-66cdbf99026e5.jpg)
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও অধ্যাপক ড. একরামুল কবির। ছবি: সংগৃহীত
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর সংকটময় অবস্থায় দেশের হাল ধরেছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রশাসনে সংস্কারের কাজও শুরু করেছেন তারা। সদ্য গঠিত সরকারের দুই শিক্ষা উপদেষ্টা ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন শিক্ষা নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা। তাদের এই পরিকল্পনায় নানা প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. একরামুল কবির। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেলিম আহমেদ।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধে সমস্যা আরও বাড়বে
এক সময় যে ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসে ছাত্রদের ভ্যানগার্ড হয়ে থাকত সেই ছাত্ররাজনীতি এখন ক্যাম্পাসে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত দুই যুগের বেশি সময় থেকেই দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নেই রাজনৈতিক সহাবস্থান। যে দল যখন ক্ষমতায় ছিল তাদের ছাত্র সংগঠনের দখলে ছিল ক্যাম্পাসগুলো। বিশেষ করে গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে হত্যাযজ্ঞ, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, ছাত্রী নিপীড়ন, বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আতঙ্কের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছিল। ফলে সাধারণ ছাত্ররা রাজনীতি বিমুখ হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সচেতন নাগরিক সমাজও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন রাখছেন। এর মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করাই কি সব সমস্যার সমাধান-এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ রাজনীতিবিদ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে-এটা কোনো সমাধান নয়। বরং এতে সমস্যা আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্ররাজনীতি কম। এটা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। তবে দেশে ছাত্ররাজনীতির নামে যেটা হচ্ছে তা হলো দলীয় মস্তান পোষা। সেটা বিএনপি-আওয়ামী লীগ-উভয় দলই করেছে। প্রকৃত ছাত্ররাজনীতি হলো যা রাজনৈতিক সচেতনতার ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়। এই ছাত্ররাজনীতি আগাগোড়াই ইতিবাচক। কিন্তু সেটার ওপর নানা অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে পচন ধরেছিল। এটাকে বাধামুক্ত করতে পারলে সৃজনশীল শক্তির প্রকাশ ঘটবে। যেটা সম্প্রতি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে।
সাবেক এই ছাত্রনেতা আরও বলেন, যারা প্রকৃত ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা বলে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। যেটা হয়তোবা বিরাজনীতিকরণের সাম্রাজ্যবাদ ফর্মুলা কার্যকর করা। রাজনীতিবিমুখকরণের মধ্য দিয়ে এনজিও ইত্যাদির মাধ্যমে দেশ গড়তে চায়। এটা হয়তো আমেরিকার একটা প্ল্যান। তারা বিভিন্ন দেশে নয়া উদারবাদী দর্শন প্রণয়ন করেছে, সেটা বাংলাদেশেও প্রণয়ন করার চেষ্টা করছে।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি
সামাজিক অবস্থা বিচার করে কারিকুলাম তৈরি করতে হবে
চালুর দুই বছরের মাথায় আবারও বাতিল হচ্ছে চলমান কারিকুলাম। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। পুরনোটায় ফেরত যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তবে কোন কারিকুলামে ফিরে যাওয়া হবে তা পরিষ্কার করেননি। এর আগে সৃজনশীলসহ একাধিক শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করা হলেও তা টেকেনি।
কারিকুলামের স্থায়ী সমাধান কী-এমন প্রশ্নে ড. একরামুল করিম বলেন, স্থায়ী সমাধান হলো আমাদের দেশে উপযোগী কারিকুলাম বাস্তায়ন করতে হবে। বাইরে থেকে একজন একটা কিছু দেখে এলো আর সেটা প্রয়োগ করল, তা ঠিক হবে না। বিচার করতে হবে আমাদের দেশের জনগণ, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জন্য সেই কারিকুলাম উপযোগী কি না। সেটা করতে না পারলে গিনিপিগের মধ্যে থেকে যাবে।
তিনি বলেন, কারিকুলাম প্রণয়নের আগে আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থাকে বিচার করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। দেশীয় ঐতিহ্য থাকবে এবং দেশের ও বিদেশের কর্মসংস্থান অনুযায়ী কারিকুলাম তৈরি করতে হবে। সিলেবাসে কর্মচাহিদাকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।
পরবর্তী ৫০ বছরের চিন্তা করে কারিকুলাম তৈরি করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু স্টান্টবাজি নয়, দেশ-বিদেশ দেখে দীর্ঘ সময় যাবৎ উপকার মিলবে এমন চিন্তা করে কারিকুলাম তৈরি করতে হবে। আজকে যে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হবে, তার কাছ থেকে ফিডব্যাক মিলবে ১৭-১৮ বছর পর একাডেমিক পড়াশোনা শেষে। এরপর আরও ৩০-৩৫ বছর পর তার কাছ থেকে সার্ভিস নেব। তাই ৫০ বছর পর কী হবে সেই চিন্তা করেই কারিকুলাম তৈরি করতে হবে।
কারিকুলামে ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ বলেন, কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ব্যবসায়ীদের। তাদের কী চাহিদা, দেশের বাইরে থেকে কী রিকোয়ারমেন্ট, সেগুলো বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি কারিকুলামে জেনারেল সাবজেক্টগুলোও রাখতে হবে। একটা সময় পর্যন্ত জেনারেল এডুকেশন পড়িয়ে তারপর ভাগ করতে হবে। দেশে এত জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন নেই।
অধ্যাপক ড. একরামুল কবির
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির সদস্য