শুধু ভিসানীতিতে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হবে না: সাহাব এনাম খান

অনিন্দ্য আরিফ
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:৩০

সাহাব এনাম খান। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
সাহাব এনাম খান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নিরাপত্তানীতি, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং মিয়ানমারের শরণার্থী সমস্যা, জঙ্গিবাদ মোকাবিলা, ইন্দো-প্যাসিফিক জোনের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্সসহ আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের একজন জ্যেষ্ঠ পরামর্শক হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতাপূর্ণ অবস্থান এবং সংলাপের বিষয়ে কাজ করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং এর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে তিনি সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে আলাপ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনিন্দ্য আরিফ...
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন বাইডেন প্রশাসন চাইছে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়। এ ব্যাপারে যারা বাধাদান করবেন, তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার তালিকা তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে। আপনি এ ভিসা নিষেধাজ্ঞাকে কীভাবে দেখছেন?
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করার ঘোষণা এসেছে। ঘোষিতভাবে এ পদক্ষেপ বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন ভিসানীতির ধারাবাহিকতারই অংশ। এই নীতি মূলত প্রযোজ্য হবে গণতান্ত্রিক এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য সরকার তো অঙ্গীকার করেছে। এই নীতি তার সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ এই নীতি জাতীয় নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করার সঙ্গেই মানানসই।
তাই একে খুব নেতিবাচকভাবে দেখার কারণ নেই। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তাদের নিজস্ব স্বার্থ এবং অভ্যন্তরীণ নীতির ওপর নির্ভর করে। এখানে বাংলাদেশের কিছু করার নেই। এটা প্রথম বিষয়। দ্বিতীয়ত এই নিষেধাজ্ঞা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের ওপর নয়। এখানে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু করার নেই। মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। তাই এখানে কয়েকটি কাজ করার আছে-এক. সরকারকে একটু নমনীয় আচরণ প্রদর্শন করতে হবে। দুই. রাজনৈতিক দলগুলোকেও আস্থাহীনতা দূর করার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর বাইরে আসলে করার কিছু নেই।
সেক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর আর কী কী করণীয় আছে?
নির্বাচনে যেন সহিংসতা বা অযাচিত হস্তক্ষেপ ঘটতে না পারে, সেজন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা আরও বাড়ানোর ব্যাপারে আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। এই নীতি উভয় দেশকে গঠনমূলকভাবে জড়িত থাকার মাধ্যমে আরও ভালো সহযোগিতার সুযোগ এনে দেবে। যুক্তিসঙ্গত মতপার্থক্য থাকলে সরকার যে কোনো সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।
অন্য অনেক পশ্চিমা দেশও সম্ভবত (যুক্তরাষ্ট্রের মতো) একই পদক্ষেপ অনুসরণ করবে। তাই আমি বিশ্বাস করি, সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আরও বেশি সম্পৃক্ত থাকবে। সেটা থাকা গেলে হয়তো এ ধরনের বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়বে না অথবা অন্যান্য দেশ নিষেধাজ্ঞার মতো ক্ষতিকারক পদক্ষেপ নেবে না।
সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায় কেবল সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের ওপরই বর্তায় না। এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল ও নেতাকর্মীরও সমান দায়দায়িত্ব রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো কোনো ধরনের সহিংসতায় না জড়িয়ে বিভিন্ন রকম পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতি এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই ভিসানীতির কোনো প্রভাব পড়তে পারে কি?
অবশ্যই এই ভিসানীতির প্রভাব রয়েছে। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ে গভীর সম্পর্ক। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে আমরা তাদের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে একটি স্থায়িত্বের জায়গায় নেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তা অব্যাহত রাখা জরুরি। সামাজিক আর্থিকীকরণ, সামাজিক প্রযুক্তির মতো বিষয়গুলোতে তাদের প্রয়োজন। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র যদি জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরও হার্ডলাইনে যায়, তাহলে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে এটা বলা ঠিক হবে না যে, শুধু ভিসানীতির কারণে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যাবে। তাই বাংলাদেশের জাতীয় এবং ভূরাজনৈতিক স্বার্থেই এখানকার রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত আগামী নির্বাচনকে ঘিরে একটি ফলপ্রসূ সমঝোতায় পৌঁছানো। কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের নির্বাচন কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হবে, রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচনের বিষয়ে কীভাবে প্রস্তুতি নেবে, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে কেবল জনগণের। তারাই এই সিদ্ধান্ত নেবে। আর মার্কিন ভিসানীতি কেবল অল্প কয়েকজনের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে, বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর নয়। তাই এই ভিসানীতির একটা রাজনৈতিক প্রভাব থাকলেও মাস্ ইলেকটরাল ইমপ্লিকেশন খুব একটা নেই।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা ৪১৭ জনের একটি তালিকা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এই তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হচ্ছে না। অনেক বিশেষজ্ঞ মত দিচ্ছেন যে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত ‘রাইট টু ইনফরমেশন’-এর আওতায় এই তালিকা প্রকাশ করা উচিত...
আমার মতে, এই তালিকার কোনো ভিত্তি নেই। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম ‘রাইট টু ইনফরমেশন’ বলে কোনো অ্যাক্ট আছে কি না, তা আমার জানা নেই। সেখানে ভিসা প্রাইভেসির বিষয়ে কোনো অনুচ্ছেদ আছে কি না, তাও আমার জানা নেই। যদি আসলেই যুক্তরাষ্ট্র এরকম একটি তালিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ করার ব্যাপারে চিফ ইনফরমেশন কমিশনারই মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। আপনাদের উচিত, তাকে এই তালিকার বিষয়ে সরাসরি প্রশ্ন করার। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অধিকতর স্বচ্ছ করে তোলার জন্য তিনি বিষয়টিকে জনসমক্ষে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে পারেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো ইতোমধ্যে আফ্রিকার অনেক দেশে এরকম ভিসানীতি প্রয়োগ করেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর এরকম ভিসানীতির প্রয়োগ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখবে কি?
এখানে স্পষ্ট বিষয় হলো, বাংলাদেশের অবস্থা নাইজেরিয়া, নিকারাগুয়া কিংবা ভেনিজুয়েলা- কারও মতোই হবে না। প্রত্যেকটা দেশের ভিন্ন ভিন্ন ইকোনমিক মেরিট আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে চীন-ভারতের সম্পর্ক, ইন্দো-প্যাসিফিক জোন, বঙ্গোপসাগরসহ এক ধরনের জিওপলিটিক্যাল ইকোসিস্টেম রয়েছে। আর নাইজেরিয়ার জিও পলিটিক্যাল ইকোসিস্টেম আলাদা। ভেনিজুয়েলা এবং নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলো মূলত রিসোর্স ইকোনমি। বাংলাদেশের অর্থনীতি সেরকম নয়। সুতরাং ভিসানীতির প্রয়োগের বিষয়ে এ ধরনের তুলনামূলক অবস্থানে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিসানীতির প্রয়োগটি প্রধানত রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত, এটার মধ্যে অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া তেমন একটা নেই।
কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন ভিসানীতির কারণে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইতে নেতিবাচক জাতীয় ধারা তৈরি হতে পারে। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মূলত ভিসানীতির কারণে এফডিআইতে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে সামনে যদি কোনো বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসে, তাহলে নিঃসন্দেহে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যদি এমন কোনো ব্যক্তি থাকে, যার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, তাহলে এফডিআইতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে ভিসা নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে এফডিআইয়ের বিষয়টিকে অতিরঞ্জিতভাবে জড়ানো হচ্ছে।
মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা কি সরকার, প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে?
অবশ্যই তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা একটা প্রভাব ফেলবে। কেননা ভিসানীতিতে স্পষ্ট বলা আছে যারাই আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার বিষয়ে বাধাদান করবেন, তারাই এই নীতির আওতায় পড়বেন। এটাতে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত আছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের হিসাব মোতাবেক যারাই জাতীয় নির্বাচনে তাদের শর্ত পূরণে বাধাদান করবেন, তারাই এই ভিসা নীতির আওতায় পড়বেন এবং এজন্য তারা নিঃসন্দেহে উদ্বিগ্নও হবেন। তবে এই উদ্বিগ্নতা দিয়ে তারাও যে আলাদা কিছু করতে পারবেন, তাও তো সম্ভব নয়।