এ দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করাই আমার একমাত্র ব্রত: আরমা দত্ত

জাফর খান
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৩৯

আরমা দত্ত। ফাইল ছবি
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী এক ব্যক্তিত্বের নাম আরমা দত্ত। এ দেশের মানুষের কল্যাণে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে দেশব্যাপী নানা উন্নয়নমূলক কর্মযজ্ঞে নিজেকে জড়িয়ে বারবার প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় যিনি নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন সেই স্বাধীনতার পর থেকেই। আরমা দত্ত একজন সফল উন্নয়ন কর্মী হিসেবে কাজ করার পাশপাশি মানবাধিকার ও রাজনীতিবিদ হিসেবেও সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছেন যুগ যুগ ধরে। বর্তমানে তিনি জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের একজন সম্মানিত সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। পারিবারিকভাবে অত্যন্ত মর্যাদাশীল ও ঐতিহ্যগতভাবে স্বনামধন্য দত্ত পরিবারের কন্যা তিনি। বিখ্যাত প্রবীণ রাজনীতিবিদ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনী আরমা দত্ত। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যিনি এ দেশের মানুষ আর মাটির জন্য হাসিমুখে বরণ করেছিলেন মৃত্যুকে তার পুত্রসহ। আজ শুনব সেই কালজয়ী পরিবারের সদস্য ও মানবাধিকার এবং উন্নয়নকর্মী আরমা দত্তের জীবন কাহিনী। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সাম্প্রতিক দেশকালের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক জাফর খান...
আমরা জানি বিখ্যাত দেশ প্রেমিক রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ পরিবারের সদস্য আপনি। পারিবারিকভাবে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে আপনার বেড়ে ওঠা। আপনার জীবনের বৈচিত্র্যময় ছোটবেলা ও শৈশব সম্পর্কে জানতে চাই।
প্রথমেই আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি সাম্প্রতিক দেশকাল পরিবারকে বস্তনিষ্ঠ, পরিশীলিত সংবাদ প্রকাশের একটি বলিষ্ঠ মাধ্যম হিসেবে কাজ করার জন্য। ঐতিহ্যবাহী ও উচ্চমানের একটি পত্রিকা হিসেবে প্রয়োজনীয় ও ব্যতিক্রম তথ্য তুলে ধরায় সাম্প্রতিক দেশকালের অবদান অতুলনীয়। তবে এই ডিজিটাল যুগে দেশকাল সাপ্তাহিক ও ত্রৈমাসিক দেশকাল পত্রিকা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আরও কীভাবে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেয়া যায় তা নিয়ে কাজ করে সামনে এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশায় ধন্যবাদ জানিয়ে আমার কথা শুরু করছি।
আমার ছোটবেলা খুব বৈচিত্র্যময়। একটা Non-Conventional Progressive Family তে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। গতানুগতিক জীবনের বাইরে ছিল আমার পরিবারের ধ্যান-ধারনা, জীবনাদর্শন ও প্রত্যাহিক সূচী। কখনও একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমের মধ্যে আমাদের পরিবার সীমিত ছিল না। খুব সাধারণের মধ্য দিয়ে অসাধারণ একটি জীবন দর্শন গড়ার একটি প্রতিষ্ঠান বলা যেতে পারে আমাদের দত্ত পরিবারকে। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের একটি পরিবারে আমার জন্ম। আমার জানা আর না জানা অনেক কিছুই আছে এই দত্ত পরিবারকে ঘিরে। যা জানি তা যেমন পথচলায় আশীর্বাদ ছিল অনুরূপ যা অজ্ঞাত, তাও ছিল পথচলার পাথেয়।
আমার বাবা সঞ্জীব দত্ত ছিলেন একজন বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক। ৫০ দশকে ‘পাকিস্তান অবজারভারে’ তিনি কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর’ রহমানের অনুরোধে ’বাংলাদেশ অবজারভারে‘ যোগদান করেন। তিনি ‘কোলকাতার অমৃতবাজার এবং নাগাল্যান্ড টাইমসেও সুনামের সাথে কাজ করেছেন। বাবা তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন নির্বাসনে ।
আমার পরিবার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিল। জনগণের স্বাধীনতা, অধিকার আদায়, শোষিতের পক্ষে দত্ত পরিবার শুরু থেকেই সোচ্চার ভূমিকা পালন করে গেছে। মানুষের অবহেলা, কষ্ট, যন্ত্রণা সহ্যের ক্ষমতা ছিল না পরিবারের বয়োজেয়ষ্ঠদের। আমার মা প্রতিতী দেবী। তিনি বিখ্যাত ঘটক পরিবারের সন্তান। তিনি মনীষ ঘটকের বোন ও ঋত্বিক ঘটকের জমজ বোন। শিক্ষা-সাংষ্কৃতি, রাজনৈতিক ও সাহিত্য সকল শাখাতেই আমার মায়ের পরিবার ছিলেন অগ্রগামী। | Crème of Civil Society বলতে যা বোঝায় তাই ছিল আমার দাদামশায়ের পরিবার।
শুরুটা সেখান থেকেই করি। আমার বাবা সঞ্জীব দত্তের পিতা মানে আমার ঠাকুরদা হলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আপনারা জানেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যিনি তার পুরো জীবনটা কাটিয়েছেন এ দেশের মানুষের জন্য। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে একেবারে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীদের থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মুক্তি সংগ্রাম পর্যন্ত ছিলেন গভীরভাবে জড়িত ও সোচ্চার। তিনি ছিলেন এক আপোষহীন দেশপ্রেমিক নাগরিক, যিনি সেচ্ছায় নিজ দেশের মুক্তির জন্য শহীদ হয়েছিলেন।
ব্রিটিশ শাসন হতে মুক্তির পর দেশভাগের সময় আমার ঠাকুরদা, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে, পশ্চিমবঙ্গেও প্রথম মূখ্যমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেয়া হলে তা তিনি প্রত্যাক্ষান করেন। “সে সময় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ওনাকে বলেছিলেন- ইউ আর মেকিং বিগেস্ট মিসটেক ইন ইওর লাইফ। জবাবে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন- ইওর হাইনেস, লেট মি এম্ব্রেস দিজ মিসটেক অ্যান্ড রিটার্ন টু মাই হোমল্যান্ড।” সেসুবাদে দিল্লীতে না গিয়ে আমার দাদু, পাকিস্তানের প্রথম রাজধানী, করাচীতে চলে যান। সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদে যে তিনজন সদস্য শপথ নেন তাদের মধ্যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন গণপরিষদের অন্যতম সদস্য। বাকী দুজন ছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান। আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন না আমার দাদু পাকিস্তানের সংবিধান রচয়িতাদের একজন ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা’ করবার জন্যে প্রস্তাব করেন তিনি। তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন- Bangla should be the lingua franca (রাষ্ট্র ভাষা) of the state। এর জবাবে লিয়াকত আলি খান আমার দাদুকে সেই মুহুর্তেই পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী করে আগাম হুশিয়ারি দেন। তথাপি আমার দাদু, দেশের মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্র আদায়ের জন্য সারাজীবন আপষহীনভাবে সংগ্রাম করে গেছেন। এরপরের ঘটনার ধারাবাহিকতা আপনাদের সকলেরই জানা। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এ রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ৩০ লাখ শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বাংলাদেশ। এই শহীদদের কাতারে রয়েছেন, আমার পরম প্রিয় পিতামহ, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও আমার একমাত্র কাকা, শহীদ দীলিপ দত্ত।
আমার বাবা সঞ্জীব দত্তের প্রসঙ্গে আসা যাক। তিনি ১৪ বছর বয়সে কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন, এবং সেখানেই ঘটক পরিবারের সঙ্গে আমার বাবার পরিচয়। আমার মামা লোকেশ ঘটক (মা প্রতিতী দেবীর ভাই) যিনি বাবার সহপাঠী ছিলেন (পরবর্তীকালে রয়েল ইন্ডিয়ান নেভিতে ছিলেন)। আমার বাবা, সঞ্জীব দত্তের সাথে লোকেশ ঘটকের মাধ্যমে বিখ্যাত ঘটক পরিবারের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, বিশেষ করে, কল্লোল যুগের পুরোধা, বিখ্যাত সাহিত্যিক ও কবি, শ্রী মনীষ ঘটককে কেন্দ্র করে। সেখান থেকে ওই পরিবারের সাথে গভীর সখ্যতা ঘটে। কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ এক পরিবারের সন্তান সঞ্জীব দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় কলকাতার সর্বোচ্চ শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পরিপুষ্ট এক অন্যতম অভিজাত পরিবারের। একনামে ভারতবর্ষে যাদের পরিচিত ছিল। তাদের আদি পুরুষ মধ্য এশিয়া থেকে এসেছিলেন। তাদের চেহারায় সে ছাপ ছিল স্পষ্ট। মূলত পাণ্ডিত্য প্রচার ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন মায়ের আদি পুরুষেরা। যদিও পরবর্তীতে পাবনায় ভাড়েঙ্গা গ্রামে তাদের আবাসস্থল গড়ে তুলেন যা যমুনায় বিলীন হয়ে যায়, এখন নতুন ভাড়েঙ্গা নামে পরিচিত।
প্রথম জীবনে কলকাতায় আমার বেড়ে ওঠা। একদম সিটি লাইফ, ট্রাম আর নিয়ন আলোয় ঘেরা ছোটবেলার স্বপ্ন বুননের দিনগুলো। সেখান হতে আমি আমার মায়ের ও বাবার হাত ধরে চলে আসি পাকিস্তানে , আমার দাদু, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে। ঢাকায় তখন ঘোড়ার গাড়ি চলতো। নেই ট্রাফিক লাইট, নেই গাড়ি, নেই ট্রাম, তবে ছিল প্রচুর বৃক্ষরাজির চাদরে আবৃত আজকের এই ইট কাঠের কঙ্ক্রিটের মহানগরী ঢাকার চেহারা চিন্তা করা যায়না। আজ যেটা শাহবাগ এলাকা সেখানে তৎকালীন সময়ে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, গুলমহর গাছের সমাহার ছিল। আমার বাবা তখন পাকিস্তান অবজারভারে কর্মরত ছিলেন এবং আমার বাবা ও মায়ের সাথে থাকতাম পুরান ঢাকার হেমেন দাস রোডে। আজব বিষয় হলো- আজ যে ভয়ংকর দূষিত বুড়িগঙ্গাকে দেখছি, তখন ছিল এর বিপরীৎ রূপ। টলটলে সাদা জলের মধ্যে নুড়ি আর বালুর দেখা মিলত। খানিকটা হেটে গেলেই স্ফটিকের মতো জল রাশির দেখা মিলতো, যা ছিল মন ভোলানো। আজও আমার সদরঘাটের বাহারি চকোলেটের দোকানের কথা খুব মনে পড়ে।
বাবার চাকুরির সুবাদে সেসময়ের সকল বিখ্যাত সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমার বাবা ও মা, প্রতিতী দেবীকে কেন্দ্র করেই সবাই আসতেন আমাদের বাসায়। বাবা ও মা ছিলেন সকলের মধ্যমণি। সৈয়দ শামসুল হক, শামছুর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ফায়েজ কাকা, কলিম শরাফীসহ ওয়াহিদুল চাচা এবং আরো অনেকেই “সঞ্জীব দা” কেন্দ্রীক ছিলেন। মজার বিষয় হলো- ছোটবেলায় বাবার বন্ধুদের আমি নাম ধরেই ডাকতাম, যেন ওনারা আমারও বন্ধু। পরে যখন বড় হলাম তখনও আর সম্ভাষণের পরিবর্তন হয়নি। আমার মা, প্রতিতী দেবী, অসাধারণ গান গাইতেন ।
একদিকে সংস্কৃতি জগত, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অস্থিরতা এ দুয়ের সংমিশ্রণে বেড়ে ওঠতে থাকি। দেখতাম আমাদের বাসায় শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরো সকলের আনাগোনা ছিল আমাদের বাসায় আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কেন্দ্র করে। রাজনীতির নানা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের আঁতুড় ঘর যেন হয়ে ওঠে আমাদের বাড়ি। বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমান আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্রতুল্য ছিলেন। আমার দাদু, ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি, আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্বে। হেয়ার রোড ও ১নং মিন্টু রোড মিলিয়ে তখন আমাদের বসবাস। বলা যায় এভাবেই শুরু আমার বর্ণাঢ্য ছেলেবেলা ও কৈশরকাল।
আপনার শিক্ষাজীবন ও তৎকালীন রাজনৈতিক উত্তেজনা- এ দুয়ের মিশ্রণে সে সময়কার কিছু স্মৃতি যদি বলেন...
১৯৫৮ সালে, যুক্তফ্রন্ট সরকারের অবসান ঘটে এবং ফিল্ড মার্শাল, আইয়ুব খান এর সামরিক শাসন শুরু হয়। বুঝতে পারছিলাম এটাই ছিল পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকারের বিদায়। চলে আসলাম কুমিল্লায়, মা-বাবা, কাকু ও ছোট ভাইসহ দাদুর সাথে কুমিল্লায় বসবাস করতে। আমার বাবা সঞ্জীব দত্তকে আইয়ুব সরকার পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা থেকে বাদ দিয়ে দিলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক কারণে আমার বাবা evev Political Asylum (রাজনৈতিক আশ্রয়) নিতে বাধ্য হলেন, পার্শ্ববতী রাষ্ট্র, ভারতে। আমার বাবা ছাড়া বড় হতে থাকলাম, আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আমার কাকু, শহীদ দীলিপ দত্ত ও আমার মা, প্রতিতী দেবীর আদরে ও তত্ত্বাবধানে।
নগর জীবন থেকে একদম পল্লী জীবনের আরেক অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হয় কুমিল্লায় যেখানে, রাত নামলেই ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ, প্যাঁচার ডাক, বাদুর পাখির পাখা ঝাপটানি, মনমাতানো মহুয়া ফুলের গন্ধ, কামিনি, যুঁই, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা ফুলের অপূর্ব গন্ধে সারা আকাশ বাতাস যেন প্লাবিত হয়ে যেত, এবং তার সাথে হাজারো জোনাকি পোকার আলো চাঁদের মধু জোছনার সাথে মিশে এক রূপ কথার মায়াবী জগত আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো।
কোথাও কোথাও পিচঢালা পথ ছিল, তার সাথে কিছু ল্যাম্পপোস্ট, সন্ধ্যায় প্রত্যেক প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে আসতো অপূর্ব গানের মোহিত সুর, ধূপের গন্ধ, হাস-মুরগীর বাড়ি ফেরার ছূটোছুটি, নিস্তব্ধ রজনীতে কুকুরের অকস্মাৎ ডাক- এসব মিলিয়ে একটা আনন্দের ঘোরেই কেটেছে আমার দিনগুলো। সন্ধ্যামালতি-হাসনাহেনার অপরুপ দৃশ্য, বাড়ি বাড়ি গানের আওয়াজ, বিশাল দিঘী ধর্মসাগরে ফুটে থাকা পদ্ম- এসবেই বিমোহিত থাকত আমার মনজগত, যা আমি আজ অব্দি ভুলতে পারিনি।
একবার গাছে উঠে জলপাই পাড়তে গিয়ে গাছের ডালের ওপর থেকে আর নামতে পারছিলাম না। শেষমেষ ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা আমাকে নামিয়ে আনেন, কারণ, সেখানে সেই গাছের নীচে শুঁয়োপোকা কার্পেটের মত বিছানো ছিল। সাধারণভাবেই এক অসাধারণ জীবন আমি কাটাতে লাগলাম এবং নির্মল অপূর্ব প্রকৃতির সাথে জড়িয়ে বড় হতে লাগলাম, আমার, দাদু, কাকু এবং মায়ের কাছে, আমার প্রিয় কুমিল্লা শহরে। তখন আমি কুমিল্লায় ‘‘Our Lady of Fatima Convent School” পড়তাম।
আর এদিকে দেখতাম আমাদের বাড়িতে একদিকে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নাটকের আসর আর অন্যদিকে চলতো তৎকালিন রাজনৈতিক সংকটের অস্থিরতা নিয়ে এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের জন্যে একের পর এক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের নিয়ে নানা বৈঠক । সেই সময়, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জনাব, আতাউর রহমান খান, শ্রী, ত্রৈলক্য নাথ মহারাজ, শ্রী রবি নাগসহ আরো বহু বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আসতেন, আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে নানা ধরণের পরিকল্পনা, পরামর্শমূলক আলোচনা করতে, দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবার জন্যে এবং সামরিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আমি নিজেকে মনে করি ও বিশ্বাস করি, I am made from a different unique soil with a great mix of politics and culture with a strong base of humanism.
কুমিল্লা ফয়জুননেছা থেকে এসএসসি পাস করি, ১৯৬৬ তে। আর তখন থেকেই আমি আমার দাদুর সাথে আন্দোলনের কাজে সংযুক্ত হই এবং নানা গ্রাম, মহকুমা ও শহরে চিত্র ঘুরতে থাকি, আসলে সেই থেকে রাজনীতিতে আমার হাতে খড়ি। আমি স্কুলে থাকা অবস্থায়, গভীরভাবে, ১৯৬৬’র ৬ দফা আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হই। এইভাবে যেন একটা ন্যাচারাল প্রসেসেই রাজনীতির সাথে আমি যুক্ত হয়ে গেলাম, আমার অজ্ঞাতেই। আমার দাদুর কাছ থেকে পলিটিকস, ইতিহাস, অর্থনীতি, দর্শন, ধর্ম, সমাজ পরিবর্তনের জ্ঞান অর্জন করতে লাগলাম।
সেসময় একটা কঠিন অবস্থা বিরাজমান ছিল আমাদের বাড়িতে। আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে,বার বার পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী, রাজনৈতিকভাবে হেনস্থা করে, জেলখানায় নিয়ে যেতে লাগলো, , Defense of Pakistan Rule এর আওতায়। বাড়িতে দাদু ছাড়া আর কেউ রোজগারের অবস্থায় ছিল না, আমার দাদুকে সামরিক শাসকরা, EBDO (Elective Bodies Dis-qualification Order) করে রাখার কারণে, আমাদের আর্থিক সংকট সব সময় লেগে থাকতো। আমার দাদু, একজন বিখ্যাত উকিল ছিলেন এবং আমার দাদুর রোজগারেই আমরা কোনভাবে সম্মানের সাথে জীবন যাপন করতাম। কখনও শুধু ঘি, আলু আর নুন দিয়ে সাদা ভাত খেয়ে আমাদের দিন মহা আনন্দের সাথে পাড়ি দিতাম, যা আমাদের গ্রাম রামরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসতো। যখন আমার দাদু কোর্টে যেতে পারতেন, জেল খানার বাইরে থাকলে সে সময় মক্কেলরা যৎ সামান্য টাকা পয়সা দিতেন তা দিয়েই আমাদের সংসার চলতো এবং বাজারের ব্যবস্থা হতো।
১৯৬৮ সালে কুমিল্লা উইমেনস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। আমি রোকেয়া হলে থাকতাম। সেই সময় আমার দাদু আমাকে মাসিক হাতখরচ বাবদ, টাকা ১৫০ করে বাড়ি থেকে পাঠাত। আবার অন্যদিকে আমি স্কলারশিপের টাকাও পেতাম মাসে মাসে। বেশ ভালো ভাবেই চলে যেত আমার পুরো মাস। তখন অনেক বই কিনতাম আর পড়তাম। এর পরেই শুরু হলো ১৯৬৯ এর গণআন্দোলন। চলে আসল ১৯৭০ এর নির্বাচন। আওয়ামী লীগের হলো নিরুঙ্কুশ জয়। ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১ এ আমি সরাসরি ছাত্র আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। দেখছিলাম ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিমারা কীভাবে টাল্বাহানা শুরু করছিল। উত্তাল ঢাবি। বটতলা, শহীদ মিনার, রোকেয়া হল ও রাজপথে আমি সর্বদা রাজনৈতিক আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করি। আমি খুব ভাল পোস্টার লিখতে পারতাম এবং ইংরেজি পোস্টার লেখার দায়িত্ব আমার উপরেই বর্তাতো। এমন উত্তাল পরিস্থিতিতে, আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নির্দেশনাই, ১৯৭১ এর ৭ মার্চ আবারও ফিরে আসলাম কুমিল্লায় দাদু ও কাকুর কাছে। একের পর এক নানা চরাই উতরাই ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে চলছিল আমার জীবন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে আপনাদের পরিবার ও বিশেষ করে আপনার ঠাকুরদা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রত্যক্ষ সংযোগের বিষয়ে জানতে চাই...
আগেই বলেছি যে, রাজনৈতিক সহিংসতা, অস্থিরতা ও আন্দোলনের মধ্যে উত্তাল ঢাকায় আর থাকা সম্ভব হলো না। আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আদেশে আমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া হল ছেড়ে কুমিল্লার বাড়িতে ফিরে আসলাম, ১৯৭১ এর মার্চ মাসে। দাদুকে প্রায়শই বলতে শুনতাম সকলের কাছে- ‘BE PREPARE FOR A SEVERE BLOOD BATH’ আমি শুধু কেবলই ভাবতাম, একটা মানুষ এতটা দূরদর্শী কিভাবে হতে পারেন?? শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আমার দাদু পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলকে, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না, কারণ সামরিক শাসকরা ভোটের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তাদের মধ্যে শুধু এই দৃঢ় মনোভাব ছিল যে, কীভাবে পূর্ব পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষকে অত্যাচার ও শোষণ করা যায়। আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দীপ্ত কন্ঠে দৃঢ়তার সাথে গর্বভরে বলতেন, “একমাত্র আমাদের এই দুঃসময়ে একজনই পারবে এই বাংলাদেশকে দাসত্বের শৃংখল হতে মুক্ত করে বাংলাদেশের স্বাধিনতা আনতে, সে আর কেউ নয়, সে হলো, শেখ মুজিবুর রহমান, একজন সাচ্চা বাঘের বাচ্চা, যে এক অসাধারণ দু:সাহসিক ক্যারিজম্যাটিক লিডারশীপের অধিকারী”। আমার দাদুর মতে, বঙ্গবন্ধুর মতে আর দ্বিতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেবার মতো আর কেউই ছিল না। পুরো বাঙ্গালী জাতি ও দেশকে এক ছাতার নীচে নিয়ে আসলেন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার ডাক দিয়ে।
এমন অবস্থায় এসে গেল ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রি (অপারেশন সার্চলাইট)। সেদিন রাতেই আমাদের বাড়ি ঘেরাও কওে ফেলে পাকসেনারা, পুরো কুমিল্লা শহরে কারফিউ চলছিল এবং সারা শহরে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী টহল দিয়ে চলছিল এবং ট্যাংক দিয়ে সারা শহর ঘুরছিল। এমনই কঠিন পরিস্থিতিতে, ১৯৭১ এর ২৯ মার্চ, আনুমানিক রাত দেড়টায়, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীরা, আমার দাদু, শহীদ দীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও আমার কাকু, শহীদ দীলিপ দত্তকে, তুলে নিয়ে যায় কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে প্রায় ১৪/১৫ দিন ধরে, পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে পিতা ও পুত্রকে, গণবধ্য ভূমিতে তাদের নিক্ষেপ করে মাটি চাপা দিয়ে দেয়, যাদের দেহাবশেষ আর কোনদিনই পাওয়া যায়নি।
আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ভয়ঙ্কর নির্যাতন করে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ানোর অনেক চেষ্টা করে, তবে কঠিন অমানুষিক অত্যাচারের পরেও মৃত্যুও শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত ওনাকে বিবৃতি দেওয়াতে পারেনি, শেষ মূহুূর্ত পর্যন্ত। তিনি শত অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করেছেন, ওনার সামনে ওনার পরম প্রিয় পুত্র, শহীদ দীলিপ দত্তকে অত্যাচার করে হত্যা করার পরেও উনি ছিলেন অনঢ়। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এক অসাধারণ দেশ প্রেমিক, যার কোন তুলনা নাই, যার তুলনা তিনি নিজেই। এই বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম নিশ্চয়ই করবে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে মূল্যায়ন এবং দেশপ্রেমে স্নাত।
আমার দাদু ও কাকুকে ২৯ মার্চ, আমাদের কুমিল্লার ধর্ম সাগর পাড়ের বাড়ি থেকে, পাক বাহিনীরা ধরে নিয়ে যাবার পর, আমার মা, প্রতীতি দেবী, আমার ছোট ভাই, রাহুল দত্ত, আমাদের বাসস্থান/ভিটা থেকে অতি কষ্টে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই এবং কঠিন কষ্ট করে জীবন বাজি রেখে, কুমিল্লার গোমতী নদী পার হয়ে ভারত বর্ষের ত্রিপুরা রাজ্যের সোনামুড়াতে কোনভাবে প্রাণ নিয়ে প্রবেশ করতে পারি এবং আগরতলায় পৌঁছাতে পারি। সে এক বিভিষীকাময় অভিজ্ঞতা যা বাস্তবিকভাবে আজও বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
আমরা আগরতলা পৌঁছালে, আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় সে সময়ের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্য মন্ত্রী, শ্রী শচীন সিংহ এর কাছে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি কাঁদতে কাঁদতে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি, ইন্দিরা গান্ধীকে আকুতি ও অনুরোধ জানাকে সক্ষম হই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান বাংলাদেশের নিরাপরাধ, নিরস্ত্র মানুষদের প্রাণে বাঁচাতে এবং ভারতের বর্ডার/সীমান্ত খুলে দিতে, যাদেরকে বর্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীরা পাখির মতো অত্যাচার করে মারছে এবং সেই নিরাপরাধ মানুষদেরকে “রিফিউজি স্ট্যাটাস” দিয়ে ভারত বর্ষে আশ্রয় দেবার জন্য। শ্রীমতি, ইন্দিরা গান্ধী, আমার গগণভেদী আর্তনাদ ও কান্না শোনেন এবং আমাকে তিনি কথা দেন যে, তিনি অতি শিঘ্রই এর ব্যবস্থা নেবেন।
আমার মা, আমার ভাই ও আমি কিছুদিন আগরতলা থাকবার পর, আমার বাবা, শ্রী সঞ্জীব দত্ত তখন তিনি কলকাতার অমৃতবাজার পত্রিকার এসিস্ট্যান্ট এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তিনি আগরতলায় এসে আমাদেরকে আগরতলা থেকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন।
এর পরের ইতিহাস অনেক জটিল ও লম্বা, অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। ছোট করে বলতে গেলেও শতাব্দী পার হয়ে যাবে। আমি তখন আমার বাবা, শ্রী সঞ্জীব দত্ত, আমার পিসতুতো দাদা, শ্রী কল্যাণ চৌধুরী, আমার ছোট মামা ঋত্বিক ঘটকসহ (আমার মা, প্রতীতি দেবীর জমজ ভাই) সবাই মিলে আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়তে কাজ শুরু করি ভারতবর্ষে। বিশেষ করে তৎকালীন ভারত বর্ষের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্ব, সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তিবর্গের সাথে গভীরভাবে কাজ করতে থাকি। আরো মনে পড়ে, কয়েকজন অসাধারণ নারী নেত্রীদের কথা, বিখ্যাত সাহিত্যিক মৈত্রী দেবী, শ্রীমতি মহাশ্বেতা দেবী, গৌরী আইয়ুব, রাজনীতিবিদ ড. ফুলরেনু গুহ, শ্রীমতি ইলা মিত্র আরো অনেকে ছিলেন, তাদের সকলে কথা আমার এই মূহুূর্তে হঠাৎ করে মনে পড়ছে না। এইটুকুই শুধু আমার সেই অল্প বয়সে মনে হতো, আমার শুধু একটাই কর্তব্য ও কাজ এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন মাটির জন্যে আমার প্রাণ দিয়ে হলেও কাজ করে যেতে হবে, যেখানে লাখো শহীদদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের মাটি, যেই মাটিতে আমার প্রাণ প্রিয় দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আমার প্রাণ প্রিয় কাকু, শহীদ দীলিপ দত্তের রক্ত দিয়ে স্নাত। ৩০ লাখ শহীদদের রক্তের গঙ্গার ওপর অর্জিত হলো স্বাধীনতা, একটি নতুন রাষ্ট্র, “বাংলাদেশ”। এই রক্তের সাগর এবং ধ্বংসস্তুপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমার “বাংলাদেশ” নামক একটি রাষ্ট্র, যা আমার পূণ্য ভূমি ও তীর্থ ভূমি!!!
জীবনে প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির সমীকরণের হিসাবটা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
আমার কখনও কোন বড় স্বপ্ন ছিল না, তবে স্বপ্ন ছিল আমি যেন আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো দেশকে এবং মানুষকে সেবা করে যেতে পারি। আমার চাওয়া-পাওয়াকে সীমিত পরিসরেই রেখেছি আজীবন। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার পরিবারের বলিদানের দুঃসহ স্মৃতি আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যা সামলাতে পারিনি আজ অবধি। আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও কাকু, শহীদ দীলিপ দত্তের টাটকা গরম রক্ত আমার পা ভিজে যায় সেই গরম রক্ত আমি এখনো অনুভব করি প্রতিক্ষণ। আমার দাদু ও আমার কাকাসহ এই বাংলাদেশ স্বাধীন করবার জন্যে আরও যারা নাম না জানা লাখো মানুষ শহীদ হয়েছেন, তাদেও যন্ত্রণা কাতর চিৎকারের আওয়াজ আমি এখনো শুনতে পাই!!
আমার বিশেষ কোন চাওয়া নেই। শুধু আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দেশপ্রেমের এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান করাই এবং দেশের জন্যই কাজ করা আমার জীবনের মূল প্রত্যাশা ও ভিত্তি । নিজের প্রাণ প্রিয় পুত্র ও নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে এ দেশের মাটির কাছে নিজেকে যিনি আত্মহুতি সমর্পণ করেছিলেন সে মানুষটি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আদর্শের অঙ্গীকার ও ত্যাগের মহিমায় জাগ্রত সেই মহান ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই আমার জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়ার বলয় রচিত হয়েছে। আমি দীপ্ত কন্ঠে, গভীর ভালবাসার সাথে যে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলতে পারি গর্বের সাথে, স্বাধীন বাংলাদেশে- শহীদ পরিবারের সন্তান হয়ে এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া ।
আমি মাঝে মধ্যে গভীরভাবে ভাবি, যদি জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমান, ওনারই আর্শীবাদপুষ্ট কন্যা, গণতন্ত্রের মানস কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনাকে যদি না রেখে যেতেন, বঙ্গবন্ধুর “সোনার বাংলা”, এবং এই সুন্দর একটা বাংলাদেশ পেতাম না। আমি সর্বদা ভাবি, কি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শত যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে বেঁচে আছেন সকল কষ্ট বুকে নিয়ে যা তিনি শক্তিরূপে রূপান্তরিত করে নিরলসভাবে দেশ ও মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ।
গভীর অন্ধকার থেকে আলোর পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, গণতন্ত্র্রের মানসকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । ওনার হৃদয়ের গহীন যন্ত্রনার কান্না আমি শুনতে পাই, বিশেষ করে আমার দাদু এবং কাকুর রক্ত এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় । আজ আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ হাসিনার আর্শীবাদে ও কল্যাণে আমি রাজনীতিবিদ হতে পেরে আমি অত্যন্ত গর্বিত। আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দেখানো মুক্তি সংগ্রামের দীর্ঘ পথের কা-ারি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অদম্য প্রচেষ্টা আর সংগ্রামে যে লাল সবুজের পতাকা মোড়া যেই বাংলাদেশ পেয়েছি, যে দেশে বুকে হাত দিয়ে আমি গর্বের সাথে গাইতে পারি, ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালবাসি’, এছাড়া নতুন করে আমার চাওয়ার কিছইু নেই।
মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন আপনি। শুরুর দিকে কেমন প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছিলেন?
দেখুন পারিবারিকভাবেই আমি এমন পরিবারে বেড়ে ওঠেছি যেখানে শিশুকাল থেকেই দেখেছি কীভাবে মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করতে হয়। আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মা, প্রতীতি দেবী, বাবা, সঞ্জীব দত্ত, কাকু, শহীদ দীলিপ দত্ত, মামা, ঋত্মিক কুমার ঘটক, বোন, মহাশ্বেতা দেবী, ওনারা সকলেই মানুষের অধিকার নিয়েই সারাজীবন কাজ করেছেন। ১৯৭৪ এ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করার পরেই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি, প্রভাষক হিসাবে, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ানোর সাথে সাথেই ভাবলাম মানুষের জন্য কী করা যায় আর সে ভাবনা থেকেই ডেভলোপমেন্ট সেক্টরে নিজেকে নিয়োজিত করলাম। ১৯৭৫ পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরে, দেশে সামরিক শাসন শুরু হলো এবং তখন নানা বাধার মুখে পড়লাম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য হলাম এবং দেশও ত্যাগ করতে হলো। গেলাম কানাডায়, সেখানেও আরেক দুর্বিষহ জীবনের সাথে পরিচয় হলো। ১৯৮০ সালে কানাডা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসলাম শুরু করলাম উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান প্রিপ ট্রাস্ট, যা আমার হাতে গড়া। তৃণমূলে স্থানীয় ছোট ছোট এনজিওগুলোকে সংগঠিত করে তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা তৈরী করতে থাকলাম যেন তারা তৃণমূলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধির ব্যাপারে।
ভাবনা ছিল শুধু- সৎপথে কিছু একটা করে যেন সম্মানের সাথে খেয়ে পওে সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকতে পারি। এভাবেই লক্ষ বাধা, অপমান, কষ্ট, যন্ত্রনা ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অদম্য পথচলাকে অব্যাহত রেখে নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকে সামনের পথে এগিয়ে গেছি। কখনো ভেঙে পড়িনি, দমেও যাইনি। ২০০১ সালে আমার ওপর নেমে আসল তৎকালীন জামায়াত-বিএনপি সরকারের খড়গ। নিজ হাতে গড়া সংস্থাটি চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখলাম। পরে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর ডাকে রাজনীতিতে আসলাম এবং গর্বের সাথে মহিলা সংসদ সদস্য হলাম। আমার দাদু, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আমার বাবা, সঞ্জীব দত্ত, আমার মা প্রতীতি দেবী, আমার কাকা, শহীদ দীলিপ দত্তের আশির্বাদ আমার মাথার ওপরে, যা আমার আস্থা ও পথ চলার শক্তি। আমার আরও বড় আর্শীবাদ আমার মাথার ওপরে রেখে গেছেন জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি আমাকে ওনার “আমানত” হিসেবে রেখে গেছেন। আমার গর্বের বিষয় বর্তমানে এ পার্থিব জগতে দেশ বরেণ্য নেত্রী, গণতন্ত্রের মানস কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশির্বাদে আমি গর্বের সাথে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে পারছি, এটাই আমার পরম পাওয়া। খুব বড় আর কোন স্বপ্ন নেই আমার মানুষের কল্যাণে সেবা করে যাওয়া ছাড়া। সৎ পথে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে সোচ্চার হওয়া ছাড়া।
ভবিষ্যতের কোনো স্বপ্ন?
ওই যে বললাম মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্য কাজ করে যাওয়া ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন দেখি না। তবে হ্যাঁ রাজনীতিতে যেহেতু পারিবারিকভাবেই পরোক্ষভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলাম এবারে আরও সক্রিয় ও প্রত্যক্ষভাবে জীবনের বাকি সময়টা দেশের কল্যানের জন্যে রাজনীতি করে যাব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন আদর্শের সৈনিক ও সতীর্থ হিসেবে নিজের প্রজ্ঞা, মেধা, কর্মস্পৃহাকে উৎসর্গ করে দিতে চাই আমৃত্যু- এ দেশের কল্যাণে, এ মাটির উন্নয়নে ও অসম্প্রদায়িক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও লাখো শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করাই আমার অঙ্গীকার।
সাম্প্রতিক দেশকালের পক্ষ হতে আপনাকে ধন্যবাদ দিদি।
আপনাকেও ধন্যবাদ।