হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়ার সমস্যা ও প্রতিকার

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ১৪:৫৫

বেলস পালসি বা মুখের পক্ষাঘাত। ছবি : প্রতীকী ছবি
হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়া এক ধরনের স্নায়বিক সমস্যা বা স্নায়ুরোগ, যা ফেসিয়াল পালসি বা মুখের পক্ষাঘাত (ফেসিয়াল প্যারালাইসিস) নামে পরিচিত। অনেক ক্ষেত্রে একে বেলস পালসিও বলা হয়। আমাদের শরীরে মোট ১২ জোড়া করোটিকা স্নায়ু থাকে, যার ৭ নম্বর স্নায়ু জোড়ার নাম মুখের স্নায়ু বা ফেসিয়াল নার্ভ। এই স্নায়ু অবশ হলেই তাকে ফেসিয়াল পালসি বলে।
রোগটির নাম বেলস পালসি। যদিও ফেসিয়াল প্যারালাইসিসের সঙ্গে শীতের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এ রোগের একটি রিস্ক ফ্যাক্টর হলো শ্বাসনালির ঠান্ডাজনিত ভাইরাল ইনফেকশন এবং ঠান্ডা লেগে কানের ইনফেকশন, যা শীতের সময় বেশি দেখা যায়। শীতে ফেসিয়াল প্যারালাইসিসের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এটি এমন একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে মুখের একপাশের পেশিগুলো হঠাৎ অবশ হয়ে যায়। সপ্তম ক্রেনিয়াল নার্ভ যে কোনো কারণে আক্রান্ত হওয়ায় ফেসিয়াল মাসলের একপাশে দুর্বল অথবা প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়াকে ফেসিয়াল পালসি বলা হয়। যখন সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায় না তখন একে বলা হয় বেলস পালসি। এটি যে কোনো বয়সের মহিলা ও পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। তবে পুরুষের তুলনায় মহিলাদের এ রোগটি বেশি দেখা যায়।
হঠাৎ মুখ বেঁকে যাওয়ার কারণ
ফেসিয়াল প্যারালাইসিসের মূল কারণ এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে এটি ভাইরাল সংক্রমণের কারণে হতে পারে, যেমন হারপিস সিমপ্লেক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ বিভিন্নরকম ভাইরাল ইনফেকশন, মধ্যকর্ণের প্রদাহজনিত ইনফেকশন, ঠান্ডাজনিত কারণে (শীতের সময় মোটরসাইকেল চালানো, শীতের মধ্যে পানিতে নেমে সারা রাত মাছ ধরা, শীতে খেলাধুলার পর অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পান করা, শীতে দীর্ঘ ভ্রমণ যাত্রা, ইত্যাদি), মস্তিষ্কে অথবা মাথার খুলিতে আঘাতজনিত কারণ, কানের অপারেশন পরবর্তী জটিলতা।
বেলস পালসি রোগের লক্ষণ
- আক্রান্ত রোগীর মুখ এক দিকে বেঁকে যায়।
- আক্রান্ত পাশের চোখ বন্ধ হয় না, আক্রান্ত পাশের চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
- দাঁত দেখাতে গেলে মুখ বেঁকে যায়।
- কোনো কিছু খেতে গেলে খাবার একপাশে চলে যায়। খাবার মুখের ভেতরের আক্রান্ত অংশে জমা হয়ে থাকে।
- খাবারের স্বাদ কমে যায় বা অনুভব হয় না।
- কপাল ভাঁজ করতে পারে না।
- হঠাৎ উচ্চমাত্রায় আওয়াজ শুনতে পাওয়া।
চিকিৎসা
লক্ষণ দেখা দিলে যত দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন, ততই ভালো। কেননা, স্টেরয়েড বা অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শুরু করলেই সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়। এ ছাড়া চিকিৎসক বিশেষ ধরনের ব্যায়াম শিখিয়ে দেবেন, যা দিনে কয়েকবার করতে হবে। এ সময় চোখের বিশেষ যত্ন নিতে হবে। যেহেতু চোখ সহজে বন্ধ হয় না, তাই তা শুষ্ক হয়ে যায়। চোখের ড্রপ ব্যবহার ছাড়াও রাতে ঘুমানোর সময় বিশেষ প্যাচ ব্যবহার করে চোখ বন্ধ রাখা হয়। খাবার খেতে সমস্যা হলে ধীরে ধীরে তরল বা আধা তরল খাবার খেতে হবে। বেশিভাগ ক্ষেত্রে বেলস পালসি কয়েকদিন বা কয়েক মাসের মধ্যেই সেরে যায়। কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে। বেলস পালসি গুরুতর গোছের কোনো রোগ নয়, তবে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত নিকটস্থ নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ অথবা নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হবেন। প্রয়োজন হলে পাশাপাশি ফিজিওথেরাপিও নেওয়া লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর অবস্থা বুঝে প্রয়োজনীয় ফিজিওথেরাপি দিয়ে থাকেন।
শীতে চাই বাড়তি সতর্কতা
শীতের আমেজ উপভোগ করুন। তার সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক থাকুন যেন এ রোগে আক্রান্ত না হয়ে পড়েন। মাথা ঢাকার ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা উদাসীন থাকি। মাথা, নাক, মুখ, কান উপযুক্ত শীতের কাপড় দিয়ে ঢেকে চলুন। যতই বিদঘুটে লাগুক না কেন শীতে টুপি, মাফলার, মাস্ক পরা ছাড়বেন না। বাইরে গেলে খেয়াল রাখতে হবে কান দিয়ে যাতে বাতাস যেন না ঢুকে। রাতের শেষদিকে ঠান্ডা লাগার আশঙ্কা আছে তাই ঘুমানোর সময় এ ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
লেখক: ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী, নাক-কান-গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড-নেক সার্জন, রেজিস্ট্রার, নাক-কান-গলা বিভাগ; সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।