একে একে বন্ধ হচ্ছে খাওয়ার স্যালাইনের উৎপাদন কেন্দ্র

প্রতীক সিফাত
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:৩৩

খাওয়ার স্যালাইন। ফাইল ছবি
শীত এলেই ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়তে দেখা যায়। সাধারণত রোটা ভাইরাসের কারণে শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। সব ধরনের ডায়রিয়ার চিকিৎসা একটাই, সেটি হলো শরীর থেকে বের হয়ে যাওয়া পানি ও লবণ আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ প্রতিবার পাতলা পায়খানা হওয়ার পর এক প্যাকেট বা আধা লিটার করে খাবার স্যালাইন খাওয়ার উপদেশ দেওয়া হয়। তবে কাঁচামাল সংকটের কারণে সম্প্রতি একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সরকারের স্যালাইন উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। এর প্রভাবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে খাওয়ার স্যালাইনের (ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট বা ওআরএস) সংকট দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হঠাৎ করেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেড়েছে ডায়রিয়া রোগী। এ মৌসুমে রোগী আসার প্রবণতা বেশি। তবে শীতের আগ দিয়ে এ সময় এত রোগী আসাকে অস্বাভাবিকভাবেই দেখছেন তারা। তবে শঙ্কার বিষয় সরকারি হাসপাতালগুলোয় এরই মধ্যে খাওয়ার স্যালাইন সংকট দেখা দিয়েছে।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনামূল্যে খাওয়ার স্যালাইন সরবরাহ করে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইপিএইচ)। গুরুত্বপূর্ণ জীবন রক্ষাকারী এ উপাদান তৈরির জন্য সারা দেশে সংস্থাটির পাঁচটি আঞ্চলিক ইউনিট রয়েছে। এসব ইউনিটের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সিংহভাগই আমদানি করতে হয়। সম্প্রতি কাঁচামাল সংকটের কারণে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে রংপুর ও বরিশালের দুই ইউনিটের উৎপাদন। বাকি ইউনিটগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওআরএস উৎপাদনের জন্য ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, বরিশাল ও রংপুরে পাঁচটি ইউনিট রয়েছে। বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি প্যাকেট খাওয়ার স্যালাইন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ইউনিটগুলোর। ডায়রিয়াজনিত রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকারের দেওয়া এ স্যালাইন বিনামূল্যে পায় সাধারণ মানুষ। ঢাকার বাইরের চারটি ইউনিটের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে সংশ্লিষ্ট জেলার সিভিল সার্জন। আর ঢাকার ইউনিটটি পরিচালিত হয় সরাসরি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম তীব্র ডায়রিয়াজনিত রোগ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিহাইড্রেশনের কারণে এসব মৃত্যু হয়। তাই শরীরে পানিস্বল্পতা পূরণ করতে খাওয়ার স্যালাইন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। জনস্বাস্থ্যের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে একটি অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরির লক্ষ্যে ওআরএস উৎপাদনের একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। ওআরএসের চারটি উপাদান গ্লুকোজ, সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাসিয়াম ক্লোরাইড ও ট্রাইসোডিয়াম। মূলত এ চার উপাদানের অভাবে দেশে সরকারিভাবে খাওয়ার স্যালাইন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের জন্য স্থাপিত রংপুর ইউনিটে ১৬ নভেম্বরের পর থেকে ওআরএস উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। একইভাবে গত সপ্তাহে বন্ধ হয়েছে বরিশালেও।
রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, রংপুর ইউনিটে মজুদ স্যালাইন দিয়ে দুই সপ্তাহের সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। এতে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের ১৬ জেলার সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বিশেষায়িত হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বছরে প্রায় ৬০ লাখ প্যাকেট ওআরএস ইউনিটটিতে উৎপাদন হয়। এ অঞ্চলের হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাওয়ার স্যালাইনের চাহিদা রয়েছে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বিশেষায়িত এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে মাসে ৫০ হাজার প্যাকেট স্যালাইন সরবরাহ করতে হয়। আর রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতি মাসে দরকার হয় ৩০ হাজার প্যাকেট। এ ছাড়া বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও দিনাজপুরে এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মাসিক খাওয়ার স্যালাইনের চাহিদা ২০ হাজার প্যাকেট করে।
রংপুর ইউনিটের দায়িত্বে থাকা জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘কাঁচামালের অভাবে স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। বিষয়টি জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালককে অবহিত করা হয়েছে।’
রংপুর স্যালাইন ইউনিটের স্টোরকিপার মো. এনামুল হক জানান, বর্তমানে ২ লাখ ৯০ হাজার প্যাকেট স্যালাইন মজুদ রয়েছে। প্রতিদিন ২২ হাজার প্যাকেট স্যালাইন তৈরি হয়। নভেম্বরে চাহিদা হচ্ছে সাড়ে চার লাখ প্যাকেট স্যালাইন। উৎপাদিত ওআরএস রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের চার সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সব জেলা হাসপাতাল, দুই সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন পৌরসভা, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশ হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক ও কেন্দ্রীয় কারাগারে সরবরাহ করা হয়।
একইভাবে কাঁচামাল না থাকায় বরিশাল ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে ২১ নভেম্বর। জেলা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বিভাগটির ছয় জেলার বাইরে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জে ওআরএস সরবরাহ করে এ ইউনিট। দৈনিক ১৯ হাজার প্যাকেট উৎপাদন সক্ষমতার ইউনিটটি থেকে বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বছরে প্রায় ৪৫ লাখ প্যাকেট ওআরএস সরবরাহ হয়। গত সেপ্টেম্বরেও প্রায় ১৫ দিন কাঁচামাল সংকটের কারণে উৎপাদন বন্ধ ছিল।
বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান বলেন, ‘কাঁচামাল না থাকায় স্যালাইন উৎপাদন করতে পারছি না। চাহিদা অনুযায়ী ওআরএস উৎপাদনের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলেও সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা নেই। এখনো প্রায় চার লাখ প্যাকেট মজুদ রয়েছে।’
এদিকে কাঁচামালের সরবরাহ না থাকলে এক সপ্তাহ পর যশোর ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘এক সপ্তাহ পর স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খুলনা বিভাগের সব জেলায় এ ইউনিট থেকে স্যালাইন সরবরাহ করা হয়। বিভাগের বাইরের জেলা থেকে চাহিদা পেলে সেখানেও দেওয়া হয়।’
জেলা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, যশোর ইউনিটে দৈনিক ১৫ হাজার প্যাকেট স্যালাইন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। গত বছর প্রায় ২৮ লাখ প্যাকেট সরবরাহ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউনিটটির কাঁচামাল সংকটের কথা এরই মধ্যে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটকে জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জন্য কুমিল্লার ওআরএস উৎপাদন ইউনিটে এখনো সংকট দেখা দেয়নি বলে দাবি করেছেন জেলার সিভিল সার্জন ডা. নাছিমা আকতার। তিনি জানান, কুমিল্লা জেলার ১৭টি উপজেলা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলায় স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী এখনো ওআরএস উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকার ওআরএস উৎপাদন ইউনিটের তত্ত্বাবধানে সরাসরি কাজ করছে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। এ ইউনিট ও বাকি চার ইউনিটের দায়িত্বে থাকা আইপিএইচের উপপরিচালক ডা. মো. দুলাল হোসেন বলেন, ‘ঢাকার ইউনিটের জন্য যে পরিমাণ কাঁচামাল রয়েছে তাতে আগামী মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত উৎপাদন চলবে। কাঁচামালের জন্য গত বছর দরপত্র করা হয়। তবে অর্থবছরের মধ্যে ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করা যায়নি। চলতি অর্থবছরে এটি শুরু করা হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে কাঁচামাল পাওয়া যাবে আশা করছি। তবে স্যালাইনের সংকট দেখা দেবে না, কেননা পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘ইউনিটগুলো থেকে কাঁচামাল সংকটের কথা আমাদের জানিয়েছে। কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য গত জুলাই-আগস্টের দিকে ই-জিপি করা হয়েছে। এ কার্যক্রম এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যারা দরপত্র প্রস্তাব জমা দিয়ে ক্রয়াদেশ পান তাদের কেউ কেউ কাঁচামাল আমদানি করে আবার কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সংগ্রহ করে। কাঁচামালের সংকট হঠাৎ করে নয়। গত অর্থবছরে ক্রয় প্রক্রিয়া শেষ করা যায়নি। আমরা ইউনিটগুলোয় খোঁজ নিয়েছি, সেখানে স্যালাইনের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।’
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ব্যবস্থাপনার অদক্ষতাকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, ক্রয় প্রক্রিয়ায় সংকট ও জটিলতা যে কোনো ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া স্বভাবিকভাবে চললে সঠিক সময়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কোনো কোনো সময় বরাদ্দের পর্যাপ্ততা থাকে না, আবার বরাদ্দ পর্যাপ্ত থাকলেও সঠিক সময়ে কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে না। আবার মজুদ থাকলেও উৎপাদন বন্ধ থাকাকালে চাহিদা বেশি হয়ে গেলে ঘাটতি দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন। তিনি বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা গুরুত্বপূর্ণ। তাদের উৎপাদন বন্ধ হলেও যদি সরবরাহ ঠিক রাখতে পারে তাহলে তো ভালো। তবে মজুদ থাকার পরও যদি চাহিদা বেড়ে যায় তবে বড় ধরনের সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’