Logo
×

Follow Us

সাক্ষাৎকার

যেসব সংস্কার জরুরি তা শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া দরকার: বদরুদ্দীন উমর

Icon

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫, ১০:১০

যেসব সংস্কার জরুরি তা শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া দরকার: বদরুদ্দীন উমর

লেখক, গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর।

লেখক, গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে পিপিই ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু তার। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯৬৮ সালে গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। বর্তমানে বদরুদ্দীন উমর জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি ও সংস্কৃতি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি দেশে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ, নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংকটসহ বিভিন্ন বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকাল-এর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে উঠে আসা নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে আত্মপ্রকাশ করা ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন দিয়েই শুরু করা যাক। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেছিল, তারা সবাই না হলেও অধিকাংশ মিলে জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার, কারণ এই ছাত্ররা হঠাৎ করে হলেও দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তাদের এ সাফল্যে তারা নিজেরাও খুব বিস্মিত। এই ঘটনা যে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে তারাও তা আশা করেনি। আমি সংস্কৃতির জুলাই সংখ্যায় লিখেছি, ‘জনগণকে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগকে তাড়িয়ে দিতে হবে, যেহেতু নির্বাচনের মাধ্যমে এদের তাড়ানো যাচ্ছে না, এদের মেরে তাড়িয়ে দিতে হবে।’ এত তাড়াতাড়ি যে ঘটনাটি ঘটবে তা আমি বুঝতে পারিনি। তবে ঘটবে এটা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু এই ঘটনা জুলাই মাসের মধ্যেই ঘটে গেল বলা চলে। 

ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকেই এই আন্দোলন একটি রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহণ করল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনগণের বিশাল আকারের ক্ষোভ ছিল। সে ক্ষোভের কোনো প্রতিফলন সম্ভব হচ্ছিল না আওয়ামী লীগের দমন-পীড়নের ফলে। বিএনপি থেকে শুরু করে সব দলকে মেরে এমন জায়গায় এনেছিল যে, তাদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই যখন ছাত্র আন্দোলন শুরু হলো, জনগণ ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় একটা বিস্ফোরণের মতো ঘটল। আওয়ামী লীগের যে শাসন, সেটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিল। এই যে একটা সাফল্য, এরপর ছাত্রদের মধ্যে যে উদ্দীপনা, তাতো শেষ হলো না। সেটা রয়েছে এবং এরপর রাজনৈতিকভাবে যে তারা বসে পড়তে পারে না তা স্বাভাবিক। তারা চেষ্টা করবে এর পরবর্তী পর্যায়ে কাজ করতে। কাজ করার জন্য তো সংগঠন দরকার। তাই তারা একটা পার্টি গঠন করেছে- এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এই দলটির নীতি-আদর্শ ইত্যাদি ব্যাপারে যে বক্তব্য, তা খুব একটা গভীর চিন্তাভাবনা থেকে আসছে, এটা মনে হয় না। তাদের মধ্যে সততা আছে, চেষ্টা আছে দেশের জনগণের জন্য কাজ করার। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা নেই। 

সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য তাদের যে চিন্তাধারা- এ বিষয়ে তাদের বক্তব্যও খুব অস্পষ্ট। যেমন একটা কথা বলা যায়, এরা বলছে যে তারা ‘বৈষম্যবিরোধী’। কোটা বৈষম্যই একমাত্র বৈষম্য নয়, সামাজিক বৈষম্যও রয়েছে। দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। কোটা বৈষম্যের সঙ্গে সামাজিক বৈষম্যের সম্পর্ক নেই। কিন্তু এরা যেভাবে আলোচনা করে তাতে মনে হয় যে দুটো একই পর্যায়ে। কোটা বৈষম্যটা হচ্ছে চাকরিবাকরির ব্যাপারে একই শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য। আর সামাজিক বৈষম্য মানে হচ্ছে দুটো শ্রেণির মধ্যে বৈষম্য- একটা গরিব আরেকটা ধনী। একটা হচ্ছে শোষক আরেকটা শোষিত- এই হচ্ছে সামাজিক বৈষম্যের মূল ভিত্তি। যা অর্থনৈতিক। সে অর্থনৈতিক বিষয়ে এদের তো কোনো বক্তব্য এখনো দেখলাম না। বৈষম্য বলতে সামাজিক ক্ষেত্রে তারা কী বোঝে, এর কোনো ব্যাখ্যা বিবরণ এখন পর্যন্ত দেখলাম না। এটা তাদের একটা বড় দুর্বলতা। তা ছাড়া সামগ্রিকভাবে দেশের পরিস্থিতির ব্যাখ্যা তাদের দিক থেকে এখনো পাওয়া যায়নি। কাজেই দলটা ঠিক কীভাবে দাঁড়াবে, এটা এখনো অনিশ্চিত। খালি শুভেচ্ছা দিয়েই তো কাজ হয় না, করণীয় কর্তব্য সম্বন্ধে সঠিক ধারণা, পরিস্থিতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং যাকে ম্যাচিউরিটি বলা হয়- এসব না থাকলে কোথায় দাঁড়াবে তারা সেটা একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। একটা দল গঠন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এ দলটি কীভাবে বিকশিত হবে, সেটা এখনও বলা যায় না।

বিএনপি ও বাম দলগুলো দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চায়। অন্যদিকে নবগঠিত ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের পর নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

নির্বাচন তো দিতেই হবে, কারণ এ সরকার অনির্বাচিত। বিশেষ পরিস্থিতিতে তারা ক্ষমতায় এসেছে, যদিও এটা খুব স্বাভাবিক এবং সঠিক। কারণ আওয়ামী লীগকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তাতে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে একমাত্র বিকল্প ছিল সামরিক বাহিনীর সরকার গঠন। সেদিক দিয়ে বলা চলে এ সরকার গঠন করা সঠিক ছিল। কিন্তু এ সরকার তো অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকতে পারে না। এটার প্রধান ভূমিকা একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো। ১৯৯০ সালের পর থেকে এখানে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো হয়েছে সেগুলোর মেয়াদ ঠিক করা ছিল তিন মাস। কিন্তু যে সরকার এখন গঠন করা হয়েছে, এর মেয়াদ তো কেউ ঠিক করে দেয়নি। এর মেয়াদ তাদেরই ঠিক করতে হবে। এখন পর্যন্ত এরা বলছে, এই বছরের শেষ কিংবা সামনের বছরের প্রথমদিকে নির্বাচন হবে। কিন্তু এখনো কোনো তারিখ তারা ঘোষণা করেনি। যাই হোক, এটা একটা যুক্তিযুক্ত সময়। কারণ এদের তো কিছু কাজ করতে হবে; যদিও সব কাজ এদের করার কথা নয়। সরকার অনেক কমিশন করেছে, কিন্তু কমিশন অনুযায়ী সব কাজ শেষ করা তো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কমিশন হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের বিষয়ে কমিশন যে পরামর্শ দিয়েছে সে অনুযায়ী একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। কিন্তু কখন নির্বাচন হতে হবে এটা নিয়ে একটা বিতর্ক আছে। নাগরিক পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী বলছে, সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, রাষ্ট্রের সংস্কার এসব করে তারপর নির্বাচন। এটা আমি মনে করি একেবারে ভুল কথা। এই যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে এর বিচারপ্রক্রিয়ায় তো বছরের পর বছর লেগে যাবে। যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে এর বিচার তো সহজ কাজ নয়, অনেক সময় লাগবে। এত সময় একটা অনির্বাচিত সরকার কীভাবে ক্ষমতায় থাকবে? আর বিচারের যে কাজ এটা তো জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা করতে হবে, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে। 

তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় খাতে যে বিভিন্ন রকম সংস্কারের প্রক্রিয়া চলছে- এত বড় একটা কাজ কোনো অনির্বাচিত সরকারের নয়। এর জন্যও জনগণের প্রতিনিধিত্বের দ্বারা গঠিত সরকার লাগবে। সে জন্য নির্বাচন দরকার। এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দরকার। হাতের কাছে যে সংক্ষিপ্ত কাজ আছে, কতগুলো সংস্কার, যেগুলো খুব প্রয়োজনীয় সেগুলো করে এ সরকারকে নির্বাচন দিতে হবে এখনই। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচন বন্ধ রাখার মানে হচ্ছে এ সরকারের অনির্দিষ্টকালের জন্য থাকা। দেশে যে রকম পরিস্থিতি বিরাজ করছে চারদিকে, তাতে একটি অনির্বাচিত সরকার বেশিদিন থাকলে তাদের পক্ষেও চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর। যদি তারা বেশিদিন থাকার চেষ্টা করে, তাহলে তারা তাদের যে জনপ্রিয়তা- একদম সম্পূর্ণ হারাবে। মানুষ তাদের বিপক্ষে চলে যাবে। 

ছাত্ররা যে রাজনৈতিক দল করেছে, সে দল গঠন করার পর থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়ই তারা ভাবছে। এমনকি তারা বলছে নির্বাচন হলে এখনই তারা নির্বাচনে যেতে পারে। এটা তাদের ভুল চিন্তা, এখনই নির্বাচনে গেলে তারা ভোট পাবে না। কাজেই তাদের মধ্য থেকে আরেকটা চিন্তা হচ্ছে যে, সময় দরকার। নির্বাচনে যাওয়ার আগে দল গুছিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দরকার। যেটা জামায়াতে ইসলামীরও দরকার। অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনের জন্য তৈরি হয়ে আছে।

আসল ব্যাপার এটা- বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার জন্য তৈরি, কিন্তু এদের কোনো প্রস্তুতি নেই। জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে কাজ করতে না পারার ফলে সে অর্থে তারা সংগঠিত ছিল না, এখন চেষ্টা করছে। তাদের সময় দরকার, এ জন্যই তারা নির্বাচন পেছাতে চাইছে। কিন্তু নির্বাচন পেছালে খুব অসুবিধা হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দেওয়া দরকার। দেশে যে বিশাল আকারে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, তাকে একটা সুশৃঙ্খল জায়গায় এনে দাঁড় করানো দরকার, একটা নির্বাচিত সরকার ছাড়া কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়। কাজেই যেসব সংস্কার এখনই জরুরি তা শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া দরকার। 

নিকট ভবিষ্যতে নতুন কোনো রাজনৈতিক সংকট দেখা দিতে পারে?

১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ উৎখাত হওয়ার পর তাদের কোনো নরেন্দ্র মোদি বা ভারত ছিল না। তারা নির্বাচিত যে সরকার তাকে ডিস্টার্ব করেনি কোনোভাবে। কিন্তু এইবারে যে আওয়ামী লীগ উৎখাত হয়েছে, মুসলিম লীগের মতোই অবস্থা খারাপ তার। শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু তবুও দেখা যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে সক্রিয়। এটা সম্ভব হচ্ছে এ জন্য যে, ভারত এ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর সে ভারতে অবস্থান করছে। এখন ভারত তাকে ও আওয়ামী লীগের লোকদের ব্যবহার করছে। তাদের ব্যবহার করে এখানে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। কাজেই এটাকে বিশাল বড় সংকট না বললেও একটা সংকট বলতে হবে।

এই দেশে এসে আওয়ামী লীগের আর নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু প্রতিহিংসামূলকভাবে তারা নানা কাজ করছে। মুখে তারা বলছে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। আসলে শত্রুতা করছে। যার ফলে এখানে নানা রকম আক্রমণ, লুটতরাজ, ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমও চলছে। এর জন্য মানুষ বর্তমান সরকারকে দোষারোপ করছে যে, তারা সামাল দিতে পারছে না। আসলে ইন্ডিয়া এবং আওয়ামী লীগ এখানে তাদের যে কিছু লোক রয়েছে, এদের মাধ্যমে প্রচুর টাকা-পয়সা দিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার তাদের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে পরিস্থিতি পুরোপুরি সামাল দিতে পারছে না এটা ঠিক, কিন্তু এ সংকট যে ভারত এবং আওয়ামী লীগ তৈরি করছে, এটা মনে রাখতে হবে।

১৯৭১ সালের পূর্বে এই ভূখণ্ডে রাজনৈতিক আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের যে প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে তা আর দেখা যায়নি...

১৯৭১ এবং তার পূর্বে এ দেশের রাজনীতিতে বুদ্ধিজীবীদের একটা ভূমিকা ছিল এটা ঠিক। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে দেখা গেছে, আর সেই ভূমিকা তাদের নেই। তার কারণ আগেকার বুদ্ধিজীবীদের সামনে অত সুযোগ-সুবিধা ছিল না, সরকার তাদের প্রতিপক্ষ ছিল। সে জন্য সরকারের বিপক্ষে তাদের দাঁড়াতে হয়েছিল সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের জন্যে। কিন্তু ১৯৭২ থেকে দেখা গেল এখানকার বুদ্ধিজীবীদের সামনে বিশাল সম্ভাবনা। ‘স্কাই ইজ দ্য লিমিট’ যাকে বলে। বুদ্ধিজীবীদের নানা রকম সুযোগ সুবিধা দিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে দাঁড় করানো হলো। আর যারা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে রইল তাদের ফ্যাসিস্ট কায়দায় মেরে জব্দ করা হলো। ১৯৭২ সাল থেকে এখানে যারা সরকারবিরোধী তাদের মারা হলো, তাদের ওপর জেল-জুলুম চলতে লাগল, তাদের বাকস্বাধীনতা একদম কেড়ে নেওয়া হলো। অন্যদিকে যারা সরকারের পক্ষে তাদের নানা রকম সাহায্য-সহযোগিতা, বৈষয়িক জীবনে উন্নতির ব্যবস্থা করা হলো। কাজেই সেই সময় থেকে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এক ধরনের সুবিধাবাদ তৈরি হলো। এই সুবিধাবাদী প্রবণতা ১৯৭২-এর পর থেকে কমেনি, বরং বেড়েছে। প্রতিটি সরকারের আমলেই বুদ্ধিজীবীরা সরকারের সঙ্গে লাইন লাগায়। জিয়াউর রহমানের সময় হয়েছে কিছুটা, এরশাদের সময়ও হয়েছে। কিন্তু হাসিনার সময় দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বিশাল আকারে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে সরকারের আশ্রিত হিসেবে কাজ করেছে এবং অন্য যারা সেটা করেনি তাদের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকার খড়্গ হস্ত হয়ে নির্যাতন চালিয়েছে। এই কারণে সে সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী যারা ছিল তারা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে খুব বড় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। অন্যদিকে যারা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে টাকা-পয়সা খেয়ে উপকৃত হয়েছে, তারা তো আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যায়নি। এ ধরনের বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গেছে এ রকম বুদ্ধিজীবী অনেক কম। আর যারা বিরুদ্ধে গেছে তাদের অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে। 

বাংলাদেশে বর্তমানে ৫৫টি পাবলিক এবং প্রায় ১০০টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশালসংখ্যক শিক্ষক কর্মরত থাকলেও গুণগত মানের শিক্ষকের বেশ ঘাটতি রয়েছে। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষকতা বা লেখালেখি করেন, সবই নিজের ক্যারিয়ারের জন্যে। ফলে এখানে পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যতই হাজার হাজার শিক্ষক থাকুক, সংখ্যা দিয়ে কিছু হবে না, মানটাই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া আরেকটি জিনিস হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা এখানে এমনভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে যে, ক্লাস থ্রি থেকে ওপর পর্যন্ত যে শিক্ষা, তা আর আগের মতো হচ্ছে না। কাজেই এখন যারা শিক্ষকতা করছে তারা আগেকার মতো শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। যথাযথ শিক্ষিত নয় এই রকম শিক্ষকরা স্কুল-কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও কাজ করছে। কাজেই ছাত্রদেরও মান পড়ে গেছে অনেক। যারা ক্লাস থ্রি থেকে শুরু করে ওপরের দিকে এসে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে, আগে তাদের যে শিক্ষার মান ছিল, তা পড়ে যাওয়ার কারণে পরের দিকে এখন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দেখা যাচ্ছে এদের ইন্টেলেকচুয়াল মান কম। এদের মধ্যে রিসার্চ, সিরিয়াস চিন্তার কোনো ব্যাপার নেই। ঢাকা ইউনিভার্সিটির মতো পাবলিক ইউনিভার্সিটিতেও ‘নিজেদের কী হবে’ এই চিন্তাতেই তারা থাকে। কাজেই শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে আগেকার শিক্ষকদের মধ্যে বিদ্যাচর্চার যে ঐতিহ্য ছিল তা এখন প্রায় শেষ হয়ে গেছে বলা চলে। শিক্ষাব্যবস্থার যেহেতু অবনতি ঘটেছে, তাই এই শিক্ষকদেরও অবনতি ঘটেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫