‘রোগীকে সর্বনিম্ন ১০ মিনিট সময় দেবেন চিকিৎসক’, চায় স্বাস্থ্য কমিশন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৫, ১৬:৪৭

২০১৭ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল এ লেখা হয়েছে, বাংলাদেশে একজন চিকিৎসক রোগীকে কেবল ৪৮ সেকেন্ড সময় দেন।
মানসম্মত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে একজন চিকিৎসকের রোগীকে ন্যূনতম ১০ মিনিট সময় দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার বিষয়ে কমিশন।
সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থায় কর্মরত চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ এবং একজন চিকিৎসককে দিনে সর্বোচ্চ ৫০ জন রোগী বেঁধে দেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।
সোমবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে, তাতে এসব কথা বলা আছে।
কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, “রোগীর জন্য মানসম্মত সময় ও যত্ন নিশ্চিত করার জন্য একজন চিকিৎসক সর্বোচ্চ দৈনিক ৫০ জন রোগী দেখতে পারবেন। প্রতি রোগীর জন্য অন্তত ১০ মিনিটের পরামর্শ সময় নিশ্চিত করতে হবে।”
প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেবা প্রদানকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত এবং সাপ্তাহিকভাবে প্রেসক্রিপশন নমুনা যাচাই পদ্ধতি চালু করারও সুপারিশ করা হয়েছে।
৬৭টি দেশের ওপর করা গবেষণার ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ২০১৭ সালের নভেম্বরে এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা একজন রোগীর পেছনে গড়ে ৪৮ সেকেন্ড সময় দেন।
এই সময় প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় কম। ভারতে চিকিৎসকরা একজন রোগীকে গড়ে ২ মিনিট ৩ সেকেন্ড সময় দেন, পাকিস্তানে দেওয়া হয় ১ মিনিট ৩ সেকেন্ড।
‘ইন্টারন্যাশনাল ভ্যারিয়েশন ইন প্রাইমারি কেয়ার ফিজিশিয়ান কনসালটেশন টাইম: আ সিস্টেমেটিক রিভিউ অব ৬৭ কান্ট্রিজ’ শিরোনামে সেই প্রতিবেদনে লেখা হয়, কম সময় দেওয়ার কারণ চিকিৎসকের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি। আর এতে রোগীর স্বাস্থ্যসেবায় যেমন প্রভাব পড়ে, তেমনি চিকিৎসকের ওপরও।
বাংলাদেশে একজন চিকিৎসক দিনে ৯০ জন রোগীও দেখেন বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। এতে লেখা হয়, পশ্চিমা বিশ্বে চিকিৎসকরা তুলনামূলক কম রোগী দেখেন এবং রোগীরাও বেশি সময় পান।
সুইডেনে একজন রোগীকে চিকিৎসক গড়ে ২০ মিনিট সময় দেন বলেও ব্রিটিশ ওই সাময়িকীতে উল্লেখ আছে।

তবে বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যায় ঘাটতি আছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জাতীয় সংসদে জানান যে, বাংলাদেশে প্রতি ১০,০০০ জনে চিকিৎসকের সংখ্যা ৫.৩ জন।
২০২১ সালের তথ্যের ভিত্তিতে সবশেষ সরকারি প্রতিবেদন বলছে দেশে প্রতি ১ হাজার জনে চিকিৎসকের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৬৭ জন।
চিকিৎসকের পাশাপাশি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীও কম। বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য শূন্য দশমিক ৫৬ জন নার্স ও মিডওয়াইফ এবং ১ দশমিক ৮৫ জন অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে।
অর্থাৎ সব মিলিয়ে এক হাজার মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর্মী আছে ৩ দশমিক ০৮ জন, যদিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য অন্তত ৪.৫ জন চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী থাকা উচিত বলে মনে করে।
চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি থাকা অবস্থায় এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন রোগীর জন্য আরও সমস্যাসংকুল হবে কি না, সে বিষয়ে অবশ্য প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি।
প্রাইভেট চেম্বারে কড়াকড়ি
প্রাইভেট চেম্বারে রোগী যাওয়ার বিষয়েও কড়াকড়ি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। কমিশন বলছে, যেখানে সরকারি বা আধা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক কর্মরত আছেন সে হাসপাতাল থেকে কোনো রোগী ওই চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্বারে যেতে পারবে না।
হাসপাতালের কোন কর্মচারী প্রাইভেট চেম্বারে রোগী পাঠালে তা শাস্তি যোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে আসে সংবাদ মাধ্যমে। কখনও চিকিৎসক, কখনও ওই হাসপাতালের কর্মীরা রোগীদের প্ররোচিত করেন বলেই অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে সরকার এসব বিষয়ে কখনও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
রোগীর একই সমস্যা নিয়ে একাধিক চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছে কমিশন। এতে সময় অপচয় হয় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “এতে সেবার ডুপ্লিকেশন হয়। ফলে রোগী ও ডাক্তার উভয়রেই সময়ক্ষেপণ হয় ও চিকিৎসকদের মধ্যে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়।”
এই নিয়ম সরকারি ও বেসরকারি সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন।

বিনা মূল্যে প্রাথমিক সেবা
মোট ৪৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে কমিশন কিছু কাজ অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করার এবং কিছু কাজ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে যাওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এতে সংবিধান সংশোধন করে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে বিনা মূল্যে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বিনামূল্যে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ এবং তালিকা দুই বছর পরপর হালনাগাদ করার কথা বলা হয়।
সর্বজনীন ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য সংশ্লিষ্ট খাতের সঙ্গে এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে সমন্বিতভাবে সেবার ব্যবস্থাপনা করার কথা বলা হয়ে।
সুপারিশে বিভাগীয় পর্যায়ে ১১টি আঞ্চলিক স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষ গঠনের কথাও বলা হয়।
এতে গ্রামে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র একত্রিত করে এবং শহরে ওয়ার্ডভিত্তিক কেন্দ্র গড়ে তোলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র করা, রেফারেল পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা, জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ করা
চিকিৎসকদেরকে ওষুধের নমুনা বা উপহার দিয়ে প্রভাব বিস্তারের যে কোনো ধরনের চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা, প্রতিনিধিদের সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে দৈনন্দিন ওষুধের ‘প্রমোশন’ বন্ধ করতেও বলা হয়েছে।
কমিশন কবে
প্রবল গণ আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ মে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর নানা খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় প্রথম ধাপে সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে আরও পাঁচটি কমিশন গঠিত হয়। এই ধাপের স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী, স্থানীয় সরকার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি এ কে আজাদ খানকে প্রধান করে ১২ সদস্যের স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন-মোহাম্মদ জাকির হোসেন, লিয়াকত আলী, সায়েবা আক্তার, নায়লা জামান খান, সাবেক সচিব এস এম রেজা, মোজাহেরুল হক, আজহারুল ইসলাম খান, সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, সৈয়দ আতিকুল হক, আহমেদ এহসানুর রাহমান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী উমায়ের আফিফ।
কমিশন গঠন হয় ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর। তারা কাজ শুরু করে ৩ ডিসেম্বরে। কমিশনের মেয়াদ ছিল চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত।