Logo
×

Follow Us

স্বাস্থ্য

সিজোফ্রেনিয়া: একশ জনে আক্রান্ত একজন

Icon

রাইয়্যিদাল কবির

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪:৩৬

সিজোফ্রেনিয়া: একশ জনে আক্রান্ত একজন

প্রতীকী ছবি।

মানসিক রোগের মধ্যে সবচেয়ে জটিল হলো সিজোফ্রেনিয়া। রোগটির চিকিৎসা বেশ জটিল। সঠিক চিকিৎসা হলে এ রোগে আক্রান্ত ৫০ শতাংশ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি একশ জনে একজন সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত। এই রোগ পুরুষ অথবা নারী উভয়ের সমানভাবে হয়ে থাকে। তবে পুরুষদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণগুলো কয়েক মাস বা বছর ধরে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করতে পারে বা হঠাৎ করে দেখা দিতে পারে। বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের দুই সরকারি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৪০ থেকে ৪৩ শতাংশ রোগীই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। আধুনিক ব্রেইন স্ক্যানের মাধ্যমে দেখা যায় যে, সুস্থ মানুষের মস্তিষ্কের তুলনায় সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত মানুষের মস্তিষ্কে পার্থক্য থাকে। কিছু কিছু সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কের সব অংশ ঠিকমতো গঠিত হয় না। জন্মের সময় কিছু অসুবিধার জন্য শিশুর মস্তিষ্কে ঠিকমতো অক্সিজেন যায় না বলে মনে করা হয়। শিশু মাতৃগর্ভে থাকার সময় মায়ের ভাইরাল ইনফেকশন হলেও এমন হয়।

রোগটি বংশগত
এই রোগের সঠিক কারণ বিজ্ঞানীদের জানা নেই। তা সত্ত্বেও কিছু কারণকে দায়ী করা হয়। এর মধ্যে জেনেটিক বা বংশগত কারণটাই প্রধান বলে মনে করা হয়। বাবা, মা কারও এ রোগ থাকলে সন্তানেরও হওয়ার আশঙ্কা থাকে। চিকিৎসকরা বলছেন, সিজোফ্রেনিয়া রোগে বংশগত প্রভাব থাকে ৮০ শতাংশ। বাবা ও মা দুজনেরই এই রোগ থাকলে সন্তানের এই রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৪০ গুণ বেড়ে যায়। যমজ বাচ্চার একজনের থাকলে আরেকজনের ঝুঁকি ৫০ গুণ বেশি থাকে। এ ছাড়া সন্তান মাতৃগর্ভে থাকার সময় কোনো সমস্যা হলে বা জন্মের সময় কোনো ক্ষতি হলে বা অক্সিজেনের অভাব ঘটলে এ রোগ হতে পারে। চিকিৎসকরা বলেছেন, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। এদের ৫ থেকে ১০ শতাংশ আত্মহত্যা করে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সানজানা পারভিন জানিয়েছেন, ১৫ বছরের নিচে সাধারণত অসুখটি দেখা যায় না। তবে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সে অসুখটি শুরু হয়। আবার যে কোনো বয়সে এই অসুখ দেখা দিতে পারে। রোগী এমন কিছু শুনতে পায় বা দেখতে পায় যেটা বাস্তবে থাকে না। কথা বলা বা লেখায় অদ্ভুত বা অযৌক্তিক ধরন বা আচরণ থাকে, গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে উদাসীন বোধ করে, নিজের যত্ন নেওয়ার প্রতি উদাসীন হয়ে থাকে, কোনো কাজে মনোযোগ থাকে না এবং কমে যায় আবেগ, অনুভূতি। 

বিষণ্ণতা দেখা দিতে পারে
চিকিৎসার আগে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত অর্ধেক রোগীর বিষণœতা থাকে। ৭ জনের মধ্যে একজনের অন্য লক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে এই লক্ষণ থাকে। এগুলো অনেক সময় নজরে পড়ে না, কারণ এগুলো নেতিবাচক বলে মনে করা হয়। আগে মনে করা হতো সিজোফ্রেনিয়া চিকিৎসার জন্য যে ওষুধ ব্যবহারের ফলেই বিষণœতা হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, এ ধারণাটি ভুল। কারও বিষণ্ণতা আর সিজোফ্রেনিয়া একসঙ্গে হলে সে কথা অন্যকে জানান। এমন কাউকে জানান, যেন আপনার কথা তারা হালকাভাবে না নেন। 

সিজোফ্রেনিয়ায় হ্যালুসিনেশন হয়
সিজোফ্রেনিয়া হলে হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টি বিভ্রম হতে পারে। আপনি কোনো শব্দ শুনতে পারেন, গন্ধ পেতে পারেন, চোখে দেখতে পারেন অথবা কোনো স্পর্শ পেতে পারেন, কিন্তু এসবের কোনো ভিত্তি নেই। 

মনে হতে পারে কেউ আপনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলছে, তারা নিজেদের মধ্যে আপনার সম্পর্কে কথা বলতে পারে। মনে হতে পারে যে, আপনি অন্যদের কথাবার্তা শুনে ফেলছেন। কখনো কখনো ভালোভাবে কথা বলা শোনা যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো সমালোচনা করে, গালাগাল দেয়, বা অন্য কোনোভাবে বিরক্তির কারণ হয়।

কী প্রতিক্রিয়া হয়
কখনো কখনো মনে হয় যে, তারা যা বলছে তা করতেই হবে, এমনকি যদি তারা আত্মহত্যা করতে বলে তাহলে তাও করতে হবে। যদি তারা অন্যায় কাজ করতে বলে, তাহলে অন্যায় জেনেও তা করতে হবে। অনেক সময় এই কণ্ঠস্বরগুলোকে পাত্তা না দিলেও চলে। কিন্তু সবসময় নয়। এসব উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর অনেকে বুঝতে পারে যে মানসিক কিছু সমস্যা হচ্ছে, চিকিৎসা নেওয়া দরকার। যদি সে নিজের সমস্যা বুঝতে পারে, তাহলে তার চিকিৎসার ফলাফল দ্রুত পাওয়া যায়। আবার অনেকেই নিজেদের সমস্যা বুঝতে পারে না। 

আওয়াজ কোথা থেকে আসে
এই আওয়াজের উৎস নিজেরই মন। মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা গেছে, ভুলবশত মস্তিষ্ক মনে করে আওয়াজ আসছে পরিবেশ থেকে, প্রকৃতপক্ষে তা নিজেরই কথা কিংবা চিন্তা। কণ্ঠস্বরগুলো সরাসরি রোগীর সঙ্গে কথা বলে, সমালোচনা করে এবং বারবার এক কথা বলেই যায়। কিছু মানুষ এ ধরনের আওয়াজ শোনেন কিন্তু তাতে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হয় না। 

বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা বা ডিলিউশন
ডিলিউশন হচ্ছে মানুষের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস, যার কোনো বাস্তবিক উপস্থিতি নেই। সন্দেহপ্রবণতা ও অনুমান হচ্ছে মানুষের বড় ডিলিউশন। প্রাত্যহিক নানা ঘটনাতেই ডিলিউশনের উদাহরণ পাওয়া যায়। এটা এমন হয় যে, প্রমাণ ছাড়াই অন্যকে সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা, কারও ঠোঁট নড়তে দেখেই কী বলা হচ্ছে তা অনুমান করা, কোনো দুর্ঘটনার জন্য অতীতের কোনো কর্মকে দায়ী বলে ভাবা, নিজেকে খুব সুপিরিয়র (শ্রেষ্ঠ, অতি উৎকৃষ্ট) ভাবা, কেউ তাকে নজরদারিতে রেখেছে এমন ভাবা। 

অভিভাবকের করণীয়
সুস্থ মেধাবী সন্তান, বন্ধু-বান্ধবীর এমন সমস্যা বুঝতে পারলে তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা না করে তাকে সময় দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মনোরোগ চিকিৎসকরা। তার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে হবে। তারা বলেন, তাকে সাপোর্ট দিন সে যেন পূর্ণাঙ্গ পাগল না হয়ে যায়। আপনি তার বা তাদের একজন ভালো বন্ধু হোন। তার পিঠে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিন। তার সঙ্গে মন খুলে কথা বলুন। 

মা-বাবাদের উচিত বন্ধু হয়ে সঙ্গে থাকা। সন্তানকে বলুন, ভয় পেয়ো না, আমরা সব সময় তোমার সঙ্গে আছি। এ ক্ষেত্রে বন্ধুরা গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে। তার ভালো লাগা না লাগা জানতে চেষ্টা করে সমাধানে এগিয়ে আসলে সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা সাহস পাবে যে, বন্ধুরা তার শুভাকাঙ্ক্ষী, এতে সে ভালো বোধ করবে।

সঠিক সহযোগিতা ও চিকিৎসা পেলে খুব শিগগিরই সে আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে আশা করা যায়। অন্যথায় পূর্ণাঙ্গ মানসিক রোগী হয়ে আত্মহত্যার দিকে চলে যেতে পারে। 


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫