নদীর সঙ্গে জীব-জীবন-প্রকৃতি সবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে: ম. ইনামুল হক

আদর চৌধুরী
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪, ১২:৩২

নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ও জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ম. ইনামুল হক
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ও জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ম. ইনামুল হক ফারাক্কা দিবস নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-আদর চৌধুরী।
সাম্প্রতিক দেশকাল: ফারাক্কা দিবসের প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল, এই সময়ে ফারাক্কা বাঁধ সমস্যার কোনো সমাধান দেখতে পাচ্ছেন?
ম. ইনামুল হক: না, ফারাক্কা সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। এ ব্যাপারে ভারত সরকারের কোনো সদিচ্ছা নেই। বরং ফারাক্কা সমস্যা দিন দিন আরও প্রকট এবং স্পষ্ট হচ্ছে। আমরা শুধু সমস্যাটা দেখি যে, আমাদের নদীর পানি দিচ্ছে না। ভাগীরথী নদীতে গঙ্গার পানি পাঠানোর জন্য গঙ্গার যে জলপ্রবাহ সেটাকে বাধা দিতেই ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। যে কোনো নদীতে ড্যাম বা ব্যারেজ নির্মাণ করে জলপ্রবাহে বাধা দিলে তার সামনে পলি জমে একধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। পলি জমার এ সমস্যাটা একে তো জলাধারের জল ধারণ করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, তারপর উজানে বন্যা হলে অনেক সময় দেখা যায় যে বন্যার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। যার কারণে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার সম্প্রতি বলেছেন, ‘ফারাক্কা আমাদের ক্ষতি করছে, এটাকে ভেঙে ফেলা দরকার।’ কিন্তু ভারত সরকার এটাকে ব্যবহার করছে বাংলাদেশের ওপর প্রভুত্বটা কায়েম রাখার জন্য। এছাড়া আর কোনো কারণ নেই। কেবল ফারাক্কা নয়, তিস্তাতেও একই ধরনের কাজ চলছে, যেটা নাকি তিস্তার জলপ্রবাহর পুরোটাই তারা গজলডোবা ব্যারেজের মাধ্যমে সরিয়ে নিয়ে বিহারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এবং সেখানে পানিটা কোনো কাজে লাগছে না, সেটা ডাউকি নদীতে ফেলে দিচ্ছে। ফারাক্কার জন্য ভারতের বিহার ও উত্তরপ্রদেশ যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, ভারত সরকার কেন তার নিজ রাজ্যগুলোর সমস্যাও দেখছে না? ফারাক্কা সমস্যা করছে বিহারে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এটা বলছেন। নীতিশ কুমার তো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নন, তিনি হলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি রাজ্যের রাজনীতির জন্য এসব কথাগুলো বলছেন, বাস্তব সমস্যা তুলে ধরছেন।
সা.দে.: ষাটের দশকে ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরুর সময় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নেতারা বিষয়টি কীভাবে দেখেছেন?
হক: ১৯৬৫ সালে যখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়ে গেল, তখন এটা নিয়ে অনেক টেনশন ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ হলো, নতুন নতুন ভাবনা- চিন্তার ব্যাপার এলো। তখন বঙ্গবন্ধু আমাদের নেতা। তার একটা জিনিস হলো তিনি স্বাধীনচেতা ছিলেন। ১৯৭৪ সালে ভারত যখন ফারাক্কা চালু করতে গেল, তখন উনি ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটা চুক্তি করলেন। সে চুক্তিতে এগারো হাজার কিউসেক পানি নেওয়ার কথা ছিল। অতি অল্প, টেস্ট রান করে এখান থেকে সরাবে শুধু, এর বেশি না। কিন্তু তার কিছুদিন পর উনি মারা গেলেন। তারপর তো দেশে বিশৃঙ্খল অবস্থা। ওই রকম সময়ে ভারত পুরোদমে পানি সরিয়ে নেওয়া শুরু করল। ফুল অপারেশন করল। তখন তো কোনো নেতা নেই, ঠিক তখনই মওলানা ভাসানী উঠে দাঁড়ালেন। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মওলানা ভাসানী ওই বয়সে এত আন্তর্জাতিক জ্ঞানসম্পন্ন, মেধাসম্পন্ন, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। উনি পিজি হাসপাতাল থেকে ঘোষণা দেন যে, আমি লংমার্চ করব। এটা বিশাল ব্যাপার। এর ফলে একটা জাগরণ তৈরি হলো যা ভারত অস্বীকার করতে পারল না, বা তাকে অবজ্ঞা করতে পারল না। অতএব ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে যে চুক্তিটা হয়, এটা মওলানা ভাসানীর লংমার্চের ফল। সে চুক্তিটা একটা সম্মানজনক চুক্তি ছিল। সেই সম্মানজনক চুক্তিতে ন্যূনতম সাড়ে চৌত্রিশ হাজার কিউসেক পানি অবশ্যই আসবে।
সা.দে.: চুক্তির সাড়ে চৌত্রিশ হাজার কিউসেক পানি কি আমরা পাচ্ছিলাম? পেলে সেটা কতদিন ধরে?
হক: হ্যাঁ, পাচ্ছিলাম। সেটার রেকর্ড আছে। এটা পাঁচ বছরের চুক্তি ছিল। তারপর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এলেন, তার নতজানু নীতির কারণে কোনো চুক্তিই হয়নি। দশ বছর কোনো চুক্তি ছিল না। এরপর জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি ছিলেন খালেদা জিয়া, তিনিও কোনো চুক্তি করেননি, সাহসই পাননি কথা বলার। ১৯৯৬ সালের হাসিনা সরকারের আমলে চুক্তিতে সাড়ে চৌত্রিশ হাজার থেকে নেমে সাতাশ হাজার কিউসেকে চলে এলো এবং এটার কোনো গ্যারান্টিও ছিল না। এবং ওনার চুক্তির পর সাতাশ হাজারও আমরা পাইনি। দশ-পনেরো হাজারের মধ্যে রয়ে গেছে। এখন আমি আর রেকর্ড নিই না, চেক করি না।
সা.দে.: অদূর ভবিষ্যতে ফারাক্কা পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন কি আসতে পারে?
হক: অবশ্যই, সবসময় এরকম চলে নাকি? প্রকৃতির একটা মার আছে। এটা তো প্রকৃতিবিরোধী একটা কাজ। দশ বছরে হোক বা একশ বছরে হোক, ভালো একটা মার দেবে। তবে ভালো নেতৃত্ব আমাদের এখানে আসলে তারা ভারতের সঙ্গে একটা সম্মানজনক চুক্তি করতে পারে। এখনো করতে পারে।
সা.দে.: ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী দলের নেতারা ১৬ মে প্রশ্নে ফারাক্কা নিয়ে কোথাও কি একটু নীরবতা পালন করেন না?
হক: ১৬ মেতে যা করেন সেটা আনুষ্ঠানিক, কার্যকর কিছু না। আজকাল তো সব কিছু হয়ে গেছে আনুষ্ঠানিক। এদের আন্দোলনগুলোও হয়ে গেছে আনুষ্ঠানিক।
সা.দে.: নদীর সঙ্গে কৃষকের একটা সম্পর্ক আছে, শেষপর্যন্ত কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?
হক: শুধু কৃষক নয় জীব জীবন, প্রকৃতি জীবন সমস্ত কিছুই নদীর সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।