Logo
×

Follow Us

সাক্ষাৎকার

শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়লেও তরুণেরা চাকরি পাচ্ছেন না

Icon

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৫২

শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়লেও তরুণেরা চাকরি পাচ্ছেন না

রাশেদা কে চৌধূরী। ছবি: সংগৃহীত

রাশেদা কে চৌধূরী। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। বর্তমান শিক্ষার সার্বিক অবস্থা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম ডি হোসাইন।

শিক্ষা নিয়ে এত সমালোচনা ও দুরবস্থা কেন? 

সমালোচনা নয়, বর্তমান শিক্ষাক্রম নিয়ে অপপ্রচার শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে হেফাজতে ইসলাম পাঠ্যপুস্তক নিয়ে যেসব দাবি তুলেছিল, এবারও একটি গোষ্ঠী প্রায় একই দাবি তুলেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা নানা বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চালিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুটি বই প্রত্যাহার করে সরকার আত্মসমর্পণ করল। আমি খুবই উদ্বিগ্ন।

মনে হয়, আমরা স্রোতের উল্টো দিকে যাচ্ছি। নতুন শিক্ষাক্রমের কিছু বইতে তথ্যগত বিভ্রান্তি রয়েছে। বেশ কিছু ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে। এজন্য আমাদের লেখকরা ক্ষমাও চেয়েছেন। বইগুলো এ বছর পরীক্ষামূলক বই হিসেবেই চলছে। কিন্তু দুটি বই প্রত্যাহার করায় আমরা যারা নতুন শিক্ষাক্রমকে স্বাগত জানিয়েছিলাম তারা হতাশ হয়েছি।

এছাড়া শিক্ষা দুরবস্থায় আছে, সে কথা আমি বলব না। বাংলাদেশে শিক্ষায় সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এর প্রতি সর্বস্তরের মানুষের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। একজন বিত্তহীন থেকে উচ্চবিত্তের মানুষ, সবাই বলবেন, আমি আমার সন্তানকে অবশ্যই লেখাপড়া করাতে চাই। প্রতিবেশী ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে কৃষকেরা বলেন, সন্তানকে লেখাপড়া করিয়ে কী লাভ? বাংলাদেশে কিন্তু এ কথাটি এখন কেউ বলে না। আরেকটি অর্জন হলো নারীশিক্ষার ব্যাপক বিস্তার। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিটি সরকারই মেয়েদের শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে, যার ফল এখন আমরা ঘরে তুলছি। 

বৃত্তি পরীক্ষার ফল বাতিল হওয়াকে কীভাবে দেখছেন? 

প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষা নিয়ে আমরা শুরুতেই আপত্তি তুলেছিলাম। ২৯ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এ ব্যাপারে বিবৃতিও দিয়েছিলেন। কারণ এই পরীক্ষা নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এরপর একবার বৃত্তির ফল দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্থগিত করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনাস্থার মধ্যে ফেলা হলো। এতে সবার মধ্যেই অনাস্থা তৈরি হয়েছে। 

নতুন শিক্ষাক্রম কীভাবে কার্যকর হবে? 

আমি মনে করি, সরকার ভোটের চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর নজর দেবে। দক্ষতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প নেই। নতুন শিক্ষাক্রম কার্যকর করতে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন শিক্ষকদের সক্ষমতা বাড়ানো। এই জায়গায় জোর দিতে হবে। মনিটরিং বাড়াতে হবে। আর কিছু শিক্ষার্থীকে বৃত্তি না দিয়ে উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। মিড-ডে মিল কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষায় আরও বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। 

আপনি বলছেন, শিক্ষার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু যে শিক্ষা রাষ্ট্র দিচ্ছে, সেই শিক্ষা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারছে কি? 

এটাই আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে, অন্যদিকে শিক্ষিত তরুণেরা চাকরি পাচ্ছেন না। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২২ লাখ তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। কিন্তু আমরা তাদের সবাইকে কাজ দিতে পারি না। এখানেই হতাশা। আবার সরকারি যে শিক্ষাব্যবস্থা, তার প্রতি ভরসা রাখতে পারছেন না বলে অনেকে অন্য ধরনের শিক্ষার প্রতি ঝুঁকছেন। কোচিং-বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। শিক্ষা ক্রমাগত পণ্যে পরিণত হচ্ছে। রাষ্ট্র লাগাম টেনে ধরতে পারছে না। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেই। 

২০১০ সালে সরকার ঢাকঢোল পিটিয়ে যে শিক্ষানীতি চালু করেছিল, তা বাস্তবায়িত হলো না কেন? 

স্বাধীনতার পর অনেক দিন আমরা পূর্ণাঙ্গ কোনো শিক্ষানীতি পাইনি। ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষানীতি প্রণীত হলেও সেটি বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীকালের সব শিক্ষানীতি ছিল খণ্ডিত। কিন্তু ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের কথা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা ছিল। এই শিক্ষানীতিতে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন ও একটি সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রণয়নের কথাও বলা ছিল। কিন্তু এর কোনোটাই কার্যকর হয়নি। শিক্ষা আইন খসড়া পর্যায়েই রয়ে গেছে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা সম্ভব। কিন্তু সেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হয়নি। 

কেন বাস্তবায়িত হলো না? 

আমার ধারণা, শিক্ষাকে এখনো খণ্ডিত আকারে দেখা হয়। নীতিনির্ধারণের জায়গা থেকে শিক্ষানীতিকে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতি হিসেবে দেখা হয় না। ফলে যা হয়েছে খণ্ডিত, বিক্ষিপ্ত। প্রাথমিক স্তরে সরকারের একধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সবকিছু চলছে খণ্ডিতভাবে। প্রকল্পের ভিত্তিতে। এছাড়া অনেক সময় ধরে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে ২০১০ সালে যুগোপযোগী একটি শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়। এতে পরীক্ষা-পদ্ধতির সংস্কার, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন প্রভৃতি সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সরকার তাতে মনোনিবেশ করেনি। 

কোভিড-পরবর্তী বিশ্ব ব্লেন্ডেড লার্নিং ও পরীক্ষা-পদ্ধতি থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে। আমাদের সরকারও শিক্ষাক্রম সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। আমি বলব, মোটামুটি অগ্রসরতামুখী ও যুগের চাহিদার সঙ্গে মিল রেখে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষা-পদ্ধতি থেকে বের হয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ও পারস্পরিক সমঝোতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার প্রস্তাব ছিল। গত আট বছরেও তা কেন হলো না? 

বড় একটা ফাঁক তো থেকেই গেল। আমাদের শিক্ষাটা এখন জ্ঞানকেন্দ্রিক না হয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার আগে অনেক বেশি পাবলিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত পাবলিক পরীক্ষা নেই। বরং শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। 

শিশুদের পুষ্টি ঘাটতি দূর করতে কী করা দরকার? 

দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য স্কুলে ‘মিড-ডে মিল’ নামে পরিচিত দুপুরের খাবারের কর্মসূচিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, সেই কার্যক্রম এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের মধ্যে দুপুরের খাবার কর্মসূচি সর্বজনীন করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে যে এটা বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা খুব কঠিন। আমরা যদি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সঙ্গে বাস্তবায়ন করি, তাহলে কেন কঠিন হবে, তা বোধগম্য নয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫