সৃজনশীলতা শৃঙ্খলিত বাস্তবতার বিপক্ষে কাজ করে, মুক্তির উপায় খোঁজে: ঢালী আল মামুন

জাহিদ মুস্তাফা
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৫:০৮

চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন। ছবি: সংগৃহীত
চিত্রশিল্পী ঢালী আল মামুন, জন্ম ১৯৫৮ সালে চাঁদপুর জেলায়। তিনি ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে জার্মান সরকারের বৃত্তি নিয়ে চারুশিল্পে উচ্চতর ডিএএডি কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি তিনি অবসর নিয়েছেন।
আশির দশকে বাংলাদেশের শিল্পীদের একটি দল প্রাচীন পথ থেকে দূরে সরে এক নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেছিল। ওই দলটির নাম ছিল ‘সময়’। আর এই ‘সময়’ দলটির অন্যতম নেতৃত্বস্থানীয় একজন হলেন ঢালী আল মামুন। আরও ছিলেন নিসার হোসেন, আজিজ শরাফী, ওয়াকিলুর রহমান, দিলারা বেগম জলি, হাবিবুর রহমান, শিশির ভট্টাচার্য্যরে মতো শিল্পীরা। যারা বিমূর্ত চিত্ররীতির জেঁকে বসা আধিপত্যের বিরুদ্ধে বীতস্পৃহ হয়ে পড়েছিলেন। তাদের প্রতিবাদ কেবল চিত্ররীতির বিরুদ্ধেই ছিল না। তাদের মনে হয়েছিল, সেই চিত্ররীতি দেশের সমকালীন ইতিহাসের অভিজ্ঞতাকে নাকচ করে দিচ্ছে, শিল্পকর্মকে পর্যবসিত করেছে ক্যানভাসের নিছক উপরিতলের বর্ণভঙ্গিমায়।
গুণী এই শিল্পীর সঙ্গে তার নিজস্ব শিল্পভাবনা, সমকালীন দেশীয় শিল্পচিন্তাসহ এদেশের শিল্প বিষয়ে নানা কথা বলেছেন চিত্রশিল্পী ও শিল্প সমালোচক জাহিদ মুস্তাফা।
তরুণ বয়সে সতীর্থ শিল্পীদের সঙ্গে ‘সময়’ নামের একটি আর্টিস্ট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেটা প্রচলিত শিল্পধারার বিরুদ্ধে আলাদা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। সে প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হয়েছে বলে মনে করেন?
সফল কিংবা ব্যর্থতার কথা বলা কঠিন, কারণ আমি নিজেই ঘটনা প্রবাহের অংশ এবং নিজের দেহ নিজের পক্ষে সম্পূর্ণ দেখা সম্ভব নয়; আয়নার মাধ্যমে বা অপরের মাধ্যমে দেখতে হয়, বুঝতে হয়। তা ছাড়া সফলতা, ব্যর্থতা-এত সব চিন্তা নিয়ে ব্যাপারটি ঘটেনি। ঘটেছে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রজন্মের উপলব্ধিতে, বড় কিছু হয়েছিল কিনা বলতে পারব না; তবে একটা উৎক্রান্তি যে ঘটেছিল তা বোধগম্য, উৎক্রান্তি হচ্ছে-বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাঁক নেওয়া। স্বাধীনতা লাভের দশকেই চারুকলায় আমাদের পাঠ গ্রহণ শুরু। নতুন দেশ নতুন পরিস্থিতিতে তৎকালীন সমসাময়িক দৃশ্যকলার চর্চা আমাদের উপলব্ধি, অভিজ্ঞতা ও বুঝব্যবস্থার অনুকূল ছিল না।
যে আধুনিকতাকে ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে আমরা পেয়েছি তার রূপ বৈশিষ্ট্য এক রকম। অন্যদিকে পশ্চিমের আধুনিকতা সর্বত্র এক রকম নয়, স্থান-পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন এবং তার মধ্যে স্ববিরোধও ছিল। আসলে একক সত্তানির্ভর, বিশুদ্ধতা, হোমোজিনিয়াস, বিশেষায়িত বস্তুসত্তা এবং আঙ্গিকসর্বস্ব বা রীতি আনুগত্য কখনো কখনো পশ্চিমের দৃশ্যকলাকে তল বা সার্ফেসনির্ভর করে তুলেছিল। আবার কখনো তার মধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে বহু অঞ্চলের বহু জাতির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য কিংবা পুনর্বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ইতিহাসকে, উল্লেখিত লক্ষণগুলোর কিছু অনুষঙ্গ আমাদের আধুনিক শিল্পীদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু সেই সময় সমাজ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি এবং বুঝব্যবস্থায় তাদের বিষয় ভাবনা ও ভাষাভঙ্গির কাঠামো পরিমণ্ডল প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি।
প্রত্যাশা ছিল, বাস্তবতার যেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম তার প্রতিবিম্ব বা প্রতিরূপ যেন আমাদের দৃশ্যকলায় হাজির থাকে, বিষয় ও ভাষা উভয়ক্ষেত্রেই। বাস্তবতা ও পরিমণ্ডল প্রাসঙ্গিক ভাষার সঙ্গে নতুন কিছুর সন্ধান করা এবং যা আমাদের মনে হয়েছে তা প্রয়োগ করার চেষ্টা হয়েছে। সেটি এখনো ক্রমাগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যক্তিবিশেষে সহযাত্রী যারা সৃজনশীল চর্চার পরম্পরায় এখনো যুক্ত আছেন তাদের মধ্যে অব্যাহত আছে। তা ছাড়া সৃজন কর্মের বাইরে অনেকেই নানাভাবে ভূমিকা পালন করছেন। যেমন-শিক্ষকতাসহ শিল্প বিষয়ক পত্রিকা, বিকল্প গ্যালারি ইত্যাদি এবং সেই সব কর্মকাণ্ডেরও গুরুত্ব কম নয়।
বিশ্বজুড়ে আধুনিক ও সমকালীন চারুশিল্পের অনেক প্রদর্শনী দেখেছেন এবং আন্তর্জাতিক শিল্পায়নে আপনি নিজেও অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্বশিল্পের বৃহৎ পরিসরে আমাদের সমকালীন চারুশিল্পের তুলনামূলক অবস্থান কেমন এবং মানোন্নয়নের জন্য কী কী করা উচিত বলে মনে করেন?
এ প্রশ্নটা খানিকটা বিপজ্জনক; প্রথমত-নিজেকে বিচারক হিসেবে বিবেচনা করা এবং আমি কখনো বিচারকের চেয়ার গ্রহণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। একটি বিষয় হলো-পর্যালোচনা নিশ্চয়ই জরুরি; আরেকটি হচ্ছে তুলনামূলক আলোচনা, সেটা একটি বিস্তৃত প্রেক্ষাপট। ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত, পরিমণ্ডল ও বাস্তবতার গতিপথ ভিন্ন। ফলে আন্তর্জাতিকতা কিংবা সর্বজনীনতা ইত্যাদি বিষয়কে কীভাবে বুঝব আমাদের স্থানিক বাস্তবতার প্রেক্ষিত ব্যতিরেকে। যা সাধারণত বুঝে থাকি, তার ভৌগোলিক অবস্থান ও বুদ্ধিমত্তার মানদণ্ড উভয়ই পশ্চিমের আধুনিক জ্ঞানকাণ্ড থেকে উৎসারিত এবং নির্ধারিত। ফলে আন্তর্জাতিকতা কিংবা বিশ্বজনীনতা বলতে আমরা কী বুঝি বা বোঝতে চাই তার ব্যাখ্যা ও পর্যালোচনা প্রয়োজন।
অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতার প্রকল্পে এই আধুনিকতা হয়ে উঠেছে শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বয়ান। আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমের শিল্পকলাকে যদি ধরে নেই, লক্ষ করা যাবে তার অভ্যন্তরেও বিশেষ পশ্চিম অঞ্চলের কর্তৃত্ব শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে বিভেদ-বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। এই বিশেষ পশ্চিমের শিল্পের আধুনিকীকরণ কৌশল ও নন্দনতত্ত্ব, পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপনের এবং রুচি নিয়ন্ত্রণের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
হীনমন্যতায় উৎকৃষ্ট বিবেচনা করে আমরা এই আধুনিকতাকে গ্রহণ করেছি এবং তার আদলে রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ ঐতিহাসিক বাস্তবতায় পরিমণ্ডল বিচ্ছিন্ন চিন্তাকাঠামো, শিল্পচিন্তা, দেখার ধরন ও নিয়মনীতি ইত্যাদি ধারণ করতে হয়েছিল ঔপনিবেশিক প্রকল্পের অংশ হিসেবে। আর আধুনিকতার বয়ান তার গ্রাহ্যতা প্রদানকারী। এই আলোচনাটি করতে গেলে বিষয়টি জটিল হয়ে পড়বে, সংক্ষেপেও সম্ভব নয়। পশ্চিমের সমসাময়িক শিল্পকলার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে বাস্তবতা অনুযায়ী তুলনা করতে হবে আর এই তুলনাটা করতে গেলে বিপদের মধ্যে পড়তে হয়। কারণ গত ৫০০ বছরে জ্ঞানকাণ্ডের সমান্তরালে তারা শিল্পকলাকেও শ্রেষ্ঠতম মানদণ্ড হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। পশ্চিমের এই শ্রেষ্ঠত্বের বৈশিষ্ট্য পরিমণ্ডলের প্রাসঙ্গকিতায় পর্যালোচনা প্রয়োজন রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের একটা বড় সংকটের জায়গা হচ্ছে শিল্পবিদ্যা শিক্ষা। যেখানে নেই পরিমণ্ডল, প্রাসঙ্গিক পাঠ্যক্রম এবং জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে পর্যালোচনার উপস্থিতি। আমাদের পাঠ্যক্রম থেকে শিল্পবিদ্যা শিক্ষণ পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি হওয়া আবশ্যক। বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলের বাইরের সঙ্গে সংযোগ দরকার। যারা প্র্যাক্টিস করে এবং বিদ্যায়তনিক পাটাতন-এ দুটির একটি সেতু জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ দেখা যাচ্ছে, আমাদের বিদ্যালয়গুলো বা বিদ্যায়তনিক পাটাতন একদিকে ধাবিত হচ্ছে কিংবা তুলনামূলকভাবে একই রকম রয়ে গেছে। অন্যদিকে যারা সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত তারা ক্রমাগত একটি সীমানাকে অতিক্রম করতে সচেষ্ট। ফলে এ দুইয়ের সমন্বয় জরুরি। তা ছাড়া বেশ কিছু দ্বন্দের বা প্রশ্নের সুরাহা হয়নি-এই শিক্ষা কতটা জীবিকার উপযোগী কিংবা সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে সমসাময়িক জ্ঞানকাণ্ড এবং পরিমণ্ডল প্রাসঙ্গিক ইত্যাদি।
যেহেতু শিক্ষকতা করেছেন, শিক্ষকতার একদম সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এসেছেন, সমসাময়িক যারা আছেন শিক্ষাবিদ, যারা চারুকলার শিক্ষা নিয়ে ভাবছেন, যে ভাবনাটা আপনি বললেন সেটা কি পরবর্তীকালে কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রমের দিকে ধাবমান করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ আছে বা ছিল কি?
প্রেক্ষাপটের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে; উপরন্তু বিষয়টি নিয়ে এককভাবে উদ্যোগ নিলে কোনো কিছু করা সম্ভব না, এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক অংশীদারত্বের বিষয় রয়েছে। অপ্রতুল হলেও কিছু যে হয়নি তা বলা যাবে না। যেমন-চট্টগ্রাম চারুকলার উচ্চ শ্রেণির পাঠ্যক্রমের বৈশিষ্ট্য ইনভেস্টিগেটিভ এবং সাম্প্রতিক সময়ে আন্তঃকলা বিদ্যার কোর্স স্বল্প আকারে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমার জানা মতে ঢাকা চারুকলায়ও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টি এমন নয় যে রাতারাতি পাল্টে দেওয়া যাবে, এর সঙ্গে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং প্রাসঙ্গিক বাস্তবতা রয়েছে। বিশেষ করে চারুকলায় পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা প্রথমত যে পাঠ্যক্রমের বিদ্যাশিক্ষা গ্রহণ করে আসেন তার সঙ্গে চারুকলার সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে পারিবারিক এবং সামাজিক সংস্কৃতিতেও চারুকলা বা সৃজনশীলতার উপস্থিতি নেই। আর্ট গ্যালারির কথা বাদই দিলাম; কিন্তু কয়টি শহরে মিউজিয়াম আছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করতে হয়। এই শিক্ষা সাধারণ শিক্ষার মতো নয়। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে দেখতে হয়, পরিচর্যা করতে হয়।
বহুদিনের বোঝা যখন আমরা বহন করে চলেছি; এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিংবা প্রাসঙ্গিক পরিস্থিতির প্রশ্নে ক্রমাগতভাবে সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। এটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় হলেও চলবে না, এর মধ্যে বহুমাত্রিকতা রয়েছে, শিল্প শিক্ষা ও চর্চাকে কেন্দ্র করে সামগ্রিকভাবে আন্তঃকলাবিদ্যা শিক্ষার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরি করা প্রয়োজন। যেখানে বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজও গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
এটা নিয়ে আলোচনা, ওয়ার্কশপ বা এ রকম কোনো কিছু হয়েছে কিনা?
বিষয়টি একক কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দায়মুক্তির নয়। বিষয়টি বাস্তবতা ও পরিস্থিতি পর্যালোচনার এবং উত্তরণের প্রশ্ন। ফলে আলোচনা বা ওয়ার্কশপের যেমন প্রয়োজন রয়েছে; একই সঙ্গে প্রায়োগিক পরিকল্পনা এবং প্রয়োগকারীদের মানোন্নয়নের প্রশ্নটিও জরুরি। সৃজনশীলতা এবং গবেষণার কাজের সঙ্গে শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা তুলনামূলকভাবে কম, অধিকাংশ শিক্ষকই চিন্তা-চেতনায় চাকরিজীবী। কলা-বিদ্যা শিক্ষায় পাঠ্যক্রমের সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং যারা গ্রহণ করবেন, ধারণ করবেন তারাও এর অংশীদার। ফলে এর একটি আন্তঃসম্পর্কিত সামগ্রিকতা রয়েছে।
সৃজনশীল লোকদেরকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে একজন অগ্রজ শিল্পী হিসেবে আপনি আবেদন করতে পারেন যে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত...
সরকারের কর্ম পরিকল্পনার সঙ্গে সমাজ বা কমিউনিটি সকলেরই ভূমিকা রয়েছে, এটা ঠিক রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও প্রায়োগিক ব্যবস্থাপনায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ কল্যাণসহ নানা ক্ষেত্রে পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অনেক কিছু পাল্টে দেওয়া সম্ভব। তার ফলে হয়তো নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলাফল হিসেবে নতুন নতুন প্রজন্ম দৃশ্যমান হবে, যাদের চেতনা ও বৈশিষ্ট্য পরিকল্পনার প্রত্যাশা অনুযায়ী হতে পারে। শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্য নিশ্চয়ই সংবেদনশীল সমাজ। কিন্তু সমান্তরালভাবে মানব ও মানবিকতার উন্নয়ন না ঘটলে তা স্থিতিশীলতা পাবে না। স্বাভাবিকভাবে সৃজনশীলতা এবং মুক্তচিন্তার সংস্কৃতি তার রাজনৈতিক দর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা নয়, ঐতিহাসিক কারণে তার দায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতিকে শিক্ষণবিদ্যা (প্যাডাগোজি) থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই।
আপনার প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতায় বলছি, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মার্কিন মুল্লুকে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। যা আমেরিকান গ্রেট ডিপ্রেশন বলে পরিচিত এবং এই ডিপ্রেশনের ফলে অন্য অনেক পেশার নাগরিকদের মতো সৃজনশীলতার বিভিন্ন শাখা ও পেশার মানুষরা বেশ বেকায়দায় পড়েছিলেন। ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন সম্মিলিতভাবে, সৃজনশীল লোকদেরকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্র যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তা আজও প্রণিধানযোগ্য! সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি করা সাময়িক চাকরির ব্যবস্থা, হেলথ কেয়ার এবং নানা ধরনের প্রণোদনা ছিল। লোকাল আর্ট কাউন্সিলসহ নানা সামাজিক সংগঠন ওই সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। লেখক, থিয়েটারকর্মীসহ শিল্পীদের নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে জনশিল্প (Public Art) অন্যমাত্রায় পৌঁছেছিল, যার বহুমাত্রিক অভিক্ষেপ ছিল। কারণ তখনকার রাষ্ট্রীয় সংস্থা ওয়ার্ক প্রোগ্রেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডব্লিউপিএ) বিশ্বাস করত, সৃজনশীলতা, দক্ষতা এবং আত্মসম্মান বিষয়সমূহের সংরক্ষণ প্রয়োজন। এই সব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি সংবেদনশীল সমাজে সৃজনশীলতার আবশ্যকতা এবং সমাজ বিকশিত হওয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।
রাষ্ট্র পরিচালনার ভূমিকা যখন ক্ষমতার রাজনীতিকে ছাড়িয়ে সমাজ-স্থপতিতে রূপান্তর হয়, স্বাভাবিকভাবে তাতে দূরদর্শী পরিকল্পনা প্রবিষ্ট থাকে। যার মধ্যে দৃশ্যমান থাকে নাগরিকের ভবিষ্যৎ জীবন-যাপনের নানা বৃত্তান্ত এবং নির্মাণের প্রায়োগিক নকশা। সে রকম জায়গা থেকে দেখলে আমাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্ম পরিকল্পনা ও কর্মযজ্ঞ থেকে তার রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শনের রূপরেখা বোঝা যাবে হয়তো!
চারুশিল্পে নিউ মিডিয়ার আবির্ভাব এবং আর্টিস্ট পারফরম্যান্স, স্থাপনা শিল্প-এসব কন্সেপচুয়াল আর্ট এখন বিশ্ব শিল্পের প্রধান অনুষঙ্গ। দেশে এই উত্তর আধুনিক শিল্প-দর্শনের একজন একক দাতা, তবে এ দেশের চারুশিল্পে নিউ মিডিয়া আর্টের চর্চা ক্ষেত্র এখনো এত সীমিত কেন?
বিচ্ছিন্নভাবে শিল্পকলার জগৎকে দেখলে হবে না। সামগ্রিকভাবে সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিদ্যায়তনিক পাটাতন সবটা মিলিয়েই। বিষয়টি এককভাবে শুধু শিল্পীদের দায় তা নয়। আমাদের এখানে শিল্পের চর্চা কিংবা প্রধান ধারার শিল্পের চর্চা-এক অর্থে এখনো ট্র্যাডিশনাল ফর্মে রয়েছে, কারণ সমাজে এর খানিকটা হলেও অ্যাপ্রিসিয়েশন রয়েছে। বাস্তবতার কারণেই নিউ মিডিয়া আর্ট বা মাধ্যমে খুবই কম সংখ্যক শিল্পী যুক্ত। নতুন মিডিয়া, নতুন মাধ্যম-এখানে অনেকগুলো বিষয় রয়েছে, আমরা যদি বিশ্বশিল্পের গতিপথ লক্ষ করি, বাস্তবতার সঙ্গে প্রযুক্তির সমান্তরালে শিল্প নির্মাণের ধরন ধারণের সঙ্গে দেখা, দৃষ্টি, বিক্ষণেরও পরিবর্তন ঘটেছে এবং অন্যান্য শৃঙ্খলার জ্ঞানকাণ্ড যেমনি বিকশিত হয়, তার অভিঘাত কিংবা তার সংমিশ্রণও এখানে ঘটে। ফলে আমাদের দেখার ধরনে এবং ধারণায়, ভাষা বা ভাব প্রকাশের ভঙ্গিও ক্রমাগতভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে, এটি একটি ক্রমবর্ধমান যাত্রার বা গতিপথের বৃত্তান্ত। সেই জায়গা থেকে পশ্চিমের শিল্পীরা আধুনিকতার প্রথমভাগে অক্ষিপট নির্ভর দৃশ্য অভিজ্ঞতার সাদৃশ্য রচনা করতে চেয়েছেন। পরবর্তীকালে প্রযুক্তি ও নানা জ্ঞানকাণ্ডের সংমিশ্রণ ধারণা বিবর্তিত হতে থাকে এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা থেকে বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা বড় হয়ে উঠল। একটা পর্যায়ে এসে অক্ষিপট নির্ভরতা এবং দৃশ্য জগতের সাদৃশ্য থেকেও শিল্পীরা মুক্তি পেতে চেয়েছে। সেটারই একটি উপায় হচ্ছে বিমূর্ততা ও নন-অভজেক্টিবিটি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে পশ্চিমে শিল্প নির্মাণ বা চর্চা ক্রমেই পারসেপচুয়াল জায়গা থেকে কনসেপ্টচুয়াল হয়ে উঠেছে, যেখানে শিল্পের দেহ বা রূপের চেয়ে ধারণা বা আইডিয়া কিংবা দেখার চেয়ে চিন্তা প্রধান হয়ে ওঠে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা থেকে বুদ্ধিমত্তায় রূপান্তর। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য শিল্প দর্শক উপলব্ধি করবেন; কিন্তু তার ভূমিকা নিষ্ক্রিয় থাকবে। অন্যদিকে বুদ্ধিমত্তা নির্ভর শিল্প বা কনসেপ্টচুয়াল আর্টের দর্শকের নিকট প্রশ্ন উপস্থাপন করে, যা দর্শকদের আত্মসচেতন করার ভূমিকা রাখে বা অংশীদারত্ব দাবি করে।

পারফরম্যান্স আর্ট বুদ্ধিমত্তা নির্ভর বা কনসেপ্টচুয়াল আর্টেরই সম্প্রসারণ। বর্তমান সময়ে ধরিত্রী যে সংকটের মধ্যে রয়েছে, আমরা নতুন ভূতাত্ত্বিক যুগে প্রবেশ করেছি যাকে অ্যানথ্রোপোসিন বলে এ রকম একটি জটিল বৈশ্বিক ব্যবস্থা যার প্রভাবের প্রমাণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেখানে শিল্প নির্মাণ প্রক্রিয়া, প্রকরণ, উপাদান ইত্যাদিরও এই নতুন বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিতে হবে, পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক, ধরিত্রী-বান্ধব কিনা সে বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। অন্যদিকে দেহ বা বডি-এই সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে ভাবনার এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। সেই বডিই পারফরম্যান্স আর্টের মাধ্যম বা শিল্পীর ভাবনা এবং উপলব্ধি প্রকাশের উপায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিল্পী নিজের দেহকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন, যা দর্শকদের সরাসরি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উপভোগ করতে হয় অথবা দ্বিতীয় উপায় ভিডিও সংস্করণ। কিন্তু এর মূল শিল্পকর্ম সংরক্ষণের কোনো উপায় নেই যা এক অর্থে ধরিত্রীর জন্য মঙ্গল। সেই ক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতার উপযোগিতায় পারফরম্যান্স আর্ট ভাব ও উপলব্ধি প্রকাশের এক যথাযথ উপায়।
কিন্তু আমাদের এখানে চর্চাটা কেন কম হচ্ছে বলে মনে করেন?
সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে দৃশ্যকলা সম্পর্কে আমাদের সমাজ বা অধিকাংশ মানুষের ধারণা এবং সংরক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি-এই সব মিলিয়ে সমাজের মধ্যে চাহিদা এবং প্রত্যাশা জাগায়। আধুনিকতা এক অর্থে শিল্পকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ঠিক তার আবার বিকল্প বাস্তবতা পশ্চিমে তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে হয়নি; বরং বাস্তবতা আরও জটিল হয়েছে। স্মরণ রাখতে হবে পশ্চিমের শিল্প চর্চা তাদের চিন্তা কাঠামো ও উৎপাদন ব্যবস্থার সমান্তরাল। আগে আমাদের এখানে যে শিল্প সম্মিলিত প্রয়াসের চর্চায় সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে একই বৃত্তে বাঁধা ছিল। কিন্তু ক্রমে আধুনিকতা এসে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিল এবং শিল্প চর্চাও একক প্রণেতার একক সত্তায় আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। সমাজের মধ্যে এখনো শিল্পবোধ, শিল্প চেতনা কিংবা সংবেদনশীলতার যে মানদণ্ড রয়েছে নানা টানাপড়েনে তার সঙ্গে শিল্পচর্চা হয়তো সংযোগ স্থাপন করতে পারে না।
এই সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের শিল্পকলার কি তেমন বাজার আছে? যেখানে পেশাজীবী হিসেবে শিল্পীরা জীবন-ধারণ করতে পারবেন। শিল্পের বাজার বলতে, পশ্চিম আমাদের কাছে যে উদাহরণ এবং প্রণিধান সাজিয়েছে, সে তুলনায় অন্যান্য অনেক কিছুর মতো এখানে তেমন কোনো বাজার নেই। পাশের দেশ ভারতে শিল্পের যে বাজার রয়েছে তার সঙ্গেও তুলনা করা চলে না। কারণ গ্যালারি, সংগ্রাহক, সামাজিক চাহিদাসহ আনুষঙ্গিক অনেক কিছুই এখনো প্রত্যাশা অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি। ফলে এটি হচ্ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতার অংশ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। শিল্পের শিক্ষকতা কতটুকু উপভোগ্য আর নিজের শিক্ষকতায় কতটুকু তৃপ্ত?
আমি যে শিক্ষক হয়ে উঠব সে রকম কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা ছাত্রজীবনে ছিল না। বিএফএ করার পর চারুকলা কলেজে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছিলাম, এটা ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে এবং পরিস্থিতিই আমাকে ত্বরান্বিত করেছে। শিক্ষকতায় প্রবেশ করার পর ক্রমেই তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। নিজেকে নির্মাণ করার অন্য এক অধ্যায়, নিজের অক্ষমতাকে বোঝার ভিন্ন এক উপায়, জ্ঞান অর্জন সৃজনশীলতার উপলব্ধি আরও গভীর হলো। তরুণদের সঙ্গে থাকার সুযোগের ফলশ্রুতিতে নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া এবং নতুন পরিস্থিতিতে নতুন চিন্তার সঙ্গে বসবাসের সুযোগ পাওয়া। এদিক থেকে নিজেকে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত মনে করি, ফলে গত প্রায় তিন যুগ ধরে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলাম। এ তিন যুগে প্রাপ্তি অনেক, আমি কি শিক্ষাদান করেছি বা শিক্ষার্থীরা আমার কাছ থেকে কী পেয়েছে তা শিক্ষার্থীরা ভালো বলতে পারবে, আমার পক্ষে বলা কঠিন। আমি বরং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি এবং এই প্রতিষ্ঠান আমার সত্তা নির্মাণের সহযোগী। শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আদান-প্রদানের বিষয়টি ভীষণভাবে উপভোগ্য ছিল। অতৃপ্তি বোধের জায়গা সব সময় ছিল, যথার্থ অর্থে তৃপ্ত হয়েছি, বলা কঠিন। আমার মনে হয় আরও অনেক কিছু করার ছিল, যেটি হয়তো করতে পারিনি। এ রকম একটি অতৃপ্তিবোধ সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়, মনে হচ্ছে অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল যা করে উঠতে পারিনি।
অনেক শিক্ষার্থীই বলেন, আমরা অনেক কিছু মামুন স্যারের কাছ থেকে নিয়েছি। আপনাকে নিয়ে তাদের একটা আবেগের জায়গা আছে...
শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের এক ধরনের ভালোবাসা বা পক্ষপাতিত্ব থাকতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে অনেক অপূর্ণতা ও অতৃপ্তি রয়েছে। বরং বলা ভালো আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।
ভারতীয় শিক্ষা-দর্শনে শিল্প-সংস্কৃতি শিক্ষা গুরুমুখী বিদ্যা হিসেবে প্রচলিত। আমরা এ শিক্ষা-দর্শনের উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দী থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীতেও পাশ্চাত্যের শিল্প শিক্ষা পদ্ধতিতে পাঠ নিতে হচ্ছে। আপনি শিল্প শিক্ষার এ দুটি পাঠের সঙ্গে পরিচিত, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনটি বেশি কার্যকর বলে মনে করেন?
বিষয়টির কোনো সহজ সমাধান নেই-এটি নিরন্তর প্রচেষ্টার অংশ! বর্তমান বাস্তবতায় ব্যক্তির স্বতন্ত্রতাকে কি আমরা বাদ দিতে পারব, গুরুমুখী শিক্ষার সঙ্গে পরম্পরা, উত্তরাধিকারের সম্পর্ক রয়েছে। এর বিপরীতে বর্তমান পদ্ধতিতে ব্যক্তির স্বতন্ত্রতা, ফলে এটি হচ্ছে বাস্তবতা এবং উপযোগিতার প্রশ্ন। ইতিহাসকে বারংবার পাঠ করা প্রয়োজন অতীত অভিজ্ঞতাকে জানার জন্য এবং বর্তমান সময়ের সঙ্কট বা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য। যে শিক্ষণ পদ্ধতি প্রবহমান রয়েছে তা ঔপনিবেশিক সময়ে প্রবর্তিত প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির পরম্পরা, যা এখন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। এটি এখন বাস্তবতা, এর পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন এবং এর মধ্যে বিদ্যমান সঙ্কট বা সমস্যাকে চিহ্নিত করা-যার পরিপ্রেক্ষিতে কলাবিদ্যা শিক্ষণের পরিমার্জন, পরিবর্ধন করা যায়। ইতিহাস এবং আমাদের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে তার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী, কিংবা এর সঙ্গে কোন জায়গাটি সাংঘর্ষিক, এটা বিশ্লেষণ জরুরি। এখন গুরুশিক্ষা পদ্ধতি-আসলে ওরকম যে শিক্ষাপদ্ধতি ছিল সেটি মূলত কতগুলো প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ধর্মীয় কতগুলো প্রতিষ্ঠান, জায়গার মধ্যে ছিল। সাধারণ বিদ্যালয়ে সে রকম শিক্ষা পদ্ধতি খুব বেশি যে পাওয়া যায়, সে বিষয়ে অন্ততপক্ষে আমার ধারণা নেই।
এই যে মক্তব বা আরও যে ছিল বিভিন্ন জায়গায়, আগে আরকি...
সেটার তো কোনো পরম্পরা তৈরি হয়নি, মূলত এর উপযোগিতা নেই। প্রাচীন ভারতে ছিল অপরাবিদ্যা, একটি পরম্পরা রয়েছে যেটি গুরুশিক্ষা না হোক পারিবারিক পরম্পরা। যেটি লোকায়ত শিল্পকে কেন্দ্র করে রয়েছে সেই শিক্ষা পদ্ধতি এক রকমের। আমরা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারী হিসেবে বা আধুনিকতার উত্তরাধিকারী হিসেবে যে শিক্ষা পদ্ধতিটা পেয়েছি তা কলকাতা আর্ট কলেজের মধ্য দিয়ে কিংবা ব্রিটিশ ভারতে প্রতিষ্ঠিত শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরম্পরা হিসেবে। বর্তমানে আমাদের প্রধান ধারার শিল্প চর্চা তারই উত্তরাধিকার বলা যায়। একটা পরম্পরাগত ব্যবস্থা রয়েছে লোকায়ত শিল্প। ফলে এই জায়গা থেকে এ আধুনিক সময়েও কিছু শিক্ষা পদ্ধতি ছিল যে একজন শিক্ষার্থী ইচ্ছা করলে একজন শিক্ষককে তার শিক্ষাগুরু হিসেবে মেনে নিতে পারে। কিন্তু ভারতের যে শাস্ত্রীয় গুরু বিদ্যা বা গুরু-শিষ্যের যে সম্পর্ক; গভীর অর্থে তার সঙ্গে এর সম্পর্ক বা মিল নেই। সমসাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা অনেকটাই হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্কের মতো অনুক্রমিক নয়, আমরা যে শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত সেখানেও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে হয়ে ওঠে।
কে জি সুব্রামানিয়ামের অধীনে কয়েকজন শিক্ষার্থী কাজ করতেন, তার মাস্টার্সের কাজ উনিই করতেন আরকি...
ওই রকম বিষয় এখনো আছে, তা ঠিক গুরু-শিষ্যের ধারণার মধ্যে পড়ে না। এখানে শিষ্য নিরবচ্ছিন্ন পরম্পরা বা উত্তরাধিকার নয়। শিষ্যের প্রশ্ন এবং তর্ক করার অধিকার আছে। গুরু এখানে শিষ্যের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা এবং বুঝব্যবস্থা শেয়ার করেন যাকে মেন্টর, তত্ত্বাবধায়ক বা সহায়তাকারী বলা যায়; উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর মধ্যে বিদ্যমান সম্ভাবনার বিকাশ। এই ক্ষেত্রে অধ্যাপক সুব্রামানিয়াম এবং এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি শোনা গল্পের কথা বলতে পারি-সুব্রামানিয়াম কোনো এক শিক্ষার্থীর স্টুডিও যথানিয়মে পরিদর্শনকালে তার শিল্পকর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেন, ফলে শিক্ষার্থী বেশ অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত হন। কয়েক সপ্তাহ পর অগ্রগতি দেখার জন্য আবারও তার স্টুডিও পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন যে ছেলেটি তার শিল্পকর্মের অনুকরণ করা শুরু করেছে। তখন উনি তাকে বললেন, আমি শুধু তোমাকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছিলাম, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছ।
ফলে ওই জায়গা থেকে সুব্রামানিয়াম; কিন্তু কখনো চাননি তার ভাষাভঙ্গির অনুকরণ হোক, তার দর্শন, শিল্প ভাবনা হয়তো কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে; কিন্তু তার ভঙ্গি সেটাকে অনুসরণ করতে কিংবা অনুকরণ করতে কখনো বলেননি বলে আমার ধারণা। তার যে চিন্তা, শিল্প দর্শন সেটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
চারু শিল্প অনেক জায়গায় বিস্তৃত, আপনি এর অনেকগুলো শাখায় নিজের সৃজন ভাবনা মেলে ধরেছেন। সৃজনের এই যে বহুত্ব, এর উন্মোচন কেন আপনার শিল্পকর্মের উপজীব্য এবং এর প্রকাশে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিই বা কী?
শৈশবে চাঁদপুর শহরে বেড়ে ওঠা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণ, পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষকতা এবং বসবাস-সব জায়গাতে বহুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। ধর্ম, সংস্কৃতি-নির্বিশেষে বিচিত্র সমাজ, সমুদ্র, পাহাড় বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি এবং বিচিত্র মানুষের যাপিত জীবন। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সৃজনশীলতার নানা শাখা নাটক, চলচ্চিত্র, সাহিত্যসহ বহু বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে আমি নির্মিত হয়েছি কিংবা যা আমাকে নির্মাণ করেছে। ফলে বহুত্ব বা প্লুরালিটি আমার কাছে নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ, এই পরিসরে বিস্তারিত আলাপ সম্ভব নয়। এর উল্টো দিকে আছে সিঙ্গুলারিটি বা সমসত্ত্বতা, যার সঙ্গে আধুনিকতার গভীর সম্পর্ক। আর আধুনিকতা আমাদের কাছে হাজির হয়েছিল ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে এবং এই আধুনিকতাকে ঔপনিবেশিকতা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার উপায় নেই। ফলে আমরা যে আধুনিকতার মধ্যে বেড়ে উঠেছি সেটা আসলে ঔপনিবেশিকতারই উত্তরাধিকার। আমাদের শিক্ষাদীক্ষা এবং আমি নিজে যেভাবে প্রশিক্ষিত হয়েছি, সেটি ওই আধুনিকতার পাটাতনে গড়া। যেখানে আমাদের চিন্তা ও পরিমণ্ডলের ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থিত ছিল না। ফলে বহুত্বের বিপরীতেই পরিমণ্ডল বিচ্ছিন্ন এই কলাবিদ্যা শিক্ষণ ব্যবস্থাপনা বিশেষায়িত এবং বিশেষ ধরনের ভাষা ও দক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। একই শিক্ষণ ব্যবস্থাপনায় আমি চিত্রকলা শাখায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, এটি দৃশ্যকলার বিশেষ শৃঙ্খলা। চিত্রকলার মাধ্যমেই শিল্পচর্চার শুরু এবং ক্রমেই উপলব্ধি করলাম আমার সব ভাবনা বা উপলব্ধির মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভাষা হিসেবে দৃশ্যকলার প্রকাশভঙ্গি বা উপায় বিস্তৃত। তা ছাড়া আমি যে জগৎ বাস্তবতায় বাস করি তাও এক রৈখিক নয় বস্তুত বহুত্বের এক প্রপঞ্চ। সেই ক্ষেত্রে এই বাস্তবতা এবং পরিমণ্ডলের অভিজ্ঞতায় যে উপলব্ধি বা ভাবনার জন্ম হয় তা প্রকাশে সম-সত্ত্বীয় কোনো বিশেষ ভাষাভঙ্গি যথেষ্ট নয় বলে আমার মনে হয়েছিল। এ রকম একটি জায়গা থেকে ক্রমাগতভাবে আমার মধ্যে পরিবর্তন ঘটে, এমনকি যখন চিত্রকলার মাধ্যমে শিল্পচর্চা শুরু করি তখন বাংলাদেশের সমসাময়িক চিত্রকলা উৎকর্ষের অলিখিতভাবে যে মানদণ্ডটি তৈরি হয়েছিল সেটিও আসলে বিশেষ ভাষাভঙ্গির। যেখানে হোমোজেনেটি বা সমশ্রেণিভুক্ত রূপ বৈশিষ্ট্যের বড় জায়গা ছিল। সেটা আমার কাছে যথাযথ প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়নি; তাই নতুন পথের সন্ধান করার চেষ্টা।
যে কোনো শিল্প বা সৃজনশীলতাকে একরৈখিক বলে আমরা বিবেচনা করতে পারি কি? একই বাস্তবতাকে স্থান-কালভেদের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি এক এক রূপে দেখবেন ভিন্নভাবে প্রকাশ করবেন এটাই স্বাভাবিক। যে বাস্তবতাকে বা সত্যকে আমরা উদ্দিষ্ট করতে চাই তার মধ্যে বহুমাত্রিকতা বিদ্যমান এবং তার প্রকাশের প্রকরণও বহুমাত্রিক হবে। ঔচিত্যবোধের মানদণ্ডে শিল্প বিচারে আমার দ্বিধা আছে এবং যথাযথ বিবেচনা নয় বলে মনে হয়।
এই ক্ষেত্রে পরিমণ্ডলের প্রাসঙ্গিকতা বিষয়টি জটিল সেখানেও বহুত্বকে আমলে নিতে হয়। যে কোনো শিল্পীর কাছে আমরা যদি দাবি করি, তার এটা করা উচিত নয়, তার সমাজমনস্ক বা ইত্যাদি ইত্যাদি হওয়া উচিত, তার কমিটমেন্ট থাকা উচিত, সৃজনশীলতার বৃহৎ ক্ষেত্রে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। গত শতাব্দীতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যেও সৃজন চর্চায় বিবৃত আছে আন্তর্জাতিকতাবোধ এবং শিল্প ভাষার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশের উপায়। আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারের পক্ষে থাকার পরও বহুত্বের বিপরীতে সমগোত্রীয় সমাজ কিংবা এক ধরনের বৃক্ষের বনায়ন বাস্তুশাস্ত্রের পক্ষে থাকে না। উদ্দেশ্য মহৎ হলেও কোনো ধরনের জবরদস্তি বা চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি প্রকারান্তরে ভালো কিছু দেয় না। অনেক সময় নিরুদ্ধ বাস্তবতা থেকেও সৃজনশীলতার নতুন পথ সৃষ্টি হতে পারে। আমরা যদি ইরানের চলচ্চিত্র দেখি, এ রকমের সাপ্রেসড রিয়েলিটি থেকে তাদের শিল্পকলায় নতুন এক ভাষা তৈরি হয়েছে। সৃজনশীলতা সব সময়ই একটা শৃঙ্খলিত বাস্তবতার বিপক্ষে কাজ করে থাকে, সব সময়ই নানা দিক থেকে মুক্তির উপায় খোঁজে। অসঙ্গতি থেকে মুক্তি পেতে চায়, হয়তো এই অসঙ্গতি আছে বলেই শিল্প ও সৃজনশীলতা বেঁচে আছে।