বাজেটে মধ্যবিত্তের জন্য কিছু নেই: আহসান এইচ মনসুর

আরিফুল ইসলাম আদীব
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৩, ১৬:৩০

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। ফাইল ছবি
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, শোচনীয় আর্থিক খাত, বেকারত্বের হাহাকার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এরকম নানা সংকট ও শঙ্কার মধ্যেই উন্নয়নের অজস্র প্রতিশ্রুতি নিয়ে ১ জুন জাতীয় সংসদে বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ঠিক করা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। সরকার এই বাজেটকে স্মার্ট ও জনবান্ধব বললেও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন কল্পবিলাসী ও অবাস্তব। বাজেটের নানা বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরিফুল ইসলাম আদীব।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ কী কী?
আহসান এইচ মনসুর: পুরো অর্থনীতি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির ব্যাপক চাপ আছে, তারল্য সংকট আছে, ডলার সংকট আছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ যেমন হওয়া উচিত সেরকম হচ্ছে না। রপ্তানি প্রবাহ আরএমজি কন্টেক্সে বিশ্ব পরিস্থিতিতে মোটামুটি ঠিক আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত নয়। এরকম পরিস্থিতিতে যে বাজেট প্রণয়ন করা হলো এটা বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ। গ্লোবাল ইকোনমিতে পণ্যের দাম কমে আসছে, জ্বালানি তেলের দাম ডলারে কমেছে। সেটা ইতিবাচক, কিন্তু এটার প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে নেই। কারণ আমাদের ডলার সংকট চরমে। পণ্য আমদানি করতে পারছি না, গ্যাসের দামও আগের মতোই রয়েছে। ডলার সংকট গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময়ে সরকারের যে বাজেট তা বাস্তবসম্মত নয়। সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়বে, ব্যক্তি বিনিয়োগ চার শতাংশ বাড়বে, ব্যয় কিছুটা সংযত করবে কিন্তু বড় ধরনের কোনো কাটছাঁট নেই। সরকার যে বাজেট বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে আমরা সেখানে দেখতে পাচ্ছি বেশ বড় বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটা চ্যালেঞ্জ ট্র্যাডিশনাল, রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ঘাটতি থাকে এবং এবারও থাকবে----এটা রাতারাতি যাবে না আইএমএফ প্রোগ্রাম থাকলেও। আইএমএফকে সরকার যেটা বলছিল পারবে, কার্যত সেটা পারবে না।
আমরা যদি অন্য দিকে তাকাই বাজেটে অর্থায়ন ঘাটতি। বাজেটে যে ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি যা মোট জিডিপির ৫.২ শতাংশ অন্যান্য বছরের মতোই আছে। কিন্তু আমরা কি এবার ৫ শতাংশ ফাইন্যান্স করার মতো সক্ষমতায় আছি? আমাদের সক্ষমতা নেই। এখানে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সরকার বলছে বিদেশ থেকে এক লক্ষ কোটি টাকা আনবে। এক লক্ষ কোটি টাকা মানে ১০ বিলিয়ন ডলার। এটা আনতে সুদ হিসেবে করে আমাদের মূলত ১২ বিলিয়ন ডলার আনতে হবে। এটা বিশাল পরিমাণ যা বাংলাদেশের জন্য কঠিন, যদি পারি ভালো কথা। না হলে বড় সমস্যা হবে।
ব্যাংকের তারল্য সংকটও বড় চ্যালেঞ্জ। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে দেড় লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ, ব্যাংক থেকেই করুক আর সঞ্চয়পত্র থেকে করুক। টাকাটা ব্যাংকে থাকতে হবে কিন্তু ব্যাংকের অবস্থা হচ্ছে শোচনীয়। ব্যাংকের লিকুইডিটি লাস্ট কোয়ার্টারে মাত্র ৬.৪ শতাংশ; যা এত কম যে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কাজেই এ চাহিদার জন্য সরকারকে যেতে হবে সেন্ট্রাল ব্যাংকে। যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। ফলে সরকার যেভাবে বাজেটে অর্থায়ন করুক না কেন এটা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে।
বাজেটে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য কী আছে?
আহসান এইচ মনসুর: বাজেটে সরাসরি নিম্নবিত্তের জন্য কিছু নেই, মধ্যবিত্তের জন্যও কিছু নেই। তবে গরিবদের জন্য কিছু আছে। এখানে সরকার সামাজিক কার্যক্রমের জন্য টাকার এলোকেশন কিছুটা বাড়িয়েছে। ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা, সেই সঙ্গে আরও ৬০-৭০ হাজার মানুষকে যুক্ত করা হয়েছে যারা বার্ধক্য ভাতা পাবেন। টিসিবি পণ্য চলমান থাকবে, সেখানে চাল ঢোকানো হয়েছে। এই প্রোগ্রামগুলো চালিয়ে যাক সরকার, সঙ্গে ভিজিডি কার্ড কার্যকর করুক। এর বাইরে আর কোনো সক্ষমতা নেই বাজেটে।
মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন নাজেহাল। এই বাজেটে মুক্তির আশ্বাস কী আছে?
আহসান এইচ মনসুর: এই বাজেটটি প্রবৃদ্ধির দিকে ফোকাস না রেখে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে ফোকাস রাখা উচিত ছিল। মূল্যস্ফীতি দ্রুতই কমে যাবে সে ব্যাপারে আমরা আশান্বিত হতে পারছি না। বরং বাজার অস্থিতিশীল থাকবে আরও। বিশ্ববাজারে পণ্যর দাম কমলেও আমাদের কমবে না। সরকারের অনাদায়ী অনেক ঋণ রয়েছে। ফলে যতক্ষণ পর্যন্ত রিজার্ভ পতন কমাতে পারবে না, বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে না।
বাজেটে বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে কি?
আহসান এইচ মনসুর: বাজেটে আশা করছে বিনিয়োগ বাড়বে। সেই আশা কিন্তু বাস্তবসম্মত নয়, সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিনিয়োগের অনুকূলে নয়। বাজেটে ধরা হয়েছে ব্যক্তি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়বে ২৩-২৭ শতাংশ। একবারে চার শতাংশ বাড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমাদের সরকারকে চেষ্টা করতে হবে কম খরচে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। প্রবাসীদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিদেশে যাওয়ার খরচ কম, আমাদের এখানে খরচ অনেক বেশি। এটা কমাতে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
আয়কর রিটার্ন জমা দিলে দুই হাজার টাকা কর দিতে হবে, না হলে নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আহসান এইচ মনসুর: ইনকাম থাকলেই টিন করতে পারে। কিন্তু সরকার বলছে টিন হলেই আয়কর সর্বনিম্ন ২০০০ টাকা দিতে হবে। আমার জানা মতে এটা পৃথিবীর কোথাও নেই। এটা কনসেপ্ট আছে কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না, কারণ এটা এক ধরনের শোষণ, গরিবদের ওপর অবিচার। এখান থেকে তেমন কোনো রেভিনিউ আসবে না। সেবা দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেওয়া নাগরিকের অধিকার। এটা খর্ব করা উচিত নয়।