কোনো সময়েই জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল না: জি এম কাদের

এম ডি হোসাইন
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:৫২

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে শেখ হাসিনার মিত্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। দলটির নেতারা কখনও মন্ত্রিত্ব নিয়ে, কখনও সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে সরকারের অংশীদার হয়েছেন। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনেও অংশ নিয়ে দ্বাদশ সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছিল দলটি।
গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসনের পতনের পর জাতীয় পার্টির অতীত নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হলে, আমরা সেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও কঠোর বিরোধিতা করব। এরপর জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক দলের সংলাপে আমন্ত্রণ জানায়নি অন্তর্বর্তী সরকার। তবে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে সম্প্রতি ওঠা অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত বলে দাবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান। এসব বিষয় নিয়েই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে কথা বলেছে সাম্প্রতিক দেশকাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম ডি হোসাইন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন জাতীয় পার্টি স্বৈরাচারের দোসর। এজন্য রাজনৈতিক দলের সংলাপে আপনাদের আমন্ত্রণ জানানো নিয়ে বিরোধিতা করেছেন। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?
না, আমরা কোনো সময় তাদের দোসর হিসেবে কাজ করিনি। আমরা সবসময় জনগণের দোসর হিসেবে কাজ করেছি। আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা আমরা কখনোই করিনি; যতটুকু দেখানো হয়েছে, সেটি গায়ের জোরে করানো হয়েছে। জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে সম্প্রতি ওঠা অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। আওয়ামী লীগের তিনটি নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার শাস্তি হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংলাপে ডাকা হয়নি, এমন প্রচার জাতীয় পার্টির জন্য বিব্রতকর। আওয়ামী লীগ শাসনামলের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টিকে দেখা ঠিক নয়। কারণ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জাতীয় পার্টি ও বিএনপি। কিন্তু পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। বিএনপি মেয়র ইলেকশন ও উপজেলা ইলেকশন তিন ধাপ পর্যন্ত করে এটিকে বৈধতা দিয়েছে। মানে আমরা অর্ধেক দিয়েছি, তারাও অর্ধেক দিয়েছে। তারপর ২০১৮-এর নির্বাচনে সকলেই এসেছে। আর এই ধরনের নির্বাচন সবাই বৈধতা দিলো। বিএনপিসহ অন্যান্য দল মিনিমাম চার বছর পার্লামেন্টে ছিলেন। তা হলে এই সম্পূর্ণ সময় যদি ধরি- তা হলে নির্বাচনি ব্যবস্থায় সকলেই বৈধতা দিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে জাতীয় পার্টিকে ডাকা হলে কঠোর বিরোধিতা করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এ অবস্থায় আপনারা কী চিন্তা করছেন?
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমার অবদান আছে, আমার দলের অবদান আছে। দলের বেশিরভাগ মানুষ আন্দোলনে ছিল। এখন হঠাৎ করে যদি আমাদের না দিতে বলা হয় বা না ডাকা হয়, আমাদের তরফ থেকে কোনো আপত্তির কারণ নেই। আমাদের আপত্তি হলো যে, একটি বিষয়ে আমাদের দোষারোপ করে শাস্তি হিসেবে এটি দেখা হচ্ছে এবং ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য কিছুটা হলেও বিব্রতকর।
এতদিন আপনারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলেন, এখন কোন দিকে যাবেন?
কোনো সময়েই জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল না। যতক্ষণ জোর করে নেওয়া হয়েছে, তখন পার্টি বাঁচানোর জন্য এবং জনগণের স্বার্থে কাজ করার সুযোগ থাকার জায়গার জন্য আমরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে বাধ্য হয়েছি। আমরা সবসময় জনগণের সঙ্গে ছিলাম।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী দেখেন?
সামনে আওয়ামী লীগের একটা বড় সমস্যা আমি দেখি, যেটি শেখ হাসিনা তৈরি করেছেন। সেটি হলো, ওনার পরবর্তীতে কে দলের নেতৃত্ব দেবেন, সেটি ঠিক করে রাখেননি। এখনও ঠিক করে দিচ্ছেন না। আওয়ামী লীগ যত বড় সংগঠন হোক, নেতৃত্ব এবং সেই নেতৃত্বের প্রতি সবার আস্থা না আসা পর্যন্ত এই দলের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। আর উনি (শেখ হাসিনা) যে অবস্থানে চলে গেছেন, আমার ব্যক্তিগত অভিমত, ওনার পক্ষে নেতৃত্ব দিয়ে দল সংগঠিত করা অসম্ভব। উনি যদি দেশে থেকে এটি করতেন, তা হলে হয়তো পারতেন। ওনার প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা এসে গেছে। আগামী দিনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভোটার থাকবে, কিন্তু সংগঠন হিসেবে খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করি না।
গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে কী করেছেন?
জাতীয় পার্টি একমাত্র দল যারা সন্ত্রাসবাদ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হাট দখল, জমি দখল, অবৈধ ব্যবসা ও লুটপাটের সঙ্গে কখনও জড়িত ছিল না। আওয়ামী লীগের আমলে আমরা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। ষড়যন্ত্রের অর্থ হলো দলকে ভাগ করে দেওয়া এবং ক্ষমতা অন্যত্র চলে যাওয়া। আওয়ামী লীগ আমাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দলকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে তাদের দোষারোপ করা যাবে না। কারণ সরকার ভগ্নস্তূপের মাঝে দায়িত্ব নিয়েছে। প্রশাসন নড়বড়ে, অর্থনীতি নাজুক, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। এর ওপর মানুষের পাহাড় সমান প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এ জন্য সব রাজনৈতিক দলকে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। সরকার যাতে সঠিক পথে চলতে পারে, আমাদের যা পরামর্শ চান, যেভাবে চান- আমরা দেব।
সর্বশেষ ২০২৪-এর নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কেন অংশগ্রহণ করল?
আমি ২০২৪-এ (৭ জানুয়ারি) নির্বাচন করতে চাইনি। কিন্তু আমাকে বলা হলো, আপনারা নির্বাচনে না গেলে আপনাদের অন্য গ্রুপ অংশ নেবে। এ ধরনের হুমকির মুখে আমাকে বলতে হলো, ঠিক আছে, নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু হয়, সেটি নিশ্চিত করেন। তখন আমাকে নেগোসিয়েশনের (দর-কষাকষি) কথা বলতে হয়েছিল। ২০২৪ সালে যখন আমরা নির্বাচন বর্জন করতে চেষ্টা করলাম, সেই বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরোক্ষ চাপ দেওয়া হলো, যদি তোমরা নির্বাচনে না আসো, রওশন এরশাদকে দিয়ে নির্বাচন করানো হবে। অবশেষে আমরা বললাম, নির্বাচনে যাব। তবে নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার গ্যারান্টি দিতে হবে। আমরা কিন্তু কোনো ছাড় চাইনি। নির্বাচনি ব্যবস্থা নিরপেক্ষ করার জন্য বলেছিলাম। যখন দেখলাম সেটি হয়নি, তখন আমি না জানিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সকালে দেখলাম ওরা খবর পেয়ে গেছে। জোর করে, আমার অফিস ঘিরে ফেলে, সব পথ বন্ধ করে দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, র্যাব, পুলিশ, এসবি, ডিজিএফআই, এনএসআই সবাই মিলে জোর করে আমাদের নির্বাচনে নেওয়া হয়েছে।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনেও আসন ভাগাভাগি বা দর-কষাকষির বিষয়গুলো দেখা গেছে। কী ঘটে সেদিন?
সেদিন মোটেও দর-কষাকষি ছিল না। সেদিন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নির্বাচন বর্জন করব। ওরা আমাকে বলেছিল, সমঝোতায় আপনি সন্তুষ্ট না হলে পরে প্রত্যাহার করতে পারবেন। কিন্তু এখন মনোনয়নপত্র জমা দেন। কিন্তু দলের দুজন নেতাকে আমি বলেছিলাম, সমঝোতা বা সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির বিষয় নয়। আমরা নির্বাচন বর্জন করব।
মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর কী ঘটেছিল?
মনোনয়নপত্র জমা হওয়ার পর দেখলাম, তখনই তারা আমাদের প্রার্থীদের মাঠে নামতে দিচ্ছে না। সে পরিস্থিতিতে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়ার আগের দিন ১৬ ডিসেম্বর আমি সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি দুজন নেতার কাছে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের চিঠি তৈরি করে রাখলাম। অন্যদিকে সেই ঘোষণা দিতে রাতে প্রেসকে ডাকলাম। কিন্তু বনানী অফিসে আমি যখন প্রেসে ঘোষণা দিতে যাব, তখন দেখলাম একেবারে সব এজেন্সির (গোয়েন্দা সংস্থা) লোকজন এসে গেছে। র্যাব, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ডিজিএফআই, এনএসআই ও থানা-পুলিশের সব হর্তাকর্তারা এসে আমাকে ঘিরে ফেলে। তারা আমাকে মনোনয়ন প্রত্যাহার না করার জন্য বলে। তারা বলে আসন আরও বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা তারা করবে। তখন আমি বলেছিলাম, এটি সিলেকশন হবে। আমি নির্বাচন করব না। তারা আমাকে বলল, স্যার, আপনার খুব সমস্যা হবে। এরপরও আমি প্রত্যাহার করার কথা বললে তারা বনানী অফিসের আশপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে দিলো। এমন পরিস্থিতি তৈরি করল যে তারা কিছু করে ফেলবে। তখন আমি বললাম, আমাকে যখন নামিয়ে ফেলেছ, আমার রাজনীতিই শেষ, অন্তত আমার পার্টি বাঁচানোর জন্য তোমরা আর কিছু জায়গায় আমাকে ছাড় দেওয়ার জন্য বলো। তখন আমার স্ত্রীসহ কয়েকজন নেতার আসনের ব্যাপারে বললাম। আমি দল বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আমার ভুল হতে পারে। সবদিক থেকে আমি খুব চাপে ছিলাম।