সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে হবে: শারমিন এস মুরশিদ

এম ডি হোসাইন
প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১০:৫৭

উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ।
সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ একজন সুপরিচিত নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। তিনি নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ‘মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সদস্য ছিলেন তিনি। সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমসাময়িক নানা বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম ডি হোসাইন।
সম্প্রতি কয়েকটি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, আবার এসংক্রান্ত কিছু মামলা দীর্ঘদিন ধরে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এসব সমস্যা সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উদ্যোগ আছে?
সমাজে নারী নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। আমাদের ক্যাম্পেইন করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে শিশু ও নারী নির্যাতন কমে আসবে। এ ছাড়া যত বড় আন্দোলন দিয়ে আমরা ফ্যাসিজম দূর করেছি, ঠিক তত বড় আন্দোলন দিয়ে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতি বন্ধ করতে হবে। নারী নির্যাতন মামলাগুলো দ্রুত বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে ১৮৯ নারী নির্যাতন ও ৩০ জন কন্যাসহ ৪৮ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে, নারী-শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের পরিকল্পনা কী?
যেকোনো মূল্যে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে সরকার বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের বিধান থাকলেও এ ধরনের অপরাধ প্রত্যাশিত মাত্রায় হ্রাস পাচ্ছে না। নারী ও শিশুর প্রতি পরিবার, কর্মক্ষেত্র, পাবলিক স্পেস, অনলাইনসহ নানাভাবে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, বৈষম্যমূলক সামাজিক আচরণের কারণে সমাজে যুগ যুগ ধরে নারী ও শিশু নানা ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতার ধরনের ক্ষেত্র ও মাত্রা পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রকৃত অর্থে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচে ১৪টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে। বর্তমানে এ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ১৪টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ৬৭টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে টোল ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টার (১০৯), ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, আটটি রিজিওনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি আটটি বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি, রিয়াল টাইম মনিটরিং ডাটাবেইসের মাধ্যমে দেশের নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কাজ করছে।
গৃহকর্মীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের সংস্কৃতি কীভাবে দূর হবে?
গৃহকর্মীদের একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো শ্রম আইনে থাকা আইনি সুরক্ষা থেকে তারা বাদ পড়ে যায়। ফলে তারা ভালো কাজ খোঁজার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়, নিয়মিত শোষণ ও অপব্যবহারের ঝুঁকিতে থাকে। এখন গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫ বাস্তবায়নে সরকার চেষ্টা করছে। তবে গৃহকর্মীদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, ধর্মীয় আচরণ পালন, ছুটিসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে নিয়োগকর্তাদের আন্তরিকতা প্রয়োজন। যে মানুষটি বাড়ির কাজে সহায়তা করছে, তার সুরক্ষার দায়িত্ব আমাদের। তাদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। নিয়মিত ছুটি দিতে হবে।
নারী-শিশু ও অবহেলিত মানুষের জন্য কি সংস্কার হবে?
নারী-শিশু ও অবহেলিত মানুষের সমস্যা সমাধানের দিকে যেতে হলে ভালো তথ্য লাগবে। কিন্তু যথেষ্ট গবেষণা নেই, গবেষণার চর্চাটাই আমাদের নেই। এই জায়গাটা দৃঢ় করতে চাই। আর সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে হবে। যৌক্তিক জায়গা থেকে, বিজ্ঞানের জায়গা থেকে প্রতিটি কাজের একটা ন্যূনতম সময় লাগে; নইলে সেটা করা যায় না। সেই জায়গা থেকে সংস্কারের সময়টুকু সরকারকে দিতে হবে। আর যদি না দেওয়া যায়, সেটা যদি হয় রাজনৈতিক কারণে, তাহলে সেটার দায় রাজনীতিক যারা আছেন, তাদের নিতে হবে। আমাদেরও নিতে হবে, কারণ সংস্কার তো হবে না। আর সংস্কার যদি না হয় তাহলে আমরা তিমিরেই থাকব।
সামাজিক সুরক্ষা বাস্তবায়নে কী ধরনের বাধা মনে করছেন?
শুধু অর্থ বরাদ্দ দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সফল হবে না। কারণ সামাজিক সুরক্ষা খাতে দুর্নীতি বড় বাধা, ফলে শক্তিশালী তদারকি প্রয়োজন। সামাজিক সুরক্ষা খাতে দরিদ্রতা দূর করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলো সহায়তা নির্ভর না হয়ে কর্মমুখী হওয়া উচিত। এত সামান্য টাকায় তাদের কোনো কল্যাণ হয় না। এতে করে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সামাজিক সুরক্ষা খাত নিয়ে কাজ করছে। তবে ভাতাপ্রাপ্তদের তালিকায় পরিবর্তন দরকার। এ খাতে উপকারভোগীদের তালিকায় দুর্নীতি আছে। ড্যাসবোর্ড তৈরি হলে সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিগুলোর কার্যক্রম জোরালো নজরদারির মধ্যে রাখা সম্ভব হবে।
সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতা প্রদান ও ক্ষুদ্রঋণ কী ধরনের পরিবর্তন আনবে?
ভাতা প্রদান ও ক্ষুদ্রঋণ প্রদানে যে সমস্যা দেখতে পাচ্ছি তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে নতুনভাবে ভাবতে হবে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ক্ষুদ্রঋণ ও সঞ্চয় কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে সমগ্র দেশের প্রতিটি গ্রাম থেকে শহর এলাকাকে সুসংগঠিত টেকসই আত্মনির্ভরশীল দারিদ্র্য ও ভিক্ষুকমুক্ত এলাকায় রূপান্তর করা এবং দ্বৈততা পরিহার করা প্রয়োজন। সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গ্রামীণ এলাকা, শহর সমাজসেবা কার্যক্রম, দগ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এবং মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।