বাত বা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। ফলে গিরায় গিরায় ব্যথা, লালভাব, ফুলে যাওয়া এবং প্রদাহ হয় রোগীদের। সময়ের ফেরে বাতের ব্যথা কমে-বাড়ে। অদৃশ্য এ রোগ দুর্বিষহ করে দেয় দৈনন্দিন জীবন।
চিকিৎসকরা বলছেন, বাতের চিকিৎসা বেশ দীর্ঘ। সময় সময় ব্যথানাশক কাজ করে না। পরিবর্তিত ওষুধ হিসেবে কখনো কখনো স্টেরয়েড দেন চিকিৎসক। তাতে তাৎক্ষণিক পরিত্রাণও মেলে। ফলে স্বল্প মেয়াদের স্টেরয়েড ইচ্ছেমতো নিতে থাকেন রোগী। আর তাতেই ডেকে আনে চোখের ছানি। বাড়ে অন্ধত্বের ঝুঁকি।
সম্প্রতি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের রিউম্যাটোলজি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ওপর গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। স্টেরয়েড ব্যবহারে অসচেতনতা থেকে এ সংকট বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। এ নিয়ে সচেতন হওয়ারও তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ‘বাতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ছানির প্রাদুর্ভাব, প্রকারভেদ এবং স্টেরয়েড যুক্ত ঝুঁকির কারণ’ শীর্ষক গবেষণাটি করেন চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ছয়জন গবেষক। গত ২০ জুন এশিয়ান জার্নাল অব রিসার্চ অ্যান্ড রিপোর্টস ইন অফথালমোলজিতে এ গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
গবেষকরা বলছেন, সাধারণ বাতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ছানির প্রাদুর্ভাবের কারণ অনুসন্ধান করতে এ গবেষণা চালানো হয়। একই সঙ্গে ছানির ধরন নির্ধারণ, স্টেরয়েড ব্যবহারের সময়কাল এবং ছানির বিকাশের মধ্যে এর সম্পর্ক অনুসন্ধান করেন তারা।
তারা আরও বলছেন, বিশ্বব্যাপী অন্ধত্বের প্রধান কারণ ছানি। বাতজনিত রোগ চোখসহ জয়েন্ট, হাড়, সেরোসা এবং টিস্যুতে প্রভাব ফেলে। বাতজনিত রোগে স্টেরয়েডের ব্যবহার পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি উত্থানে অবদান রাখে। সীমিত পরিসরে গবেষণায় তারা এমনটি পেয়েছেন। আরও বড় পরিসরে অনুসন্ধান প্রয়োজন।
এই গবেষণার আওতায় এসেছে রামেক হাসপাতালের রিউম্যাটলোজি বিভাগে চিকিৎসা নিতে রোগীদের রোগের ইতিহাস, স্টেরয়েড ব্যবহার এবং চোখের ছানির বিকাশ সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহ চলে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত।
গবেষণার আওতায় ছিলেন ৯০ নারী ও ২২ পুরুষসহ মোট ১১২ রোগী। এদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ছিলেন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং ২৫ শতাংশ সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস আক্রান্ত। অন্যরা অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস, সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস ও স্কুলাইটিসসহ বিভিন্ন বাতজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
তথ্য বিশ্লেষণে ২৫ নারী ও ১৮ পুরুষসহ মোট ৪৩ জনের চোখে ছানির বিস্তার পাওয়া যায়। যাদের বয়স ৪০ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে, যা মোট আক্রান্তের ৫২ দশমিক ৭ শতাংশ। আবার পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করেছেন এমন ৩১ জনের ছানির প্রকোপ দেখা গেছে, যা শতকরা হার ৭২ দশমিক ১ শতাংশ।
গবেষকরা জোর দেন, রিউমাটোলজিস্ট এবং চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আন্তঃবিষয়ক সহযোগিতার প্রতি। বাতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা দীর্ঘমেয়াদি স্টেরয়েড থেরাপির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তাদের চোখের পরীক্ষারও তাগিদ দেন। বাতজনিত রোগে চোখের সম্পৃক্ততার অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়াগুলো আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য গভীরভাবে অনুসন্ধানের গুরুত্বারোপ করেন গবেষকরা।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ১১২ জনের ২২৪ চোখ পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে শুষ্ক চোখ পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৪৩টি। যা শতকরা হার ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বাধিক ২৩টি চোখে ইউভাইটিস পাওয়া গেছে; যা শতকরা হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। নমুনার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ চোখে রেটিনোপ্যাথি পাওয়া গেছে। এছাড়া ৭ দশমিক ৩ বা ১৬ চোখে পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি পাওয়া গেছে। রিউম্যাটোলজিক ডিসঅর্ডারগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু চোখের সম্পৃক্ততা প্রদর্শন করেছে।
পরীক্ষায় বাতজনিত ছানি পাওয়া গেছে ৪০ জনের, ১৮ দশমিক ২ শতাংশ। ঘনত্ব অনুযায়ী সেগুলো গ্রেডিং করা হয়েছে। সবচেয়ে ঘন পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার (পিএসসি) ছানি পাওয়া গেছে ১৬ চোখে। নিউক্লিয়ার স্ক্লেরোসিস বা সাধারণ ছানি পাওয়া গেছে ১১ চোখে। ৯টি চোখে পাওয়া গেছে কর্টিকাল ক্যাটারাক্ট। মিশ্র ছানি পাওয়া গেছে ৫টি চোখে।
স্টেরয়েড ব্যবহারের সময়কালের ভিত্তিতে দেখা যায়, ১ বছর কিংবা তার কম সময় স্টেরয়েড ব্যবহারকারীদের পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি তৈরি হয়নি। স্টেরয়েড ব্যবহারের সময়কাল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের ছানিসহ আক্রান্ত চোখের হার বেড়েছে।
১ বছর থেকে ৫ বছর স্টেরয়েড ব্যবহার করেছেন এমন রোগীদের ৭৭ চোখে ছানি পাওয়া গেছে। তবে পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি পাওয়া গেছে ৩টি চোখে। যা মোট আক্রান্তের ২ দশমিক ৭ ভাগ। ৫ থেকে ১০ বছর স্টেরয়েড ব্যবহার করেছেন এমন ৫৯টি চোখে ছানি পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি পাওয়া গেছে ৩টি চোখে। যা মোট আক্রান্তের ৬ দশমিক ৯ ভাগ। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে স্টেরয়েড ব্যবহার করছেন এমন ৭৯টি চোখে ছানি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০টি চোখেই পাওয়া গেছে পোস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ছানি; যা মোট আক্রান্তের ১০ দশমিক ২ শতাংশ। দীর্ঘ মেয়াদে স্টেরয়েড ব্যবহার চোখের ছানির অন্যতম কারণ বলে নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান ডা. মো. ইউসুফ আলী।
হাসপাতালের বহির্বিভাগ ঘুরে চক্ষু বিভাগে (২৫ নম্বর ওয়ার্ড) চিকিৎসা নিতে আসেন সিদ্দিক আলী (৭৫)। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার তারাপুর এলাকার বাসিন্দা এ বৃদ্ধ চোখের ছানি নিয়ে ভর্তি হন ২ সেপ্টেম্বর। বৃদ্ধ জানান, প্রায় এক যুগ ধরে বাতের সমস্যায় ভুগছেন। এলাকায় বিভিন্ন চিকিৎসকের কাছে ওষুধ খেয়েছেন, কিন্তু ব্যথা নিরাময় হয়নি। ওষুধ খেতে খেতে এক পর্যায়ে চোখে কম দেখতে শুরু করেন। রামেক হাসপাতালে এসে জানতে পারেন, ডান চোখে ছানি পড়েছে।
চোখের ছানি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন জেলার বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা আকরাম আলী প্রামাণিক (৬৫)। তিনি জানান, একসময় তিনি হাডুডু-ফুটবল খেলতেন। প্রায় ৩০ বছর আগে আঘাতজনিত কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তার চোখের দৃষ্টি কমতে শুরু করে। পরীক্ষায় ছানি ধরা পড়ে। অপারেশন না করলে পরিত্রাণ নেই।
রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রিম্যাটলোজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. আসিফ হাসান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসারে স্টেরয়েড তিন মাসের বেশি ব্যবহার করা যায় না। এটি মূলত সাময়িক ওষুধ। নিয়মিত ওষুধে কাজ না করলে স্টেরওয়েড দেওয়া হয়। এটি দ্রুত ব্যথা নিরাময় করে। ব্যথানাশকও খেতে হয় না। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন কোন ওষুধের কী কাজ এবং কত দিন সেবন করতে হবে সেটি রোগীদের জানিয়ে দেওয়া। কিন্তু অধিকাংশ চিকিৎসক সেটি করেন না। তাছাড়া ওষুধ বিক্রেতা বা হাতুড়ে চিকিৎসকের কথামতো দীর্ঘদিন স্টেরয়েড সেবন করে থাকেন রোগী। সঙ্গত কারণেই রোগী অসচেতনভাবে এটি দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যান।’
ডা. আসিফ আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন স্টেরয়েড গ্রহণ শরীরে স্বাভাবিক স্টেরয়েড হরমোনের নিঃসরণে ব্যাঘাত ঘটে। একটা সময় রোগী স্টেরয়েড ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, হাড়ক্ষয়, মাংসপেশির দুর্বলতা এবং চোখের ছানি দেখা দেয়। কমে যায় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা। বাড়িয়ে দেয় অন্ধত্বের ঝুঁকি। এ নিয়ে সচেতনতা জরুরি।’
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : বাত রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস চিকিৎসা রোগী
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh