বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস

বাড়ছে আর্থ্রাইটিস রোগী, প্রতিরোধে প্রয়োজন সতর্কতা

বিশ্ব আর্থ্রাইটিস দিবস ২০২৪। গ্রিক শব্দ ‘আর্থো’-এর মানে হলো অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়া এবং ‘আইটিস’ শব্দের মানে প্রদাহ। খুব সাধারণভাবে বলা যায়, আর্থ্রাইটিস হলো অস্থিসন্ধি বা হাড়ের জোড়ার প্রদাহ। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘Informed Choices, Better Outcomes’। এর মূল লক্ষ্য হলো আর্থ্রাইটিস রোগীদের সঠিক তথ্য পাওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরা, যেন তারা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের সঙ্গে মিলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়া উন্নত করা যায়।

এই প্রতিপাদ্য রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ পরামর্শ এবং সঠিক তথ্যের ওপর জোর দেয়, যা রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশেও দিবসটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো পালিত হয়েছে। আর রিউমাটয়েট আর্থ্রাইটিস, স্পনডাইলো আর্থ্রাইটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিসসহ ১২০টি বড় ধরনের রোগসহ প্রায় সাতশ রোগের সমন্বয় হলো আর্থ্রাইটিস।

বাংলাদেশের ২৬ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের আর্থ্রাইটিস বা বাত–ব্যথায় ভুগছেন। তাদের মধ্যে ২৪ শতাংশের কর্মক্ষমতা কম। আর্থ্রাইটিসে আক্রান্তের জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা থাকে এবং এ ব্যথা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। হাত–পায়ের ছোট ছোট জোড়া বেশি আক্রান্ত হয়। প্রায়ই সমানভাবে দুই পাশের অর্থাৎ ডান ও বাম দিকের জোড়াগুলোতে ব্যথা হয়। অনেক সময় ঘাড়েও ব্যথা হতে পারে। এ রোগের ব্যথা কাজ করলে কমে, বিশ্রাম নিলে বেড়ে যায়। 

জানা গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ‘ওয়ার্ল্ড আর্থ্রাইটিস ডে’ দিবসটি ‘আর্থ্রাইটিস অ্যান্ড রিউমেটিজম ইন্টারন্যাশনাল’ এর তত্ত্বাবধানে উদযাপিত হয়ে আসছে। আর্থ্রাইটিস সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো টেনিস এলবো ও কনুই সমস্যা। জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধির ব্যথার মূল কারণ এর প্রদাহ। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিশ্বব্যাপী আর্থ্রাইটিস আক্রান্তের সংখ্যা কম নয়। টেনিস এলবো একটি ইনজুরি জাতীয় সমস্যা। টেনিস খেলোয়াড়দের এ সমস্যা বেশি দেখা দেয় বলে একে টেনিস এলবো বলা হয়। ক্রিকেট, গলফ, ব্যাডমিন্টন, ভলিবল ও তীর নিক্ষেপ ইত্যাদি খেলায় ভুল টেকনিকের কারণে এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সমস্যার শুরুতে হাতের কনুইয়ের বাইরের দিকে ব্যথা অনুভূত হয়। হাতের নড়াচড়া বা কাজকর্মে ব্যথা তীব্র হতে পারে।

দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চলতে থাকলে মাংশপেশির শক্তি ও হাতের কর্মদক্ষতা কমে আসে।আর আর্থ্রাইটিসে আক্রান্তের জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা থাকে এবং এই ব্যথা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। হাত ও পায়ের ছোট জোড়াগুলো বেশি আক্রান্ত হয়। প্রায়ই সমানভাবে দুই পাশের অর্থাৎ ডান ও বাম দিকের জোড়াগুলোতে ব্যথা হয়। অনেক সময় ঘাড়েও ব্যথা হতে পারে। এ রোগের ব্যথা কাজ করলে কমে; কিন্তু বিশ্রাম নিলে বেড়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় ব্যথা বেশি অনুভূত হয়। বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা আস্তে আস্তে কমে। 

আর্থ্রাইটিসের প্রকারভেদ

অস্টিওআর্থ্রাইটিস: এটি সাধারণ ধরনের আর্থ্রাইটিস, যা সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হয়। এটি অস্থিসন্ধির কার্টিলেজের বা নরম হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগ, যা হাড়ের মধ্যে ঘষাঘষি তৈরি করে এবং ব্যথা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজেই অস্থিসন্ধির টিস্যুকে আক্রমণ করে এবং সন্ধিতে ব্যথা, ফোলা, এবং কার্যক্ষমতা হ্রাস ঘটায়।

গাউট: এটি একটি প্রদাহজনিত আর্থ্রাইটিসের ধরন, যেখানে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের স্তর বেশি হয়ে যায় এবং সন্ধিতে ক্রিস্টাল জমে যায়, যাতে আকস্মিক ব্যথা ও ফোলাভাব হয়।

সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস: এটি সোরিয়াসিসের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সন্ধিতে প্রদাহ ও ব্যথা সৃষ্টি করে।

বাতরোগ যখন হয়
এ রোগে সাধারণত ৪০-৫০ বছর বয়সি মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়। পুরুষের আক্রান্ত হওয়ার হার নারীর তুলনায় অনেক বেশি। নারীদের এ রোগ সাধারণত মেনোপজের পর বেশি হয়ে থাকে। শিশু ও তরুণদের সাধারণত এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায় না।

বাতরোগ যেভাবে হয়ে থাকে
মূত্রের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ইউরিক অ্যাসিড প্রতিদিন আমাদের শরীর থেকে বের হয়ে যায়। অন্যদিকে মানবদেহের যকৃৎ যখন তার পরিমাণ থেকে বেশিমাত্রায় ইউরিক অ্যাসিড তৈরি করে ফেলে এবং তা রক্তে পরিমাণে নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেড়ে যায় ও বের হতে পারে না, তখন বাতরোগের উৎপত্তি হয়।

খাবারের উৎস 
খাবার থেকে ইউরিক অ্যাসিড উৎসের মধ্যে লাল মাংস, ক্রিম ও রেড ওয়াইন অন্যতম। কিডনি রক্ত থেকে স্বাভাবিক মাত্রার ইউরিক অ্যাসিড ফিল্টার করে বের করতে না পারলে বাতরোগের উপসর্গ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে ইউরিক অ্যাসিড বিভিন্ন জয়েন্টে ক্রিস্টালরূপে জমা হতে থাকে। ফলে জয়েন্টগুলো ফুলে যায়, জয়েন্টে প্রদাহ তৈরি হয় এবং ব্যথার সৃষ্টি করে। এতে জয়েন্টগুলো ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে যায়।

বাতরোগের কারণ
বিভিন্ন জয়েন্টে ইউরিক অ্যাসিড জমার কারণেই বাতরোগ হয়ে থাকে। শতকরা ২০-২৫ ভাগ বাতের রোগে আক্রান্তদের পারিবারিক ইতিহাস পাওয়া যায়। যেসব কারণে বাতরোগের ঝুঁকি বাড়ে- এর মধ্যে ডায়াবেটিস, কিডনির রোগ, অতিরিক্ত ওজন সিকল সেল অ্যানিমিয়া উল্লেখযোগ্য। নিয়মিত অ্যালকোহল পান করলে বাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ধরনের ওষুধ- অ্যাসপিরিন, ডাই-ইউরেটিকস, লিভোডোপাজাতীয় ওষুধ বাতের ঝুঁকি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

বাতরোগের চিকিৎসা
বাতরোগের চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হলো ইউরিক অ্যাসিড উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা এবং অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড শরীর থেকে বের করা। এর পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত জয়েন্টগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। এজন্য একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি  কনসালট্যান্ট আপনাকে সঠিক মাত্রার ওষুধ  চিকিৎসার মাধ্যমে আপনাকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিতে সহায়তা করবে।

আর্থ্রাইটিস রোগীরা যা যেসব খাবেন
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার: দুধ, দই ও পনির; অর্থাৎ দুধজাত খাবারে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি থাকে। এগুলো হাড় শক্তিশালী করে।

মাছ: রুই, টুনা ও স্যামন মাছে রয়েছে প্রদাহনাশক ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সপ্তাহে অন্তত ২ দিন ৮৫ থেকে ১১৩ গ্রাম এ ধরনের মাছ খাওয়া প্রয়োজন।

সয়াবিন: সয়াবিনেও রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা প্রদাহ কমায়। তা ছাড়া সয়াবিনে রয়েছে লো ফ্যাট, উচ্চমানের প্রোটিন ও ফাইবার।

বাদাম: ড্রাই ফ্রুট; অর্থাৎ আখরোট, পেস্তা ও কাঠবাদাম—এসবে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিংক, ভিটামিন ই ও ফাইবার। অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও আর্থ্রাইটিস—উভয়ের জন্যই এসব বাদাম বেশ উপকারী।

শিমের বীজ: শিমের বীজে রয়েছে প্রোটিন, লৌহ, জিংক ও পটাশিয়াম। বাতের কারণে ফোলাভাব কমাতে এটি খুবই ভালো কাজ করে।

লেবুজাতীয় ফল: কমলালেবু, পাতিলেবু, মুসম্বি ও আঙুরে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি। অস্টিওআর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিয়মিত এসব ফল খেলে ব্যথা-যন্ত্রণা থেকে অনেকটাই মুক্তি পান। হাড়ের ক্ষতি অনেকটাই কম হয়।

গ্রিন টি: পলিফেনল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ গ্রিন টি। এটি ব্যথা কমায় ও তরুণাস্থির ক্ষতির মাত্রা কমায়। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে হাড়কে সুরক্ষা দেয়।

ব্রকলি: ব্রকলি অনেক রোগের ক্ষেত্রে খুব ভালো একটি খাবার। উচ্চমানের ভিটামিন রয়েছে এতে। এর মধ্যে সালফোরেফেন নামের একটি উপাদান আছে, যা অস্টিওআর্থ্রাইটিস হওয়ার আশঙ্কা কমায় বলে বিশেষজ্ঞদের মত।

আর্থ্রাইটিস রোগীরা যা যেসব খাবেন না
টমেটো: টমেটোতে রয়েছে ইউরিক অ্যাসিড। এই অ্যাসিড হাড়ের জোড় বা জয়েন্টে জমা হয়, যা আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বাড়ায়।

লাল মাংস: আর্থ্রাইটিসে ফসফরাসসমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। যেমন লাল মাংস (গরু, খাসি)। এতে শরীরে অতিরিক্ত ফসফরাস জমা হয় এবং ক্যালসিয়াম হারিয়ে যায়।

চিনি: হাড়ের জোড়ে ব্যথা থাকলে চিনি খাওয়া ক্ষতিকর। এতে ওজন বাড়ে ও জয়েন্টে চাপ পড়ে।

কফি: কফি শরীরকে পানিশূন্য করে তোলে। এটি আর্থ্রাইটিসের ব্যথা বাড়ায়।

মদ্যপান: অ্যালকোহল হাড়কে ভঙ্গুর করে দেয়। তাই হাড় সুস্থ রাখতে ও আর্থ্রাইটিসের সমস্যা কমাতে মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।

এছাড়া বেগুন, লাল মরিচ, আলু এগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যালকালোয়েডস। এগুলো প্রদাহ তৈরি করে। তাই হাড়ের জোড়ে ব্যথা থাকলে এগুলো খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিন।

হোমিও প্রতিকার
রোগ জনিত আর্থ্রাইটিস সর্বাধিক কার্যকর চিকিৎসা নিশ্চিত করছে হোমিওপ্যাথি। পৃথিবীতে হোমিওপ্যাথি ছাড়া অন্য সকল চিকিৎসা শাস্ত্র উপরি উপরি চিন্তা করে চিকিৎসা কার্য্য সম্পাদন করে থাকে যার কারণে মূল থেকে রোগ নির্মূলে ব্যর্থ হয় তারা। তাছাড়া হোমিওপ্যাথি ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসা শাস্ত্রে বহু দুরারোগ্য বা ক্রনিক রোগের চিকিৎসাই নেই। একমাত্র হোমিওপ্যাথি রোগের বাস্তব কারণ অনুসন্ধান করে মূল থেকে যেকোন দুরারোগ্য রোগ নির্মূলের চিকিৎসা দিয়ে থাকে। আর এই কারণেই মারাত্মক রোগ ব্যাধির সবচেয়ে কার্যকর এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করছে হোমিওপ্যাথি। তবে এর জন্য অবশ্যই এক্সপার্ট কোনো হোমিও চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে চিকিৎসা নেয়া জরুরি। রোগীর লক্ষণের ওপর নির্ভর  করে আর্থ্রাইটিস রোগ নিরাময় করতে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক প্রাথমিকভাবে যেই সব মেডিসিন নির্বাচন করে থাকে,ব্রায়োনিয়া এলবা, লিডাম পল, রাস টক্স,কলচিকাম,ক্যালমিয়া ল্যাট,গুয়েকাম,ক্যালকেরিয়া কার্ব,বেনজয়িক এসিড, হাইপেরিকাম সহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের ওপর আসতে পারে তবে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধই গ্রহণ করা উচিত নয়। 

প্রতিরোধ
এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এজন্য হোমিওপ্যাথি  চিকিৎসার ছাড়াও রোগীকে প্রচুর পানি পান করতে হবে। সুষম খাবার খাওয়ার পাশাপাশি শরীরের সঠিক ওজন বজায় রাখতে হবে। নিয়মিত হাঁটা বা শারীরিক ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে। যেসব খাবার ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, তা এড়িয়ে চলতে হবে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh