Logo
×

Follow Us

সাক্ষাৎকার

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আমাদের দেশে কখনো সফল হয়নি: মাহমুদুর রহমান মান্না

Icon

বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪১

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আমাদের দেশে কখনো সফল হয়নি: মাহমুদুর রহমান মান্না

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না।

১৯৬৮ সালে ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নের সময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মাহমুদুর রহমান মান্না। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে চাকসুর জিএস নির্বাচিত হন মান্না। ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগ ভেঙে জাসদ ছাত্রলীগ তৈরি হলে মান্না সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৬ সালে কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৭৯ এবং ১৯৮০ টানা দুইবার ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। মাহমুদুর রহমান মান্না বর্তমানে রাজনৈতিক দল ‘নাগরিক ঐক্য’র সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। দলটি রাজনৈতিক জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’র অন্যতম শরিক। সম্প্রতি ছাত্ররাজনীতি, নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন সাম্প্রতিক দেশকাল-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বখতিয়ার আবিদ চৌধুরী।

আপনি তো চাকসুর  জিএস এবং ডাকসুর  ভিপি ছিলেন, জনপ্রিয় ছাত্র নেতাদের একজন। সে সময়ের সঙ্গে এখনকার  ছাত্রনেতাদের কী পার্থক্য দেখতে পান? সময় তো একটা পার্থক্য গড়ে দেয় নিশ্চয়ই...

এখনকার ছাত্রনেতারা সব জাতীয় নেতা হয়ে গেছে। ফলে এখন তখন মেলানো বেশ কঠিন। এখন যাদের লেখাপড়া শেষই হয়নি, তারা সব জাতীয় নেতা হয়ে গেছে। এর বাইরে তো ছাত্রনেতা দেখছি না। আমি সময়কে অনুভব করি। একটা কবিতার দুটি চরণ এখানে বলে রাখতে হয়, ‘হে অতীত তুমি ভুবনে ভুবনে, কাজ করে যাও গোপনে গোপনে’। টাইম অলসো ওয়ার্কস। আপনি যে রকম শারীরিক পরিশ্রম করছেন সময় সে রকম নয়। কিন্তু সময়ের বিবর্তনের মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখবেন, মানুষের মানসিকতা বদলে যায়। আমি রবীন্দ্রসংগীত ও হেমন্তের ভক্ত। আজ থেকে ২০-২২ বছর আগে আমার স্টাডি রুমে বসে হেমন্তের গান শুনছিলাম। আমার ছেলে তখন ও লেভেলে পড়ছে। বলল, এগুলো গান!  এই হলো সময়। আমি পিতা হেমন্তের গানে মুগ্ধ, কিন্তু ছেলে নয়। আমরা যখন ছাত্ররাজনীতি করছি তখন আমাদের কাছে ব্যাপারটা দেশপ্রেম, একটা ভালোবাসা ছিল। এখন বিষয়টি সময়ের কারণে অনেক বেশি বাস্তববাদী, বৈষয়িক। অনেক বেশি হিসেবি, সে কারণেই বাস্তববাদী। উদাহরণস্বরূপ ২৪ শের অভ্যুত্থানের দিকে তাকানো যাক। এই অভ্যুত্থানে তারা যেভাবে এলো সেভাবে কিন্তু ’৬৯-এ আসেনি, ’৫২-তে আসেনি। সামনে এত বড় বাধা তারা সেটা অতিক্রম করেছে, অর্থাৎ মরলে মরব পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই, সামনে বাংলাদেশ। এই যে পরিবর্তন, এটাই বড় মনে করি আমি। বাকিটা মূল্যবোধের ব্যাপার। 

শেখ হাসিনার আমলে খুব শুনতাম, ভাই দেশের ছাত্ররাজনীতি হবে না, সব নষ্ট হয়ে গেছে। সে সময় আমার একটা বই বেরিয়েছিল, ‘বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’। সেখানে একটা চ্যাপ্টারে আমি লিখেছি, ‘ছাত্ররাই আগামীর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ল্যান্ডমার্ক’। আমি আজও তাই মনে করি। যদিও অনেক বেশি বিপথগামিতা আজও আছে। অনেকে জানে না ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় পল্টন ময়দানে তোফায়েল আহমেদ বক্তৃতা করেছিলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নামে চাঁদাবাজি হচ্ছে। আমরা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কাউকে চাঁদা তোলার অধিকার দিইনি। কেউ যদি চাঁদা তোলে তাকে ধরবেন এবং পুলিশে দেবেন কিংবা আমাদের হাতে তুলে দেবেন।’ মূল্যবোধ তখন এটা ছিল। এখন ছাত্রদের মধ্যে ওই রকম একজন প্রভাবশালী নেতা নিজের লোক খাটিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে ফেলে।

আমাদের একটা গৌরবোজ্জ্বল সময় ছিল। আমাদের নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। উনি ওনার মতো করে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন, সেভাবে কাজ করতেন। আমরা তার অনুসারী ছিলাম। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের সরকার যে দুর্নীতি ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, তার প্রতিবাদে আমরা বেরিয়ে আসি। ছাত্ররাজনীতির মূল্যবোধ নষ্ট করে মূল দল। ১৯৭৩-এ ডাকসু ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করা হলো। সিপিবি এত ভালো ভালো কথা বলে, তখন বিবৃতি দিয়েছিল ‘এটা জাসদপন্থি ছাত্রলীগ করেছে’। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তখন ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। তিনি যখন পরে সিপিবির প্রেসিডেন্ট হলেন, ভুল স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিলেন ‘সেদিন আমরা একটা অন্যায় বিবৃতি দিয়েছিলাম’। তবুও আমি বলব যে ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে একটা মূল্যবোধ আছে, তারা ভুল স্বীকার করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ জীবনে স্বীকার করবে না। এত অত্যাচার, লুটপাট করেছে মিনিমাম অনুতাপ নেই তাদের মধ্যে। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পরে বেধড়ক চাঁদাবাজি হলো, এটা তো মূল্যবোধের অভাব। 

১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৯০ এবং ২০২৪। এই সময়ে রাজনীতির গুণগত মানের পরিবর্তন কি দেখতে পাচ্ছেন? 

একদম পারছি না, তা নয়। সমাজ কখনো পেছনে হাঁটেনি। এমনিতেই বাংলাদেশ একটি অদ্ভুত দেশ। এখানে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় বিরোধীদলীয় নেতারাও পালিয়ে গেছেন। কিন্তু এবারের বিশাল গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। বৃহৎ রাজনৈতিক দল সাইড লাইনে বসে দেখেছে। যখন সরকারের পতন হলো, তার তিন বা চার দিনের মাথায় পার্টি অফিসের সামনে জনসভা করল। নির্বাচনের বিষয়ে তাড়াহুড়ো শুরু করলে মানুষ তা পছন্দ করল না। তখন তারা বলল, যৌক্তিক সময় আমরা সরকারকে দেব। তার মানে রাজনীতিতে গণচেতনা যে বিষয়টি, তা অনেক উন্নতি করেছে। আবার মানুষ যদি বলে আমরা ইউনুসকে চাই, এর মধ্যে একটা ভয়ের ব্যাপার আছে- এতে ব্যক্তি স্বৈরাচার, ব্যক্তি ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার সুযোগ হয়।

আপনি তো নাগরিক ঐক্যের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচন ও সংস্কারের প্রশ্নে আপনাদের অবস্থান সম্পর্কে বলুন।

আন্দোলন যখন করছি তখন মনে করতাম আন্দোলনের বিজয়ী শক্তিকে দিয়ে যতদূর পারি সংস্কার করে তারপর নির্বাচনে যাব। কিন্তু আন্দোলনটা হলো তো উল্টোভাবে। যারা এলেন তারা আন্দোলনকারী শক্তিদের সঙ্গে গেলেন না। শুরুতে এ রকম একটা সমস্যা তৈরি হলো। আমরাই সংস্কারের কথা প্রথম বলেছিলাম, মানে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। বিএনপি পরে সংস্কারে রাজি হয়। সংস্কার যা হওয়া উচিত সেগুলোর মধ্যে আমরা যেতেই পারিনি। তিপ্পান্ন বছর ধরে লিখে রাখলাম ‘সমাজতন্ত্র আমাদের মূলনীতি’। কিছু করেছি সমাজতন্ত্রের জন্য? ‘গণতন্ত্র আমাদের মূলনীতি’ ১৫ বছর এবং তারও আগে ছিল স্বৈরাচার। লেখালেখিতে কিছু যায় আসে না। দেশের মানুষের মাঝে বোঝাপড়া দরকার- জাতিত্ববোধ বলতে তার অনুভূতিটা কী? বাঙালি না বিহারি- এ প্রশ্নের চেয়ে বড় ভাত খেতে পাচ্ছি কি না। সংস্কারের নামে একটা পেন্ডুলার বাক্স খোলা হয়েছে। এটা বন্ধ করা যাবে কী করে তা তারাও জানে না। আমি একভাবে জানি, সত্যের প্রশ্নে মেজরিটি-মাইনোরিটি নেই। গণতান্ত্রিক শাসনে মেজরিটি-মাইনোরিটি আছে। কিন্তু আমি তো সংস্কার করছি, এটা তো সত্যেরই লড়াই। যিনি এটা লিড করছেন সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমন্বয় করার দায়িত্ব তার। যদি সমন্বয় করতে না পারেন, সবাইকে ঐকমত্যে আনতে না পারেন তাহলে সংস্কার এগিয়ে নেওয়া তো সম্ভব নয়। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অনেক কাজ করতে হবে। বিশেষ করে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে। 

জাতীয় নির্বাচনের আগে এনসিপি চাইছে গণপরিষদ নির্বাচন। কিন্তু বেশির ভাগ দল চাইছে জাতীয় নির্বাচন। এ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে সামনে?

আমরাও জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে। এনসিপি এটা বলছে বটে, কিন্তু তারা ঝুঁকি নেবে না। কারণ এনসিপির বক্তব্যে এখন পর্যন্ত সে রকম মরিয়া আভাস পাওয়া যায়নি। এখনো তারা রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ব নয়। অদ্ভুত সব কথা তারা নিয়ে আসছে, যেমন- ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’। মানুষ ফার্স্ট রিপাবলিকই বোঝেনি আবার সেকেন্ড রিপাবলিক! এটা কাকে বোঝাবে, কীভাবে? রাজনীতিতে কখনো ওই ধরনের বক্তব্য, ন্যারেটিভ আনাই উচিত নয়, যা মানুষ সহজে বুঝতে পারে না। 

অভ্যুত্থান-পরবর্তী এখন পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর ব্যাপক উত্থান দেখা যাচ্ছে...

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আমাদের দেশে কখনো সফল হয়নি। অপজিশনে ফাইট করার মতো কোনো ফোর্স যদি না থাকে, তবে স্বাভাবিকভাবে তার বিকাশ হবে। ধরুন স্বাধীনতার পর যদি আওয়ামী লীগ না হয়ে একটি প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টির হাতে দেশ চলত, তাহলে এই ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিকাশই হতো না। এখনো এদের যেটুকু বিকাশ দেখা যায়, সেটা আওয়ামী লীগের বাড়াবাড়িতে। একই সঙ্গে আমি মনে করি, একটা বড় অংশে বিএনপির পরাজয়ের কারণে। তারা এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে, বলুক এটা তো ভালো। কিন্তু আগে কেন বলেনি- এটিরও একটি যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা হয়নি যে আমরা এই যুক্তিতে, তাত্ত্বিকভাবে এই অবস্থান থেকে বলছি। স্বৈরাচারকে মোকাবিলা করে বুদ্ধি দিয়ে, ঠিক একইভাবে এই অন্ধত্বকে মোকাবিলা করতে হবে আলো দিয়ে। 

নাগরিক ঐক্য তো গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচির মাধ্যমে আপনারা বিভিন্ন আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। আগামী দিনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো জোট হতে পারে?  

হতে পারে..., কিন্তু নিজেদের মধ্যে ভালো করে দেখাসাক্ষাৎই হয়নি বহুদিন। সবাই নিজ নিজ ঘর (দল) গোছানোর কাজে ব্যস্ত আছে। এ ব্যাপারে আলোচনাই হয়নি। আমাদের নিজেদের (গণতন্ত্র মঞ্চ) মধ্যেই বৈঠক হয়নি এখনো। তবে তুলনামূলকভাবে গণতন্ত্র মঞ্চ ভালো আছে, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ আছে। ঐক্যটা ছিল প্রধানত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে। পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা ছিল না। 

গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির কি খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে? আপনার বক্তব্য ধরে যদি বলি...

উই আর স্টিল ভেরি গুড। 
আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও।  


Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫