-6733162540839.jpg)
চৌমতলী হক। ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছর পুরো দুনিয়াজুড়ে ছাত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তবে সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিক্ষোভটি ঘটেছে বাংলাদেশে। এটি শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।
বাংলাদেশে কী ঘটেছিল এবং ভবিষ্যতে কী হতে পারে সেটি
বোঝার জন্য ল অ্যান্ড পলিটিক্যাল ইকোনমি (এলপিই) ব্লগের পক্ষ থেকে ক্লো মিলার কথা বলেন
দ্য সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক স্কুল অব ল’য়ের সহযোগী অধ্যাপক চৌমতলি হকের সঙ্গে। বাংলাদেশের
একজন নাগরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তিনি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অসন্তোষের
ইতিহাস সম্পর্কে কথা বলেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যেসব চ্যালেঞ্জের
মুখোমুখি হচ্ছে; এই বিদ্রোহ থেকে অন্যান্য সামাজিক আন্দোলন যে শিক্ষাগুলো নিতে পারে
সে বিষয়েও আলোচনা করেছেন।
সাক্ষাৎকারটি
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন মোকাররম রানা।
প্রশ্ন: চলতি বছরের গ্রীষ্মে একটি ছাত্র-নেতৃত্বাধীন প্রতিবাদ আন্দোলন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এই আন্দোলনের জন্ম কী কারণে
এবং এর মূল লক্ষ্যগুলো কী ছিল?
চৌমতলি হক: ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন এবং এর ফলে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি।
এই আন্দোলনের শেকড়ে রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গভীর কাঠামোগত সমস্যা। এই
আন্দোলনে প্রাথমিক অনুঘটক ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য সরকারি চাকরিতে
কোটা পদ্ধতির পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত। ছাত্র-তরুণদের পক্ষ থেকে এই কোটা পদ্ধতি বিরোধিতার
পেছনে দায়ী ছিল ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অর্থনৈতিক বঞ্চনামূলক শাসন
ব্যবস্থা।
চলতি
বছরের জুনে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল
করে। এই পদ্ধতি অনুযায়ী যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তাদের বংশধরদের জন্য সরকারি চাকরির
৩০ শতাংশ সংরক্ষিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এর আগে ২০১৮ সালের একটি নির্বাহী
আদেশের মাধ্যমে কোটা বাতিল করেছিলেন। দেশব্যাপী তরুণদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবির
মুখে তিনি তখন কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে সুপ্রিম কোর্টের আদেশের মাধ্যমে
কোটা পুনর্বহাল ছিল তরুণদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি চূড়ান্ত আঘাত।
কোটা
পদ্ধতি নিয়ে মূল সমালোচনা ছিল যে, এটি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার একটি রূপ হিসেবে কাজ করেছিল।
একই সঙ্গে শেখ হাসিনার শাসনের ক্ষমতাকে সুসংহত করতে ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল,
যা গত পনের বছরে আরও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগই কর্মজীবী শ্রেণি থেকে আসেন। তবে স্নাতকোত্তর পড়া শেষ করেও তারা
স্থিতিশীল চাকরি পান না। যদিও বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির
অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তবে মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি
হয়নি। কোটা বিরোধী আন্দোলনের পেছনে অর্থনৈতিক একটি হতাশাও ছিল।
সুপ্রিম
কোর্ট কোটা সংক্রান্ত নির্বাহী আদেশ বাতিলের পরে শিক্ষার্থীরা দ্রুত রাস্তায় নেমে
আসে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয়। আন্দোলন শুরু
হওয়ার পরপরই শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তিনি তাদের ‘রাজাকার’ (১৯৭১
সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তাকারী) বা বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করেন।
শেখ হাসিনার এই প্রতিক্রিয়া তার শাসনকালেরই প্রতীকী রূপ। গত ১৫ ধরে যারাই সরকারের
বিরোধিতা করেছে, তারাই এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন ‘আয়নাঘর’ নামের
গোপন কারাগারে বন্দি মীর আহমাদ বিন কাসেম আরমান, মানবাধিকার আইনজীবী আদিলুর রহমান,
সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম, আলোকচিত্রী শহিদুল আলমসহ আরও অনেকে।
শেখ হাসিনার বিতর্কিত মন্তব্যের পর ছাত্র আন্দোলনকারীরাও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখান। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ছাত্রদের হতাশা, সুশীল সমাজের ওপর সরকারের দীর্ঘস্থায়ী দমন-পীড়নের মতো ঘটনা ছাত্রদেরকে তাদের আন্দোলনের গতি বাড়াতে উসকে দেয়।

ছাত্ররা
গণতন্ত্রের জন্য এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘিরে ঐক্যবদ্ধ একটি বৃহত্তর জোটকে
সংগঠিত করে। শিগগিরই আমরা দেখলাম যে সরকার কারফিউ আরোপ করেছে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে
দিয়েছে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, কারফিউ ভাঙার মতো তুচ্ছ কারণেও সেনাবাহিনীকে গুলি
করার ক্ষমতা দেয় হাসিনা সরকার। সহিংসতা ক্রমশ বাড়তে থাকলে আন্দোলনকারীরা তাদের নয়টি
দাবি থেকে এক দাবিতে চলে আসেন। সেটি হলো-শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে।
আন্দোলনকে
সামগ্রিকভাবে দেখলে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রথমত, আগে থেকেই অর্থনৈতিক
বঞ্চনা ছিল। পরে এটি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক নিপীড়নের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে। কোটা
পদ্ধতি সংশোধন নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে আইনি ঠেলাঠেলি শুরু
হয়। এর মধ্যে দীর্ঘদিনের ধারণা আরও পরিষ্কার হয় যে, বিচার বিভাগ শেখ হাসিনার অধীন এবং
স্বাধীন নয়।
প্রশ্ন: বিশ্বে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে বাংলাদেশের ব্যাপকভাবে
প্রশংসিত হচ্ছিল। একই সময়ে শুরু হওয়া এই আন্দোলন অর্থনৈতিক অসন্তোষের সঙ্গে কীভাবে
সামঞ্জস্যপূর্ণ? সামাজিকখাতে ব্যয়কে উপেক্ষা করে কি অর্থনৈতিক উন্নয়নের নীতি নেওয়া
হয়েছিল? নাকি বণ্টন ব্যবস্থায়ও বৈষম্য ছিল? নাকি অন্যকিছু ছিল?
চৌমতলি হক: আমাদের বাংলাদেশকে একটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপনিবেশিক দেশ হিসেবে
বুঝতে হবে। দেশটি ১৯৭১ সালে তার সর্বশেষ স্বাধীনতা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে গেছে। ব্রিটিশরা
দক্ষিণ এশিয়াকে ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করেছিল। বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান ছিল। ১৯৭১
সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত কারণগুলো কেবল রাজনৈতিক ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের
জনগণ রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং সেই সময়ে সরকারে আরও বেশি অংশীদারত্ব চেয়েছিল। এসব
কারণের মধ্যে অর্থনৈতিক কারণও ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে সম্পদ আহরণ করছিল।
সেই সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীকারও লড়াইয়ের কারণ ছিল।
১৯৭১
সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পেয়েছিল
যা কাঁচামাল রপ্তানি এবং শ্রমঘন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
নব্য
উদারবাদী ব্যবস্থার রমরমার সময়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। এসময় বেশিরভাগ
উত্তর উপনিবেশিক দেশগুলোকে বিশ্বমুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের মতো ব্রেটন
উডস প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমঝে চলতে হচ্ছিল। এর কারণ ছিল বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়া বাড়ানো।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিজস্ব শাসনকাঠামো গড়ে তোলার ওপর এই বিনিয়োগ নির্ভর করে যা আসলে
নব্য উপনিবেশিক ধারণা।
যাই
হোক, ব্রেটন উডস উন্নয়ন মডেলের অনুসরণ এক ধরনের টানাপোড়েনেরও সূচনা করে। বাংলাদেশের
স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক নেতা একে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তার
কারণ ছিল তারা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ও পাকিস্তানের শোষণকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে
প্রবর্তিত বাংলাদেশের সংবিধানেও এই আবেগ প্রতিফলিত হয়েছে। এতে সুষম পল্লী উন্নয়ন ও
মৌলিক অধিকারে কাজ পাওয়ার অধিকারকে অর্থনৈতিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
তবে
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে টিকে থাকার জন্য বৈদেশিক সাহায্য চাওয়া এবং আধিপত্যবাদী বিশ্ব
পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাওয়া অচেনা পথ অনুসরণ না করার চাপ ছিল। বিশেষত
যখন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী বৈশ্বিক খেলোয়াড়রা পাকিস্তানের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল
এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেনি।
সত্তরের
দশকের শেষের দিকে এবং আশির দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ দেশীয় অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব
এবং সামাজিক কল্যাণ কর্মসূচিকে বিসর্জনের বিনিময়ে রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধি এবং বিদেশি
বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। এর ফলে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো খাতের বিকাশ ঘটে। তবে
এই সময় অর্থনীতির বৈচিত্রকরণ বা গ্রামীণ ও শহুরে দরিদ্রদের চাহিদা পূরণের দিকে খুব
কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সস্তা শ্রম দেখিয়ে কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করে বিদেশি
বিনিয়োগের জন্য নিজেকে উন্মুক্ত করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি দুটি উপায়ে উন্নতি করে। এগুলো
হলো তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য সস্তা শ্রম আহরণ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো বৈদেশিক
মুদ্রার মাধ্যমে। অবশ্যই বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বেড়েছে। এটি ধনী ব্যক্তিদের লাভবান
করেছে। তবে এটি অর্জিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার
মাধ্যমে।
আসলে
ছাত্র আন্দোলন এই পরিস্থিতির প্রতিও ক্ষোভ দেখিয়েছে। এটি কেবল সরকারি চাকরির বিষয়
ছিল না। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের প্রভাব ব্যাপক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদ
বাংলাদেশের মানুষের উন্নতির সুযোগকে সীমিত করছে। এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে পুঁজিবাদী
কাঠামোর ভেতরে সরকার যেভাবে ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছিল তার প্রতিও জবাব ছিল এই ছাত্র আন্দোলন।
এটি
নব্য উদারবাদী বিশ্বায়নের প্রতিও ব্যাপক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের বিশ্বায়ন ‘কর্মসংস্থানহীন
প্রবৃদ্ধি’ তৈরি করে। যেখানে অর্থনীতির বিকাশ ঘটে কিন্তু শিক্ষিত তরুণদের
চন্য যথেষ্ট ভালো চাকরির সুযোগ তৈরি হয় না।
শেখ
হাসিনার সরকার দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছে। একই সময়ে তিনি
গরিব ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার অজুহাতে
দেশের অভ্যন্তরীণ ভিন্নমত এবং সুশীল সমাজের কণ্ঠস্বরকে দমন করেছেন।
প্রশ্ন: আমি যতদূর বুঝি এই অভ্যুত্থানের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল।
আন্দোলনকারীরা সরকারি চাকরিতে জায়গা পাওয়ার জন্য আন্দোলনকে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের
সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছে, যা ফ্যাসিজম ও একটি কর্তৃত্ববাদী শাসকের বিরুদ্ধে বৃহত্তর
লড়াই তৈরি করেছে। আপনি কি বলবেন আমাদের দেখা এই আন্দোলনে আন্তঃসম্পর্কিত দুটি সংগ্রাম
পরস্পরকে শক্তি যুগিয়েছে?
চৌমতলি হক: আন্দোলনের একটি বিষয় অনন্য ছিল। সেটি হলো এটি রাজধানী ঢাকা
থেকে শুরু বা শেষ হয়নি। রাজধানীর বাইরের শিক্ষার্থীরাও সংগঠিত হয়ে সারাদেশে আন্দোলন
ছড়িয়েছে, যাতে জনগণও সমর্থন দিয়েছে। ৪ আগস্ট ছাত্ররা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার ঘোষণা
দেয়। একই সঙ্গে তারা সবাইকে এতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়। বিশেষত তারা শ্রমিকদেরকে
তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায়। এটি আন্দোলনের রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ
মুহূর্ত ছিল। এই আন্দোলনের আন্তঃক্ষেত্রীয় মেলবন্ধন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষের
পাশাপাশি লৈঙ্গিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংকটের কথা বলা আন্দোলনের কাঠামোগত পরিবর্তনের
সম্ভাবনাকে প্রকাশ করেছে। শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষ এমনকি সাধারণ সৈনিকসহ বিভিন্ন
সামাজিক শ্রেণির মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে এই আন্দোলন হাসিনাশাহীর বিরুদ্ধে এক
বিস্তৃত ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো যুথবদ্ধতা তৈরি করেছিল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন অনেকটাই প্রাথমিকভাবে ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। তবে উপরে
আলোচিত কিছু কারণের জন্য আগস্টের মধ্যে এটি ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। অর্থনৈতিক অসন্তোষ
এবং ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর লড়াইয়ের মাধ্যমে জনগণ একত্রিত হয়েছিল বিক্ষোভকারীদের
বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান তীব্র এবং সহিংস রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন দেখে। ৪ আগস্টে ঢাকা মার্চ
কর্মসূচি বাংলাদেশের সাধারণ জনতাকে জাগিয়ে তুলেছি, যা ছিল মূলত অরাজনৈতিক। যেমন গৃহিণী
ও অভিভাবকরা রাস্তায় নেমে জিজ্ঞাসা করছিল, ‘কেন তোমরা আমাদের বাচ্চাদের ওপর গুলি করছো?’
আমি
মনে করি, এই মুহূর্তটি ১৯৬০ দশকের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনে আমরা যে মিছিল
দেখেছিলাম তার মতো। ঢাকামুখী লং মার্চের সময়, আপনি দেখবেন যে সেনাবাহিনীর নিম্নস্তরের
সৈনিকরা যারা অনেকেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, তারা দেখামাত্রই গুলি চালানোর আদেশের
বিরোধিতা করে। ওই সময়ের কিছু আলোকচিত্র থেকে দেখা যায়, সেনাসদস্যরা কিছু করছে না। বিক্ষোভকারীদের
সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আর শেখ হাসিনার নির্দেশ মানতে রাজি নয়।
প্রশ্ন: আন্দোলনের সময় ভুয়া তথ্য কী ভূমিকা পালন করেছিল?
চৌমতলি হক: অভ্যুত্থানের কয়েক সপ্তাহ পরে কিছু সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশে
হিন্দুদের ব্যাপকভাবে হত্যা করা হচ্ছে বলে প্রচুর ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যান্য
সংবাদমাধ্যমগুলো স্বীকার করেছে যে হিন্দু ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে,
তবে ধর্মের সেটি ভিত্তিতে নয়। বরং সহিংসতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই হাসিনার প্রশাসনের
সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিপরীতে আমরা গোঁড়া মুসলমানদের দৃশ্যত মন্দির পাহারা দিতে দেখেছি।
ধর্ম নির্বিশেষে আমরা সকলেই বাংলাদেশি তারা এই ধারণা প্রচার করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারও
খুব দ্রুত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নিন্দা করেছে। আন্দোলনে থাকা অনেক হিন্দু শিক্ষার্থী
ধর্মীয় বিভেদ বপনের উদ্দেশ্যে ছড়ানো ভুয়া তথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
আমরা
বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও গোয়েন্দাদের
পরিকল্পিত প্রচেষ্টাও দেখেছি। গত ১৫ বছর ধরে ভারত শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছে। এর
ফলে তিনি ভারতের সুবিধার জন্য অসংখ্য বাণিজ্য চুক্তি করেছেন। বাংলাদেশে ভারতের প্রভাবের
বিরুদ্ধে এরইমধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
পশ্চিমের
দেশগুলোতেও ছাত্র আন্দোলন নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। উদাহরণ হিসেবে একজন আমেরিকান
অর্থনীতিবিদ এবং কলম্বিয়ার আর্থ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক জেফরি শ্যাচের কথা বলা
যায়। তিনি ভয়ংকর এক নিবন্ধে লিখেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের সরকার
পরিবর্তন ঘটতে পারত না। এই ধরনের চরিত্রায়ন গভীরভাবে অপমানজনক এবং নব্য-উপনিবেশিক
মনোভাবের প্রতিফলন করে। কারণ এটি বোঝাতে চায় যে গ্লোবাল সাউথের লোকেরা সত্যিই নিজেদের
শাসন করতে বা তাদের নিজস্ব বিদ্রোহের স্থপতি হওয়ার মতো কাজ নিজেরা করতে পারে না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থা কী?
চৌমতলি হক: অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এটিকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ ২.০ এবং আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার
পর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। নোবেল বিজয়ী এবং গ্রামীণ
ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ
দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তিনি অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনায় সহায়তার জন্য
একটি উপদেষ্টা দল গঠন করেন এবং দুইজন ছাত্র আন্দোলনের নেতাকে উপদেষ্টা দলে অন্তর্ভুক্ত
করা হয়। এটি কার্যত নজিরবিহীন।
সরকারের
পতন হলে পুলিশ পেশাগত ভূমিকা ত্যাগ করে। এমন পরিস্থিতিতে অনাচার, সহিংসতা এবং সম্পূর্ণ
বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা ছিল। অবশ্যই কিছু সহিংসতা ছিল, কিছু মাত্রার বিশৃঙ্খলা ছাড়া আপনি
ক্ষমতার পরিবর্তনের স্তরে থাকতে পারবেন না। কিন্তু সারা দেশে হাজার হাজার মানুষ এই
মুহূর্তে একত্রিত হয়েছিল। শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে। অন্যরা সারা দেশে
সৌন্দর্যায়ন প্রকল্পের নেতৃত্ব দিয়েছে।
এখন
উড়োকথা ভাসছে। আমরা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করেছি। এখন
কী হবে? অর্থনীতির অবস্থা কী? আইনকানুনের অবস্থা কেমন? এমনকি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও
নতুন চ্যান্সেলর (আসলে ভাইস চ্যান্সেলর) নিয়োগ করতে হবে। কারণ আগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের
সঙ্গে বিগত সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারও ধীরে ধীরে সরকারি সংস্থাগুলোতে
নতুন নির্বাহী নিয়োগ করছে। কারণ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই আগের শাসনামলের রাজনৈতিক অনুগতদের
দ্বারা কলঙ্কিত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে এখন অনেক কাজ।
তবে
আমি আশাবাদী। আপনি যদি সেই তরুণদের কথা চিন্তা করেন যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল,
তাদের বয়স কেবল বিশের দশকের মাঝামাঝি। তারা কেবল শেখ হাসিনার শাসনের অভিজ্ঞতাই পেয়েছে,
যার বেশিরভাগই ছিল স্বৈরাচারী এবং তরুণদের সম্ভাবনাকে সংকুচিতকারী। তারপরও তরুণদের
মধ্যে দেশ গড়ার তাড়না রয়েছে, যেমনটি তারা চায়।
আন্তর্জাতিক
বিভিন্ন আন্দোলন নিয়ে গবেষণা ও সংগঠিত করার কাজে আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আছে। তবে আমি
কখনোই কোনো আন্দোলনে এতটা ব্যাপক আকারের নাগরিক সম্পৃক্ততা দেখিনি। এই আন্দোলনের মাধ্যমে
এক ধরনের আশাবাদ তৈরি হয়েছে যে, আমরা কাঙ্ক্ষিত দেশ গড়ে তুলতে পারব।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে দেশ পুনর্গঠনে বাংলাদেশ কোন কোন বড় চ্যালেঞ্জ
মুখে পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
চৌমতলি হক: অবশ্যই যে কোন ব্যাপক বিদ্রোহ এবং সামাজিক রূপান্তরের সময় চ্যালেঞ্জ
থাকে। আমার মনে কয়েকটি বিষয় বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। হাসিনার শাসনামলে সরকারের সমস্ত প্রতিষ্ঠান
দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন নেতা দিয়ে পুনর্গঠন
করতে হবে। বাংলাদেশে এখনও অনেকেই অর্থনৈতিক সুযোগের জন্য সংগ্রাম করছে। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের
অধীনে বাংলাদেশ কীভাবে একটি বিকল্প অর্থনৈতিক পথ তৈরি করবে? বিচার বিভাগ পক্ষপাতদুষ্ট
এবং ভিন্নমত দমনে ব্যবহৃত হয়েছে। কীভাবে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হবে?
অবশেষে, সমাজ ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করেছে, যেখানে সুশীল সমাজের সংগঠন এবং কর্মীরা
লক্ষ্যবস্তু ছিল। বছরের পর বছর স্বৈরাচারী শাসনের পর কীভাবে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের
সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? হাসিনার শাসনামলে সমাজের সকল দিক প্রভাবিত হয়েছে এবং
চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করা।
বাংলাদেশের
সামনে কাজটা কঠিন হবে। যখন একটি বিপ্লব বা অভ্যুত্থান ঘটে, তখন এটির জন্য একটি নতুন
সংবিধানের প্রয়োজন হয়। কারণ জনগণ এবং রাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক মৌলিকভাবে পরিবর্তিত
হয়েছে। আপনি পুরনো সংবিধানের ওপর নির্ভর করতে পারবেন না যার অধীনে শেখ হাসিনা জানুয়ারিতে
নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে নতুন নির্বাচন পরিচালনার জন্য আপনার কিছু
শাসন নীতি দরকার। বাংলাদেশের এই আন্দোলন একটি গণআন্দোলন ছিল। আমাদের একটি জনতার সংবিধান
থাকা দরকার।
বাস্তবতা
হলো, আমরা যা চাই তা হয়ত পাব না। হয়ত বাংলাদেশ স্বৈরতন্ত্র থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ নব্য
উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দিকে যাবে। বামধারার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে
এমন দেশগুলোর কথা ভাবুন। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সামগ্রিক শক্তির মধ্যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন
এবং রাজনৈতিক সংগঠনের বিকল্প রূপগুলো কী অনুসরণ করা সম্ভব? আমি মনে করি ক্রমবর্ধমান
পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সব বাংলাদেশির জন্য
লাভজনক।
এমন
লক্ষণ রয়েছে যা আশাবাদী করে তবে এমন লক্ষণও রয়েছে যা আমাকে উদ্বিগ্ন করে। বর্তমান
অন্তর্বর্তী সরকার ঋণের জন্য আইএমএফের কাছে ফিরেছে। এতে প্রশ্ন উঠছে, আমরা কি পুরনো
ব্যবস্থায় ফিরে যাচ্ছি? ১৯৭০ এর দশকে, যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তখন যারা কর্তৃত্বে
ছিলেন তাদের অনেকেই স্বনির্ভর ব্যবস্থার পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি খুব
দ্রুত বদলে গেল। এখনও কি সেই স্বনির্ভরতা বজায় রাখা সম্ভব?
শেষ
পর্যন্ত, গণআন্দোলন যে একজন স্বৈরাচারী নেতাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
ঐতিহাসিকভাবে, এটি কখন ঘটেছে? মানুষ বলশেভিক বা ফরাসি বিপ্লবের দিকে ইঙ্গিত করে। আমার
মতে বাংলাদেশ জনগণের বিপ্লবের সবচেয়ে শক্তিশালী আধুনিক উদাহরণ। এই মুহূর্তটি বিশাল
ও চলমান। গণতন্ত্র একটি গতিশীল ও বিকাশমান প্রক্রিয়া। এটি এমন কিছু নয় যা আপনি অর্জন
করলেন এবং বসে থাকলেন। গণতন্ত্র গড়ার কাজে প্রতিনিয়ত আমাদের নিয়োজিত থাকতে হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে অভ্যুত্থানটি এমন সময়ে হয়েছে, যখন সারা বিশ্বেই নানা
কারণে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো গাজায় চলমান অবরোধের বিরুদ্ধে
বিক্ষোভ। এই আন্দোলনগুলো বাংলাদেশের অভ্যুত্থান থেকে কী ধরনের শিক্ষা নিতে পারে?
চৌমতলি হক: বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে তা থেকে বিশ্ব অনেক কিছু শিখতে পারে।
ছাত্রদের রাজনৈতিক পরিশীলতার স্তর চিত্তাকর্ষক। তারা প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছে ইচ্ছাকৃত
এবং কৌশলগতভাবে; যার ভিত্তি ইতিহাসের মধ্যে স্থাপিত।
ছাত্র
আন্দোলনের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো তারা জাতীয়ভাবে সংগঠিত ছিল। সারা দেশে তাদের
নয়জন জাতীয় সমন্বয়ক ছিল যারা সবাই একই দাবিমালাকে ঘিরে একত্রিত হয়েছিল। তারা আগের
আন্দোলন সম্পর্কে এবং কেন তারা ব্যর্থ হয়েছিল সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিল। তারা
২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের মতো এই আন্দোলনগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং তাদের কৌশল
ও অনুশীলন পরিবর্তন করেছে। উদাহরণ হিসেবে, শিক্ষার্থীরা জানত যে তারা শ্রমজীবী মানুষের
অংশগ্রহণ ছাড়া সফল হতে পারবে না। আন্দোলন বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তারা ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে
বিশেষত গার্মেন্টস শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। এই ঐক্যই আন্দোলনটিকে
সফল করেছে। কারণ এটি সমাজের একটি বিস্তৃত অংশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছিল।
আন্দোলনকে
কীভাবে বিভক্ত করা হয়ে থাকে সেটিও শিক্ষার্থীরা বুঝতে পেরেছিল। তারা জানত যে, শেখ হাসিনা
এবং তার শাসনযন্ত্র বিভাজন তৈরির চেষ্টা করবে। তারা দেখাতে চাইবে ছাত্ররা অলস বলে সম্মানজনক
সরকারি চাকরি চায়। ছাত্ররা এটি অনুমান করেছিল এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন শ্রেণির
সঙ্গে সংগঠিত হয়েছিল।
আন্দোলনটি
কেবল শহুরে অভিজাতদের নয় এটি নিশ্চিত করার জন্য ছাত্ররা এই কৌশল নিয়েছিল। বহিরাগত
শক্তির বিভাজন প্রচেষ্টাকে পরাস্ত করার ক্ষমতা এটি দেখায় যে, এই আন্দোলন রাজনৈতিক
শিক্ষার ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছিল। একটি কার্যকর গণআন্দোলনের কৌশল তৈরির জন্য সব আন্দোলনকে
ইতিহাস এবং বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছাত্ররা বুঝতে শিখেছে।
প্রশ্ন: গাজার পক্ষে হওয়া ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের
মধ্যে আপনি কী ধরনের মিল দেখতে পান?
চৌমতলি হক: শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন থেকে পালিয়ে গেলে বিক্ষোভকারীরা
সেটি দখল করে নেয়। খালি হওয়া বাড়িটিতে তারা দুটি পতাকা টানায়। একটি অবশ্যই বাংলাদেশের
পতাকা এবং অন্যটি ফিলিস্তিনের পতাকা। গাজার আন্দোলনের চেয়ে বাংলাদেশের সংগ্রামের একটি
ভিন্ন প্রেক্ষাপট রয়েছে। বাংলাদেশের আন্দোলন গণতন্ত্র এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক সুযোগের
জন্য একটি অভ্যন্তরীণ সংগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে গাজার আন্দোলন দখলদারত্ব
ও উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে কেন্দ্র করে। কিন্তু উভয় আন্দোলনের মূলে রয়েছে আত্মনিয়ন্ত্রণ
এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে জনগণের নিজস্ব ক্ষমতার জন্য লড়াই।
এই দুটি
আন্দোলনের মধ্যে আরও সমন্বয়মূলক শক্তি রয়েছে। প্রথমত, তরুণদের মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তি
এবং সংগঠিত করার ক্ষমতা রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে বলা হয় জেনারেশন জেড বিপ্লব।
তরুণদের ঘিরে অনেক নেতিবাচক সমালোচনা রয়েছে- যে তারা অনেক কিছু করে না এবং অন্যান্য
বিষয় নিয়ে উদাসীন। কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্র আন্দোলন
তাদের দৃঢ় বিশ্বাসে অটল।
উভয়
আন্দোলনেরই সুস্পষ্ট দাবি এবং সেগুলিকে বিকশিত করার ক্ষমতা রয়েছে। বাংলাদেশে, রাষ্ট্রীয়
সহিংসতা অকল্পনীয় মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা দ্রুত ৯ দফা দাবি থেকে এক
দফায় চলে যায়। ফিলিস্তিনের জন্য ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে একটি যুদ্ধবিরতি
এবং সম্পর্কচ্ছেদের আহ্বান দেখেছি। এখন আমরা দেখছি যে আলাপটি অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাযর দিকে
যাচ্ছে কারণ যুদ্ধবিরতি আর যথেষ্ট নয়।
আমরা
নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মুহূর্তে আছি। যুক্তরাষ্ট্রের
আন্দোলনকারীদের বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। যখন লোকেরা বলে ফিলিস্তিন
ইস্যুটি গণতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন - আমি মনে করি এটি সম্পূর্ণ ভুল। অবশ্যই, আন্দোলনটি
প্রথমত এবং প্রধানত ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য। তবে এছাড়াও এটি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের
ওপর একটি গণভোটের মতো- আপনি আপনার সরকারকে কেমন দেখতে চান? আপনি কি চান যে আমাদের করদাতার
ডলার একটি গণহত্যার জন্য অর্থায়ন করুক? অথবা আমরা কি এই টাকাগুলো স্বাস্থ্যবীমা, স্থায়ী
আয়, আবাসন এবং আরও অনেক কিছুর দিকে যায় তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? বাংলাদেশের
শিক্ষার্থীদের মতোই যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের প্রশ্ন করা হচ্ছে: আমরা কী ধরনের গণতন্ত্র
চাই?
সমস্ত
আন্দোলনের জন্য একটি জিনিস মনে রাখবেন- আপনি মুক্তির জন্য দীর্ঘমেয়াদী অঙ্গীকার করছেন।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যখন আমি বাংলাদেশে ছিলাম তখনও বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন কীভাবে
বিকশিত হবে সেটি পুরোপুরি কল্পনাও করতে পারিনি। আমার জীবদ্দশায় ফিলিস্তিন যুক্তরাষ্ট্রে
একটি জাতীয় ইস্যু হবে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি এবং এখন এটি এমন একটি বিষয় যা আমি
মনে করি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কে হবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
নির্বাচনি
রাজনীতি কোনো আন্দোলনের শেষ নয়। বাংলাদেশের একজন ছাত্র সংগঠক এমন কিছু বলেছিলেন যা
আমাকে আটকে ফেলেছিল–তিনি বলেছিলেন যে কোনো বিপ্লবের সঙ্গে, সবসময় একটি প্রতিবিপ্লব
এবং প্রতিক্রিয়া হবে। আমরা ইতিহাস থেকে এটি জানি এবং আমাদের এটির জন্য প্রস্তুতি নিতে
হবে। আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে, গতি বাড়াতে হবে এবং হাল ছাড়া যাবে না। আমাদের বিশ্বব্যাপী
রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেম বুঝতে হবে। আমরা যার একটি অংশ। আমরা যদি এই বোঝাপড়া
তৈরি করতে পারি, আমাদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে পারি এবং বিপ্লকে টিকিয়ে রাখতে
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারি তাহলে অন্য একটি দুনিয়া আমরা সৃষ্টি করতে পারব।