বর্তমান সরকার অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে: ড. এ কে এনামুল হক

আল আমিন
প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৫:২৮

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক সম্প্রতি সরকারের উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ’ (বিআইডিএস)-এর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনীতি, পরিবেশগত টেকসই এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তার ব্যাপক দক্ষতা রয়েছে। তিনি কানাডার গুয়েলফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থনীতিতে পিএইচডি এবং কৃষি অর্থনীতিতে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেছেন, পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএসএস এবং বিএসএস (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি দেশের সমসাময়িক অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেছেন সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশকাল নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার আল আমিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক শুল্কনীতিতে বাংলাদেশে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে?
প্রথমত, এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশ আমেরিকার সঙ্গে যথাযথভাবে নেগোশিয়েট করতে ব্যর্থ হলে আমাদের রপ্তানি কিছুটা কমবে। এই নীতির ফলে মার্কিন বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে। তাই ধারণা করা যায় এটা তাদের আমদানিতে প্রভাব ফেলবে। এ জন্য সরকার এরই মধ্যে সম্ভাব্য সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। সামনে আরও কীভাবে এটাকে মোকাবিলা করা যায় সে ব্যাপারে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন শুল্কনীতি মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে। যেমন- চায়না এককভাবে এটাকে মোকাবিলা করছে এবং পাল্টা শুল্কারোপ করেছে। কিছু দেশ চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করছে। ইউরোপ এখনো কিছু করেনি। এমনকি এরা নেগোশিয়েটও করতে চাচ্ছে না। আবার কিছু দেশ (ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ) নেগোশিয়েট করতে চাচ্ছে। আমরা (বাংলাদেশ) চিঠি দিয়েছি নেগোশিয়েট করার জন্য। অর্থাৎ ছোট দেশগুলো একভাবে চিন্তা করছে, বড় দেশগুলো অন্যভাবে চিন্তা করছে।
তবে আমার অবজারভেশন হচ্ছে যতটা ক্ষতি বলে মনে করা হচ্ছে, অতটা আঘাত আসবে না। ট্যারিফ তো প্রায় ১৮০টি দেশের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে। এ জন্য আমাদের রিলেটিভ প্রাইস তুলনামূলকভাবে একই জায়গায় থাকবে। সেই ক্ষেত্রে আমি আশা করি না যে আমাদের ক্ষেত্রে মেজর ইমপ্যাক্ট আসবে। অনেক দেশের ওপর আমাদের তুলনায় বেশি হারে ট্যারিফ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের তুলনায় আমাদের প্রডাক্ট সস্তা। অতএব যতটা আমরা ভয় পাচ্ছি ততটা ভয়ের কারণ দেখছি না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সাইজ অনুযায়ী বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। সদ্যসমাপ্ত বিনিয়োগ সম্মেলন এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশে বিনিয়োগ আনা। দেশে বিনিয়োগ আনার জন্য আমরা প্রিপারেশন নিচ্ছি এবং এ ধরনের একটি উদ্যোগ দরকার ছিল। আমি মনে করি না যে মেজর ইনভেস্টমেন্ট ইমিডিয়েটলি আসবে। তবে একটা প্রসেসের মধ্যে থাকবে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ধারণা দেওয়ার জন্য এ সম্মেলন বড় ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু টেকসই বিনিয়োগের জন্য টেকসই সরকারি নীতি প্রয়োজন। বর্তমানে দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে এবং তারা কবে ইলেকশন দেবে তা এখনো স্পষ্ট না। তারা যদি বলে তারা পাঁচ বছর থাকবে তাহলে বিনিয়োগকারীরা একভাবে চিন্তা করবেন। আবার তারা যদি বলে তারা খুব দ্রুত নির্বাচন দেবে, তাহলে বিনিয়োগকারীরা কারা সরকারে আসবে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন। তাই আদর্শ বিনিয়োগের জন্য সরকারের ডাইরেকশনটা গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য ইলেকশন পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করবেন।
তবে এখন বলা হচ্ছে ইলেকশন হবে ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে। তার মানে বিনিয়োগ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা সবাই প্রসেসের মধ্যেই থাকবেন। সো এটা হচ্ছে প্রসেস মুভমেন্ট। এটা ঠিক, বিনিয়োগ কালকেই যে আসবে এটা আশা করা ঠিক হবে না। তবে প্রসেসে তারা থাকবেন এবং তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী।
দেশে বিনিয়োগের জন্য একটা বড় সমস্যা হলো ইনভেস্টররা অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। যেমন- গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে হামলা হতে দেখা যায়। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
এটা দেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছুটা প্রযোজ্য হলেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তো সব জায়গায় বিনিয়োগ করবেন না। তারা বিনিয়োগ করবে ইকোনমিক জোনগুলোতে, সেখানে যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে। এই নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেদ করে হামলা করা সম্ভব নয়। তাই বিনিয়োগকারীরা ভয়ভীতিহীনভাবে দেশে বিনিয়োগ করতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য টেকসই নীতি প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে প্রেডিক্টেবল নীতির সংকট আছে বলে মনে করেন অনেক বিনিয়োগকারী। যেমন- ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ায় সরকার। আবার আন্দোলনের মুখে অনেক পণ্য থেকে ভ্যাট কমানো হলো। এতে ব্যবসায়ীরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে পারে না। আপনি কী মনে করেন?
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা আছে। তবে সব ক্ষেত্রে নেই। দেশীয় ব্যবসায়ীদের জন্য এটা সমস্যার কারণ হলেও বিদেশিদের জন্য প্রযোজ্য নয়। সরকার এরই মধ্যে প্রেডিক্টেবল নীতি, বিশেষ করে করনীতি প্রণয়নের জন্য কাজ করছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য এটা ইম্পর্টেন্ট ফ্যাক্টর না। দেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্য, তবে ভ্যাট যেসব জায়গায় বিদ্যমান, এগুলো বহুদিন ধরে আছে। তবে ইমপ্লিমেন্টেশনের বিভিন্ন ফেজ থাকে নানা দাবিদাওয়ায়- এটা পেছায় আবার আগায়। তবে আমি মনে করি না ভ্যাটের কারণে ব্যবসায় অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বর্তমান সরকার তো অন্তর্বর্তী সরকার এবং এ ধরনের সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বল্পসময়ের। যেটা মোটামুটিভাবে বলা যায়, অর্থনীতিতে আমরা কী আশা করছিলাম? আমরা আশা করছিলাম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কমবে। কিছুটা কমেছে, এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। আশা করছিলাম বিনিয়োগ বাড়বে, সেটার প্রচেষ্টাও চলছে। সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, অর্থনীতিতে একটা স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। যেটা খুব দরকার ছিল।
মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতির একটা বড় সমস্যা। যদিও বর্তমান সরকার অনেক উদ্যোগ নিয়েছে এটাকে কমিয়ে আনার জন্য। আপনি কী মনে করেন?
ইনফ্লেশন জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত কম থাকে। কারণ এ সময় সিজন থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই কিছু জিনিসের দাম কম থাকে। এর সঙ্গে সরকার বেশ কিছু পজিটিভ উদ্যোগ গ্রহণ করে দ্রব্যমূল্যের দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। এ কারণে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের দাম কম ছিল। মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। তবে ইনফ্লেশন সবচেয়ে বেশি হয় জুলাই মাসে। কারণ এ সময় বর্ষা থাকে, উৎপাদনে সমস্যা দেখা দেয়, সব কিছু পানিতে ডুবে থাকে। তাই সরকারের উদ্যোগগুলো কাজে লাগছে কি না আমাদের সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা বলা যায় এখনো পর্যন্ত ইনফ্লেশন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। এটা সরকারের জন্য একটা বড় সাফল্য।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।