ যত দিন বেঁচে থাকবে তত দিনই এই প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে এবং ভুক্তভোগী কষ্ট পেতে থাকেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, লুপাস নামক রোগটি শনাক্ত হতে অনেক সময় লেগে যায়। কারণ বাংলাদেশে এই রোগের খুব কম সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। তাদের বেশিরভাগই ঢাকায় অবস্থান করছেন। এর আগে অন্য চিকিৎসকদের হাতে পড়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সময় চলে যায়। রোগটি শরীরের একাধিক অঙ্গে প্রভাব ফেলে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। লুপাস রোগের উপসর্গ এক দিনে উপলব্ধি করা যায় না। ধীরে ধীরে উপসর্গগুলোর প্রকাশ ঘটে। অনেক সময় বংশগতভাবে কেউ কেউ রোগটি বয়ে নিয়ে যেতে পারে পরবর্তী বংশধরের মধ্যে।
লক্ষণ
রোগটি হলে শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ করে। উপসর্গ দেখেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। যত দ্রুত রোগ নির্ণয় করা যাবে, ততই এই অসুখটির মোকাবিলা এবং প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করা যাবে। রোগটি মেডিসিন ও রিউমাটোলজি বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা করে থাকেন। লুপাস ইরাইথেমেটাস বা এসএলইর প্রধান লক্ষণ এক বা একাধিক অস্থিসন্ধি ফুলে থাকা। সাধারণত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অস্থিসন্ধিগুলো ফুলে থাকলে সাবধান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউমাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ রোগটির প্রধান উপসর্গ বলেন, গিঁটে ব্যথা হতে পারে, গিঁট ফুলে গিয়ে ত্বকে র্যাশ বা ফুসকুড়ি হয়ে ত্বক লালচে হয়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে চুল পড়ে যেতে পারে, সবসময় ক্লান্তি বোধ হতে পারে। খাবারের প্রতি অরুচি চলে আসতে পারে, ফলে কমে যেতে পারে শরীরের ওজন। রোগটি হলে শরীরে ঘাম দেখা দিতে পারে, তলপেটে ব্যথা হতে পারে, হজমের সমস্যাও হয় এবং বারবার জ্বর এসে গ্রন্থি ফুলিয়ে দিতে পারে। অধ্যাপক শামীম আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস স্কুল অব মেডিসিন বলছে এসএলই বা লুপাসের দুইশর বেশি ধরন রয়েছে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে সবেচেয়ে বেশি মানুষের অটোইমিউন ডিজিজ হয়। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস হলে শরীরের সব ধরনের গিঁটকে আক্রান্ত করে, এতে গিঁট আড়ষ্ট হয়ে যায়, ব্যথা হয়, ফুলে যায়, এমনকি গিঁট বিকৃত ও বিকলাঙ্গ হয়ে যেতে পারে। রোগটি হাতের গিঁটকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে। লুপাসে সোরিয়াসিস হয়ে শরীরের ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, এতে প্রচণ্ড চুলকানি হয়ে থাকে। চামড়ার বিভিন্ন অংশ মোটা ও খসখসে হয়ে যায়। লুপাস হলে গিঁট, ত্বক, কিডনি, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক, ফুসফুস এবং রক্ত কণিকাসহ একসঙ্গে অনেকগুলো অঙ্গ আক্রান্ত করতে পারে। অধ্যাপক শামীম আহমেদ বলেন, চোখ লাল হয়ে যায়, ব্যথা করে, দৃষ্টিশক্তি ব্যাহত করে। নারীদের মাসিক অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। পুরুষদের যৌন ক্ষমতা কমে যায়। সামান্য ঘটনায় উদ্বেগ বেড়ে যায় ও ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
ঘন ঘন জ্বর হয় এবং তা দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। অনেকের ক্ষেত্রে জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি থাকে। তাই অস্থিসন্ধিতে ব্যথার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি জ্বর ও সঙ্গে খিঁচুনি থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত, বিশেষ করে রিউমাটোলজিস্টের কাছে। চিকিৎসকরা বলছেন, লুপাসের চিকিৎসা সঠিক সময়ে না করলে তা ক্রমেই বাড়বে, তৈরি হবে নিত্যনতুন উপসর্গ।
রোগ শনাক্তে সমস্যা
অটোইমিউন ডিজিজ প্রায়ই শনাক্ত করতে সমস্যা হয়। অন্য অনেক শারীরিক সমস্যার সাথে এর উপসর্গ মিলে যায়। অধ্যাপক শামীম আহমেদ বলেন, দেখা যায় অসংখ্যবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরও আসল রোগটি শনাক্ত হয়নি বা দেরি হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে এই সমস্যাটি বেশি কারণ এখানে রিউমাটোলজিস্টের সংখ্যা অনেক কম। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে রিউমাটোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র ৫২ জন। তিনি বলেন, কিছু ধরন আছে যা নির্দিষ্ট অঙ্গ আক্রান্ত করে এবং যে অঙ্গ ধরে ওটাতেই থাকে। কিন্তু যে অটোইমিউন ডিজিজ শরীরের পুরো সিস্টেমকে আক্রান্ত করে সেটা শনাক্ত করা আরও সমস্যা। দেখা যাবে আজকে লিভার ধরেছে, কিছুদিন পর হয়তো শরীরে রক্ত কমে গেছে, কিছুদিন পর দেখা যাবে গিঁটে ব্যথা, মাস কয়েক পর হয়তো তার কিডনি বা হার্টে সমস্যা হয়েছে। এই ধরনটা খুবই বিপজ্জনক একটি রোগ। শরীরে কোনো ধরনের সংক্রমণ বা ইনফেকশন হলে লুপাস বা এসএলইতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
নারীরা কেন বেশি আক্রান্ত
পুরুষদের তুলনায় নারীরা অটোইমিউন ডিজিজে অনেক বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) বলছে, অটোইমিউন ডিজিজে আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। কেন নারীরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে এর সঠিক কারণ এখনো নির্ণয় করা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে নারীদের এক্স ক্রোমোজোম এবং সেক্স হরমোনের একটি সংশ্লিষ্টতা। বিশেষ করে অ্যাস্ট্রোজেন হরমোনের সংশ্লিষ্টতার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে কারণটি বলতে পারছেন না তারা। হরমোনে পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো যেমন বয়ঃসন্ধিকাল, গর্ভাবস্থা ও মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তির সময়গুলোতে নারীরা অটোইমিউন ডিজিজে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং হরমোনে পরিবর্তন পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, জীবনাচরণ মেনে চলার মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এসব কারণে নারীরা বেশি আক্রান্ত হন বলে মনে করা হয়।
প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেই
লুপাস একবার হলে কখনোই পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। অধ্যাপক শামীম আহমেদ বলছেন, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সুষম খাবার, বিশেষ করে আমিষ জাতীয় খাবার কিছুটা বেশি খেতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোনো ধরনের উপসর্গ হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। রোগটি আগে থেকে প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই।
কীভাবে নির্ণয় করা যায়
রিউমাটোলজিস্টরা বলছেন, লুপাস নির্ণয় করা মোটেও সহজ নয়। রোগটি সম্বন্ধে সাধারণ চিকিৎসকদের ধারণা কম। এ কারণে রোগটি সুনির্দিষ্ট করে শনাক্ত করতে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। লুপাসের কারণে শারীরিক সমস্যা হলে সঠিক চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে অন্য বিষয়ের চিকিৎসকের কাছে ঘুরতে ঘুরতেই বেশি সময় নষ্ট হয়ে থাকে। প্রায়ই রোগটিকে অন্য রোগের সঙ্গে এক করে ফেলা হয়। রোগটি নির্ণয় করতে হলে বিভিন্ন ধরনের রক্ত পরীক্ষা করাতে হয়। মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে ত্বকের নমুনা নিয়ে বায়োপসি করেও রোগটি নির্ণয় করা যায়। মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে কিডনির টিস্যু পরীক্ষা করা যায়। এটাকে কিডনির বায়োপসি বলা হয়ে থাকে। লোপাসের স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই এটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে চিকিৎসকরা এর প্রাবল্য কমিয়ে রাখার চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। চিকিৎসকরা দুই হাড়ের সন্ধির ক্ষতিসাধন রোধে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন, অস্থি সন্ধি ফোলা কমানোর ওষুধ, রোধ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে ওষুধ ও খাবার প্রেসক্রাইব করেন। সেজন্য উচ্চ সংক্রমণ থেকে বেঁচে থাকা, উচ্চ কোলেস্টেরল কমিয়ে রাখতে এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন তারা। রোগীকেও এসব রোগ নিয়ন্ত্রণের প্রতি খেয়াল রাখতে হয়।