মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সংস্কারের বিকল্প নেই: ড. আসিফ নজরুল

এম ডি হোসাইন
প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২০

উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। ছবি: সংগৃহীত
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি একজন জনপ্রিয় কলামিস্ট, মানবাধিকারকর্মী ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের লেখক। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের ব্যুরোর সদস্য ছিলেন আসিফ নজরুল। তিনি সুশাসন, ন্যায়বিচারের অধিকার, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে ইইউ ডেলিগেশন ইন বাংলাদেশ, ইউএনডিপি, এডিবি, ডিএএনআইডিএ, এসআইডিএ, কেয়ার, টিআইবিসহ বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের কার্যক্রম, সংস্কার, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রম, প্রবাসী শ্রমিক ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম ডি হোসাইন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মানুষের যেসব আকাঙ্ক্ষা, যেমন- মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা, ভোটাধিকার ইত্যাদি নিশ্চিত করা অনেকটাই আইন মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত। অনেক কাজ। কাজগুলো শেষ করার বিষয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে আমাদের জন্য সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। তবে সংস্কারের কাজে এখনো সময় দিতে পারিনি। শিগগির সংস্কারের দৃশ্যমান প্রক্রিয়া শুরু করব। এর মধ্যে বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাব। সাধারণ মানুষের মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার সংস্কার ছাড়া নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তবে গত চার মাসে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহার, আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার নির্দোষ মানুষের মুক্তি, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় বিগত সরকারের প্রভাবমুক্ত করা, বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের পদায়ন, বিভিন্ন নিয়োগে সহায়তা ইত্যাদি রুটিন কাজে বিগত চার মাসের অনেকটা সময় চলে গেছে। অন্য দুটি মন্ত্রণালয়ের কাজ করতে হয়েছে। এখন দুটি মন্ত্রণালয় নিয়ে কাজ করছি।
মানুষের মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার কীভাবে নষ্ট হয়েছে?
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের উচ্চতর বিচার বিভাগকে এমন সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, যা কাজে লাগিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারকে ক্ষমতায় রাখা হয়েছিল। তাদের কর্তৃত্ব সুসংহত করতে ব্যবহার করা হয়েছে। তখন অনেকে দোষী প্রমাণিত না হয়েও দীর্ঘ সময়ের জন্য আটক ছিলেন এবং জামিনের আবেদনগুলো প্রায়ই প্রত্যাখ্যান করা হতো। দেশে যদি প্রতি পাঁচ বছর পর পর সুষ্ঠু নির্বাচন হতো এবং নির্বাচিত দল সরকার গঠন করত, তাহলে ক্ষমতাসীন দল বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে এতটা স্বৈরাচারী আচরণ করতে পারত না।
দুদক ও বিচার বিভাগ সংস্কারের বিষয়ে কী ভাবছে?
দুদক ও বিচার বিভাগ বিগত সরকারের দাসে পরিণত হয়েছিল, যে কারণে দুর্নীতি লাগাম ছাড়ালেও এর কোনো বিচার হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এটা হাসতে হাসতে তিনি জাতির সামনে বলেছেন। বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি স্বীকৃত আদর্শে পরিণত হয়েছিল। কোনো বিচার তো হতোই না, বরং দুর্নীতি যে একটা খারাপ বা নেতিবাচক বিষয় সেটা ভাবার সংস্কৃতি পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। দুদক ও বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের প্রতিবেদন পেলে সংস্কারের কাজ শুরু করব আমরা।
জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার বিষয়টি নিয়ে আপনারা কীভাবে কাজ করছেন?
ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা বিভিন্ন জায়গায় প্রচলিত আইনে মামলা করছেন। আমরা তাদের বিরত রাখতে পারি না, সে অধিকার আমাদের নেই। তবে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপ্তি অনেক বড়। সেটার সুষ্ঠু বিচার করতে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করাই সবচেয়ে ভালো হবে। আমরা দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। জুলাই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতাদের উপযুক্ত বিচার করার সুযোগ ও সম্ভাবনা এই আইনেই রয়েছে। বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘের সংস্থার প্রতিনিধিদের এটা বোঝাতে আমরা সক্ষম হয়েছি। ওনাদের কিছু উদ্বেগ ছিল। এ জন্য আইনটিতে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে। এখন আমাদের লক্ষ্য প্রতিশোধ নেওয়া নয়, গণহত্যার উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করা।
বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে কীভাবে দেশে ফেরত আনবেন?
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য বাংলাদেশ ফেরত চেয়েছে। এ জন্য ভারতের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে ভারতকে নোট ভারবাল পাঠানো হয়েছে। এটা প্রক্রিয়াধীন আছে। আমাদের সঙ্গে তাদের একটা এক্সট্রাডিশন (প্রত্যর্পণ) চুক্তিও আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার নামে এ পর্যন্ত কী কী অভিযোগ এসেছে?
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে হত্যাকাণ্ড, গত ১৬ বছরে গুম-ক্রসফায়ার, পিলখানা হত্যাকাণ্ড এবং মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড- মোটাদাগে এই কয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এসেছে। তবে শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভা, বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা চলমান আছে।
প্রবাসী শ্রমিকদের ভোগান্তি নিরসনে কী কাজ করছেন?
বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের শোষণ, পাসপোর্ট ও এনআইডি প্রাপ্তি এবং ব্যাংকে টাকা স্থানান্তর ও টাকা তোলার ক্ষেত্রে ভোগান্তি নিরসনে কাজ চলছে। বিদেশে শ্রমিক শোষণ বন্ধের বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমি সরকারি কাজে কাতারে ছিলাম তিন দিন। আমার হোটেলে যেসব বাংলাদেশি ভাইরা কাজ করেন তাদের বঞ্চনার অনেক খবর শুনেছি। দূতাবাসে আমন্ত্রিত অনেক শ্রমিক ও পেশাজীবী ভাই-বোনের সঙ্গে কথা বলেছি। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বক্তব্যও শুনেছি, সেখানকার প্রবাসী ভাই-বোনদের মূল অভিযোগ পাসপোর্ট-এনআইডি-পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সংক্রান্ত বিষয়ে এবং সেখানে কর্মসংস্থান ও পারিশ্রমিক নিয়ে। এর মধ্যে পাসপোর্টের বিষয়ে আমি ডিজির সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে পাসপোর্ট সরবরাহ শুরু হবে।