শিক্ষাক্রম পরিবর্তনে শিক্ষার্থীদের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে

এম ডি হোসাইন
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৭:১১

অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। শিক্ষা জীবনে মাধ্যমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত সব পরীক্ষায় প্রথম স্থান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বিদেশে অনেক গবেষণা ও শিক্ষকতার ভিজিটিং পদে, জাতিসংঘের ‘কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি’ কমিটির সদস্য এবং সেখানে শিক্ষা বিষয়ক উপকমিটির নেতৃত্ব দেন। তিনি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক-এর কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন (১৯৯৩-২০০৮) এবং পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ২০০৮ সাল পর্যন্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি ও শিক্ষার মান উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের চিন্তা নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা বলেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- এম ডি হোসাইন।
অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কথা বলছে, অল্প সময়ে এই পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা সমস্যায় পড়বেন কিনা?
শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের পরিকল্পনা তো অবশ্যই আছে। ইতোমধ্যে কিছু বিষয় হাতে নেওয়া হয়েছে। যতদূর পারি আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাব। তবে এমনভাবে এটা করা হবে, যাতে যেসব শিক্ষার্থী নতুন শিক্ষাক্রমে আছে তাদের কোনো অস্বস্তি না হয়। এ জন্য পরিমার্জন করা হবে। তবে শিক্ষার্থীরা অস্বস্তিতে পড়তে পারে- এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা যায় সেসব নিয়ে কাজ চলছে। বছরের শুরুতেই বই বিতরণের জন্য আমরা চেষ্টা করব।
নতুন শিক্ষাক্রমে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে?
অনেক ক্ষেত্রেই নতুন এই শিক্ষাক্রম আমাদের দেশের জন্য উপযুক্ত নয়। আমাদের যে শিক্ষক আছেন তা দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন, বিশেষ করে পরীক্ষা মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। একটা নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছিল ২০২১ সালে। এতদিন ধরে মাঠপর্যায়ে সব জায়গায় এগুলো নিয়ে গবেষণার তথ্য তৈরি হয়েছে। পাঠ্যক্রম উন্নত করতেই হবে। আগেরটাতে ফিরে যাব ধাপে ধাপে।
আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যেতে চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করবেন?
আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যেতে অবশ্যই কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। তবে আমরা আগের শিক্ষাক্রমে এমনভাবে ফিরে যাব, যেনো ধারাবাহিকতা থাকে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় কোনো অস্বস্তি সৃষ্টি না হয়। তবে কীভাবে যাব সেটি একটি ফর্মুলার বিষয়; বিষয়টি জটিল।
বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শূন্যতাসহ নানা ধরনের সংকট চলছে, এগুলো কীভাবে দেখছেন?
৩০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবকশূন্য। অনেক স্কুল, কলেজের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকটগুলো যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের চেষ্টা করছি। এটা আমাদের জন্য একটা সুযোগও। আমরা চাইব সত্যিকারের শিক্ষানুরাগী, যোগ্য ব্যক্তি যেনো আসেন। অনিয়ম-দুর্নীতি আর দলীয়করণের অযোগ্যদের বাদ দেওয়া হবে। যোগ্য ও শিক্ষানুরাগীদের দ্বারা শিক্ষাপরিবার সাজানো হবে। এখানে এতদিন ধরে বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হয়েছে। সবার জন্য গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে জনগণসহ সরকারি ও বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সম্প্রতি কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষককে তাড়িয়ে চেয়ারে বসেন এক ছাত্র, শিক্ষকদের হেনস্তাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ ও হেনস্তা বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থেই নিজ নিজ শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষা করতে হবে। লক্ষ করা গেছে যে, দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এখনও শিক্ষকদের জোরপূর্বক পদত্যাগ ও নানাভাবে হেনস্তার ঘটনা ঘটছে। যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে হবে। যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপকর্মের অভিযোগ আছে, তাদের বিষয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। শৃঙ্খলাভঙ্গকারীদের চিহ্নিত করে প্রচলিত আচরণবিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বেআইনি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলে তার প্রতিকারের জন্য ইতোমধ্যে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন কেন জরুরি?
দেশের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নের এসব খাতের সংস্কার যেমন জরুরি, তেমনি সে অনুযায়ী কর্মপন্থা প্রণয়নও প্রয়োজন। শিক্ষা কমিশন শুধু সময়ের দাবি নয়, সরকারের হাতে নেওয়া ছয়টি সংস্কারকে বাস্তবিক রূপ দিতে আধুনিক শিক্ষার নীতিমালা প্রণয়ন আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। ‘শিক্ষা কমিশন’ ব্যতীত দেশের শিক্ষার সামগ্রিক মানোন্নয়ন যেমন সম্ভব হবে না, তেমনি সংস্কারে গড়া আধুনিক বাংলাদেশকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন হলে জাতি-ধর্ম-গোত্রনির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হবে। শিক্ষা কমিশনের সুচিন্তিত নীতিমালা বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত বিভিন্ন শিক্ষাধারার সঙ্গে প্রবাহিত অন্তর্নিহিত বৈষম্য দূর করবে এবং সুদূর দৃষ্টিপ্রয়াসী সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় সহযোগী হবে- এমনটাই প্রত্যাশা করি। মনে রাখতে হবে শিক্ষাব্যবস্থা শুধু একটি প্রতিষ্ঠিত কাঠামো নয়, বরং একটি উন্নয়নপ্রক্রিয়া।
শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে কি সমাজ বদলাবে?
মানুষের সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংস্কার হতে পারে। পাঠাগার পারে মানুষের সংস্কার করতে। পড়াশোনার মাধ্যমে মানুষ নিজের সংস্কার করতে পারে। শুধু সংস্কারের জন্য যা করা হয়, বাস্তবে তা কার্যকর হয় না। সংস্কারগুলো কার্যকর করে মানুষ। আধুনিক বিশ্ব যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ছাত্ররাই দেশ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছেন, এখন সরকারি চাকরিজীবী ও রাজনীতিবিদদের কী করা উচিত?
রাজনীতিবিদ ও চাকরিজীবীদের দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে এবং দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে। সরকারি কর্মচারীদের মূল কাজ হলো- জনগণকে সেবা দেওয়া। তাদের সেবাদানে পারদর্শিতা ও আন্তরিকতা হবে একজন সরকারি কর্মচারীর দক্ষতা ও যোগ্যতার মাপকাঠি। ছাত্র-জনতার এক অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানের পর আমরা এক নতুন যাত্রা শুরু করেছি। সে যাত্রা ন্যায্যতার, ন্যায়ের ও সমতাপূর্ণ মানবিক বাংলাদেশ গড়ার। নিকট অতীতের সুশাসনের অভাবজনিত কারণে এ চলার পথ কণ্টকাকীর্ণ। ধর্ম, লিঙ্গ, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ না করে সব নাগরিককে সমভাবে সেবা প্রদানের মানসিকতা লালন করতে হবে আমাদের। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, জনগণকে তাদের প্রাপ্য সেবা প্রদান কোনো করুণা নয়। অর্থনীতির একজন ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, সুচিন্তিত ও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ ও কর্মসূচি ছাড়া গন্তব্যে পৌঁছার জন্য আমাদের সামনে ভিন্ন কোনো পথ নেই। এ বিশাল কর্মযজ্ঞের সফল বাস্তবায়নে প্রয়োজন সবার সহযোগিতা।
আপনাকে ধন্যবাদ
সাম্প্রতিক দেশকালকেও ধন্যবাদ।