অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা : খাবার সংক্রান্ত এক মানসিক ব্যাধি

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২১, ১২:৩৪

প্রতীকী ছবি
ঢাকায় অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা বা ক্ষুধাহীনতা ও বুলিমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এক কিশোরের মৃত্যুর পর তার পরিবার অভিযোগ করেছে, স্কুলের সহপাঠী ও শিক্ষকদের বুলিয়িংয়ের শিকার হবার ফলে এই ঘটনা ঘটেছে।
ফেসবুকে এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট গত বুধবার (৭ জুলাই) রাত থেকে কয়েক হাজার মানুষ শেয়ার করেছেন, যাদের প্রায় সবাই বডিশেমিং, বুলিয়িংয়ের মতো ইস্যুতে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
ওই কিশোরের পরিবার জানিয়েছে, গত ২৫ জুন রাতে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি করা হয়েছিল ছেলেটিকে। পরদিন রাত ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে।
ছেলেটির বাবা মো. ফজলুল করিম বলেছেন, ২০২০ সালের জুন-জুলাইতে ছেলেটির ওজন ছিল ৯৩ কেজি। এরপর জুলাই মাসের দিকে সে খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। ডিসেম্বরে ছেলেটির ওজন দাঁড়ায় ৬০ কেজি। পরিবার ভাবছিল স্বাভাবিক নিয়মে ওজন কমছে ছেলেটির। জানুয়ারির শেষ দিকে ছেলেটির শারীরিক কিছু পরিবর্তন নজরে আসে সবার। তার পায়ের গোড়ালি ফুলে যায়, তার স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে গিয়েছিল ও সে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত।
পরে ফেব্রুয়ারিতে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ছেলেটি প্রথম জানায়- সে ইন্টারনেট থেকে একটি জনপ্রিয় ডায়েট প্রোগ্রাম অনুসরণ করে ওজন কমাচ্ছিল। ওই সময়েই তার একটি মানসিক পরিবর্তনও হচ্ছিল।
তারা বাবা বলছেন, ‘সে ডাক্তারকে বলেছে কোনো বেলায় সামান্য বেশি খেলে বাথরুমে গিয়ে বমি করে ফেলত। আমরা কেউ বিষয়টি খেয়াল করিনি। ওই সময়টাতে সে খেতে ভয় পেত, আবার যদি ওজন বেড়ে যায়, তাহলে আবার স্কুলে সবাই ক্ষেপাবে এমন একটি ভয় চেপে বসেছিল তার মনে, সেটা সে ডাক্তারের কাছে স্বীকার করেছিল।’
এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে ছেলেটিকে একইসাথে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ডায়েটিশিয়ান, সাইকোলজিস্ট ও সাইক্রিয়াটিস্টের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দেয়া শুরু হয়। কিন্তু ততদিনে তার ইমিউনিটি অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে কমে গেছে। সেইসাথে তার ওজন দ্রুত কমে যাচ্ছিল। মে মাসের দিকে তার ওজন দাঁড়ায় ২৯ কেজি।
চিকিৎসকেরা তখন জানান, ছেলেটি অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা নামে একটি অসুখে ভুগছে। এটি এক ধরণের ইটিং ডিসঅর্ডার বা খাবার সংক্রান্ত একটি ব্যাধি, যা নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির মধ্যে মানসিক সমস্যাও তৈরি করে। এটি একটি মানসিক রোগও যাতে একজনের ওজন কমানোর ইচ্ছা অস্বাভাবিকভাবে শরীরের ওজন কমানোতে পরিণত হয়।

অ্যানোরেক্সিয়ার উপসর্গ কী?
দেখা গেছে যে রোগীর সুস্থ শরীর সম্বন্ধে বিকৃত ধারনা থাকে এবং ওজন কমানোর জন্যে কঠোর পরিশ্রম করে। যদিও অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা সাধারণত কৈশোরে শুরু হয়, এটি অপেক্ষাকৃত ছোট শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যেও দেখা যায়। বিনোদন জগতের তারকাদের অনেকে এই রোগে ভোগেন বা ভুগতেন বলে জানা যায়।
শারীরিক লক্ষণ:
- অস্বাভাবিক ওজন কমে যাওয়া ও ভীষণ রোগা লাগা।
- মাথা ঘোরা ও অতিরিক্ত ক্লান্ত লাগা।
- চামড়া শুকিয়ে যাওয়া।
- অনিয়মিত ঋতুচক্র বা বন্ধ হয়ে যাওয়া।
আচরণগত লক্ষণ:
১. ওজন ও খাদ্যে ক্যালরি নিয়ে দুশ্চিন্তা, বারবার আয়নায় নিজেকে দেখা ও ওজন মাপা।
২. খিদে নেই বা খেয়ে নিয়েছি বলে পরিবারের লোকজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে না খাওয়া।
৩. খিটখিটে হয়ে যাওয়া ও সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া।
৪. অতিরিক্ত ব্যায়াম করা।
৫. খাবার পরে জোর করে বমি করা।
৬. ওজন কমানোর জন্যে ওষুধ খাওয়া
৭. নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে তা নিয়ে বাতিকগ্রস্তের মতো সচেতনতা
তবে বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, ভঙ্গুর হাড় ও নখ, খুব বেশি চুল পড়া, ঘন ঘন অজ্ঞান হওয়ার মতো উপসর্গের দিকে নজর রাখতে হবে।
কেন হয় অ্যানোরেক্সিয়া
- এই রোগের সঠিক কারণ না জানা গেলেও নানান গবেষণায় দেখা গেছে যে মানসিক, জৈবিক ও পরিবেশগত কারণের সংমিশ্রণ এই রোগের জন্ম দেয়। ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটির সাথে যুঝে উঠতে গিয়েও অনেকে এই পথে এগিয়ে যান। এমনকি ওসিডি থেকেও খাওয়া দাওয়া নিয়ে বাতিক দেখা দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিখুঁত হবার চেষ্টা ও অতিমাত্রে সংবেদনশীল মানসিকতার কারণেও এই রোগ হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় মস্তিষ্কে সেরোটিনিনের মাত্রার সাথে এর সম্পর্ক দেখা গেলেও জিনগত কোন কারণ এখনো খুঁজে না পাওয়া যায়নি।
- obsessive-compulsive personality traits থেকেও এই মানসিক সমস্যা হতে পারে। যেমন যাদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য থাকে তারা অনেক বেশি কঠোর নিয়ম মেনে চলে এবং এটা থেকে তারা কঠোর ডায়েট মেনে চলে। তারা সবসময় নিখুঁত হতে চায় এবং তাদের শরীরকেও পারফেক্ট বানাতে চায়। এজন্য তারা অতিরিক্ত ব্যায়াম ও খাবার নিয়ন্ত্রণ করে খায়।
- আধুনিক পশ্চিমা সংস্কৃতি বা নায়ক-নায়িকাদের বডি ফিটনেস অনুকরণ করতে গিয়েও হতে পারে। অনেক নেতিবাচক ধারনা থাকে যে যতবেশি স্লিম সে তত বেশি দেখতে সুন্দর। অথবা বন্ধুদের চাপ, বডি শেমিং নিয়ে বুলিং থেকেও এই সমস্যা হতে পারে।
- এছাড়া পারিবারিক দ্বন্দ্ব, শিক্ষাগত চাপ ও পরিবারের সদস্যদের অনিয়মিত খাদ্যাভাসের কারণেও এ সমস্যা হতে পারে।
রোগ নির্ণয়
একটা নির্দিষ্ট বয়সের অনুপাতে যে ওজন ও উচ্চতা থাকা উচিৎ সেই অনুপাতে সঠিক বা তার আশেপাশে ওজন না থাকা, ওজন কম হওয়া সত্বেও ওজন বেড়ে যেতে পারে ভেবে অকারণ ভয়, ওজন ও আকারের বিচারে নিজের চেহারা সম্বন্ধে অবাস্তব ধারনা এবং মেয়েদের কম করে তিন মাস মাসিক না হওয়া।
চিকিৎসা
যেহেতু এই রোগের প্রভাব শরীর ও মন উভয়ের ওপরেই পড়ে তাই চিকিৎসা পদ্ধতিও নানান রকমের হয়। আর এটি খাদ্যের অভ্যাসগত সমস্যা। তাই পুষ্টির ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই এর চিকিৎসা সম্ভব। যেহেতু এটি খাদ্যাভ্যাস জাতীয় সমস্যা তাই রোগীকে প্রথমেই সঠিক খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে পরামর্শ দিতে হবে। তার খাবারের প্রতি যে ভীতি তা দূর করতে হবে।
- প্রাথমিক স্তরেই ব্যবস্থা নেবার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করে পুনরায় খাওয়ানো শুরু করতে হবে যাতে ওজন বাড়ানো যায়। এটি কিশোর ও তরুণদের জন্য প্রযোজ্য।
- দ্বিতীয় উপায় হিসেবে খাদ্যতালিকা বিষয়ক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও তার সাথে সাইকোথেরাপি করানো। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের রোগীকে পুনরায় খাওয়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় ফল খুব ধীরে পাওয়া যায়, কিন্তু ওজন বাড়ার হার বজায় থাকে।
- অ্যানোরেক্সিয়ার জন্য সাইকোথেরাপি পদ্ধতিটি দীর্ঘকালীন ও জটিল হয় এবং জ্ঞানীয় ও আচরনগত থেরাপি এর অন্তর্ভুক্ত থাকে যাতে জ্ঞানীয় পরিকাঠামোতে পরিবর্তনের উপর জোর দেয়া হয় ও তার সাথে সহযোগিতামূলক থেরাপি যোগ করা হয়।
অ্যানোরেক্সিয়ার চিকিৎসা বহুদিন ধরে চলতে পারে, কাজেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া চালিয়ে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে পরিবার ও বন্ধুদের কাছে থেকে সরিয়ে নেবেন না; তাদের সঙ্গ মন ভাল রাখতে সাহায্য করবে।
এছাড়া অসুখটির বিষয়ে পড়াশুনা করলে বুঝতে পারবেন যে- ওজন সংক্রান্ত এই অহেতুক ভয় একটা অসুখ মাত্র। নিজের প্রিয়জনের কথায় বিশ্বাস রেখে চললে খুব শিগগিরই আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।