Logo
×

Follow Us

সাক্ষাৎকার

আইন দেখে আমরা সরকার পতন করিনি: জয়নাল আবেদীন শিশির

Icon

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৯

আইন দেখে আমরা সরকার পতন করিনি: জয়নাল আবেদীন শিশির

জয়নাল আবেদীন শিশির। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

গত ১৭ বছর বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে- এগুলো একদম পরিকল্পিতভাবেই হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত ভারত এবং তার সহযোগী সংগঠন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের এই টাকা পাচারের পেছনে কিছু কারণ আছে। তারা বিশ্বাস করত বাংলাদেশের জনগণ তাদের দেশে থাকতে দেবে না। তাদের অবৈধ সম্পদ দেশে নিরাপদ না। যেকোনো সময় জনগণ তাদের প্রাপ্য সম্পদ বুঝে নেবে বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হতে পারে। এই ভয়েই তারা সব টাকা দেশ থেকে বের করে নিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের হিন্দু এবং লোকাল নেতারা ভারতে আর বড় দুর্নীতিবাজরা টাকা পাচার করেছে ইউরোপ, দুবাই ও সিঙ্গাপুরে।

সরকারের শ্বেতপত্র অনুযায়ী, ৩৩৪ বিলিয়ন টাকা তারা পাচার করেছে। এটা সর্বনিম্ন। শুধু গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতেই এই পরিসংখ্যান। গণমাধ্যমে যেগুলো প্রকাশিত হয়নি সেসব টাকার পরিমাণ কত তা আমরা জানি না। এর মধ্যে সে সময় মিডিয়ার স্বাধীনতা কী রকম ছিল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই স্বাধীনতার মধ্যে হওয়া রিপোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী যদি পাচার করা টাকার পরিমাণ এত হয় তাহলে আরো কত টাকা তারা পাচার করেছে, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। আমার ধারণা, টাকা পাচারের যে পরিসংখ্যান বের হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থাৎ ৭০০ বিলিয়ন টাকা আওয়ামী লীগ পাচার করেছে।  

ক্ষতি কী?

আমাদের সাড়ে ৪০০ বিলিয়নের জিডিপি, আর ২০ বা ২১ বিলিয়নের রিজার্ভ। এই বিবেচনায় আওয়ামী লীগ এ রকম ১৩টি বাংলাদেশের সম্পদ পাচার করেছে। আর আমার ধারণা যদি সঠিক হয় অর্থাৎ ৭০০ বিলিয়ন টাকা পাচারের বিষয়টি, তাহলে আওয়ামী লীগ ৩০টি বাংলাদেশের সম্পদ পাচার করেছে।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশটাকে ফোকলা বানিয়ে চলে গেছে। এর পরও বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এটি সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হতে পারে। ফরাসি, রুশ, চায়নিজ বা কিউবা, ইরান বা সর্বশেষ তিউনিশিয়া বিপ্লবের পরে সেই দেশগুলোতে ইকোনমিক স্ট্রাগল শুরু হয়েছিল। কারণ পরাজিত শক্তি দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়ে যায়। বিপ্লবের পর অনেক সময় দুর্ভিক্ষও হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু দেশ ব্যতিক্রম। কিন্তু বাংলাদেশে আল্লাহর রহমতে কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। দ্রব্যমূল্যের দাম সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমার মতে, বাংলাদেশে ভালো একজন অর্থনীতিবিদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন, সে জন্য দেশের ইকোনমিটা আমরা কোনো মতে ঠিক রাখতে পেরেছি। 

প্রতিটি দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে রেজিম চেঞ্জের পরে সে দেশে দশ-বারো বছর ধরে সামাজিক অস্থিরতা থাকে। দুর্ভিক্ষ, হানাহানি, খুন-খারাবি এগুলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, উমাইয়াদের পতন আব্বাসীয়দের হাতে হয়েছে। উমাইয়াদের জালিম শাসক আব্বাসীয়দের কোনো সামাজিক মর্যাদা রাখেনি। তাদের কচুকাটা করেছে। যখন তাদের পতন হয়েছে তখন উমাইয়াদের শাসক যারা আরো অনেক বছর আগে মারা গেছে, কবর থেকে তাদের হাড্ডি তুলে পোড়ানো হয়েছে। আমি ভেবেছি আওয়ামী লীগের পতনের পরে বাংলাদেশে এ রকম কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু আল্লাহর রহমত যে এটা হয়নি। কারণ বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক বন্ধন প্রবল। যেটি আরব বা অন্য জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে তেমন নেই। 

সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের হত্যার প্রতিশোধ নেয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগ ঠিকই আমাদের ২০০০ শিশু, যুবকদের হত্যা করেছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কোনো রাজনৈতিক দল না। ভারতের যে আরএসএস, যারা অখ- ভারতে বিশ্বাসী, যারা বাংলাদেশ-পাকিস্তান-নেপাল-ভুটান কারো সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে না। এমনকি মালয়েশিয়ার স্বাধীনতাও স্বীকার করে না। তারা মনে করে, আরব সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি পর্যন্ত অভিন্ন ভারত। তারা মনে করে, এটি তাদের দেবির দেহ। সেই দেহে আমরা মানচিত্র ঢুকিয়ে ছুরিকাঘাত করেছি। এই আরএসএসের ভারত শাখা হলো বিজেপি। আর বাংলাদেশে তাদের শাখা বা প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হলো আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা যুবলীগ। এ ছাড়া তাদের কিছু হিন্দু সংগঠন ও বাম সংগঠন আছে। তাদের আদর্শটা হলো চাণক্যনীতির মতো। চাণক্যনীতি অনুযায়ী, তোমার প্রতিবেশী সুখে থাকলে তোমার জন্য বিপদ আছে। সে জন্য প্রতিপক্ষের ঘরে সব সময় আগুন দিয়ে রাখতে হবে। নানাভাবে তাকে ব্যস্ত রাখো। তাকে কখনো রাজনৈতিক মর্যাদা দিবা না, বড়জোর কালচারাল আইডেন্টিটি দিবা। এই চাণক্যের পররাষ্ট্রনীতিতে তারা এখনো চলে। এই চাণক্যনীতি এবং হিন্দুত্ববাদ মিলিয়েই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা। আমরা যারা গণতন্ত্র-স্বাধীনতার পক্ষে আর হিন্দুত্ববাদ ও অখণ্ড ভারতের বিপক্ষে, আরএসএসের মতো তাদের শত্রু হিসেবে দেখে আওয়ামী লীগ। আমাদের নিধন করাই এদের কাজ। সে জন্য তারা আমাদের ওপর গণহত্যা চালাতে পেরেছে। তাদের এই ভয়ংকর চিন্তাই তাদের এখানে গণহত্যা চালাতে উৎসাহিত করেছে। তারা এখনো বিশ্বাস করে একদিন তারা ফিরে আসবে আর সবার ওপর প্রতিশোধ নিবে। আওয়ামী লীগের বিচার ছাড়া বাংলাদেশ পুনর্গঠন সম্ভব নয়।

আওয়ামী লীগের ব্যাপারে আমাদের ভণিতা নেই

সরাসরি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে আগে। তারপর আদালতের মাধ্যমে আবার নিষিদ্ধ করতে হবে। এখন অনেকেই বিরোধিতা করবে যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে বিচারিকপ্রক্রিয়া লাগবে। নিষিদ্ধ করা কি একটি বিচার না? আওয়ামী লীগ গণহত্যা করেনি, এটা তো তদন্তের বিষয় না। এটা ওপেন সিক্রেট, তারা গণহত্যা করেছে। এটির প্রাথমিক প্রুফ তো আপনার চোখে আছে। আপনি আগে নিষিদ্ধ করেন। পরে গণহত্যার যে আরো ডকুমেন্ট হবে তা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে আবার নিষিদ্ধ করেন। এখন ভণিতার প্রয়োজন নেই। যে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে, পালিয়ে গেছে তার নিবন্ধনের প্রশ্ন আসবে কোথা থেকে। নিবন্ধন কার সঙ্গে হবে? যে মাঠে আছে তার সঙ্গে তো। সে তো মাঠ থেকে গণহত্যা করে পালিয়েছে। এমনকি সে তার সক্ষমতার মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। রাজনৈতিক মাঠে আওয়ামী লীগ কি সমঝোতা করেছে? সে পতনের এক ঘণ্টা আগেও রাজনৈতিক সমঝোতায় আসেনি। 

তার গণহত্যার বিচারটা আগে করতে হবে।  যতই সংস্কারের কথা বলি না কেন, সবচেয়ে বড় সংস্কার হচ্ছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার চেয়ে বড় সংস্কার আপাতত নেই। আপনি যেভাবেই বিশ্লেষণ করেন সবচেয়ে বড় সংস্কার হচ্ছে সন্ত্রাসী সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণে আনা। নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তাকে আগে নিষিদ্ধ করতে হবে।  আইন দ্বারা তাকে পাকড়াও করতে হবে। এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগকে যদি নিষিদ্ধ করি তাহলে আওয়ামী লীগের জনগণ কী করবে? আমার কথা হচ্ছে, জার্মান সোসাইটিতে হিটলারের দল নিষিদ্ধ করার পরে সে দলের লোকজনকে কি সে দেশ থেকে বের করে দিছে, রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে তাদের?  হয়নি। 

আমার কথা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগকে আগে নিষিদ্ধ করতে হবে। গণহত্যার বিচার করতে হবে। বিচারের মধ্য দিয়ে আবার নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আছে সে সবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

৩৩৪ বিলিয়ন সম্পদ কীভাবে আনা যায়? 

দেশের বাইরে যে টাকা পাচার করেছে, সেগুলো বাংলাদেশ থেকে তারা অবৈধভাবে নিয়েছে। ওই দেশের চ্যানেলে আবার বৈধভাবে ঢুকিয়েছে। এই সম্পদ আনার জন্য তাই সেসব দেশের সরকারকে জানাতে হবে। 

বিদ্যুৎ সেক্টর থেকে তারা অনেক বেশি পরিমাণে টাকা  লুট করেছে। মানুষের জমানো ব্যাংকের টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। মোটা দাগে ব্যাংক সেক্টর আর বিদ্যুৎ সেক্টর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আপনি বিদ্যুৎ কত টাকা দিয়ে কিনবেন বা কিনবেন না, সেটি বলার অধিকারও তারা রাখেনি। তাদের দামেই আপনাকে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। না কিনলে বাড়িতে যে খাম্বা বা মিটার লাগানো হয়েছে তার চার্জ দিতে হবে। 

এতসব টাকা লুট হয়েছে এগুলো দেশের মানুষের টাকা। এ টাকা ফিরিয়ে আনতে প্রতিটি দেশের সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান সরকারের যোগাযোগ করতে হবে। বলতে হবে তোমাদের দেশে এই টাকা বৈধ পথে ঢুকেছে, কিন্তু টাকাগুলো অবৈধ। তোমাদের আইন দিয়েই এটি তুমি সমাধান করো। এগুলোর জন্য প্রয়োজনে আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। 

মজার বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের টাকা যে দেশেই পাচার হোক, প্রায় সব টাকা খরচ হচ্ছে কিন্তু ভারতে। যেসব নেতা লন্ডনে পালিয়েছেন তারাও কিন্তু কলকাতায় আসেন। ফলে একদিক থেকে বাংলাদেশের টাকাটা ভারতেই গেছে। 

ভারতে তাদের যাতায়াত আছে। আওয়ামী লীগের যেসব সন্ত্রাসী দেশ থেকে পালিয়েছে তারা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য সংখ্যালঘু তামিলদের ভারত প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে ভারত সে রকম কোনো প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কি না। 

এখন বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগকে দমনের কোনো আইন নেই। অথচ আমরা বলেছি, আমাদের এই জুলাই ছিল বিপ্লব- কিছু পলিটিক্যাল পার্টি আর ইন্ডিয়ার এজেন্টরা এটিকে সংবিধানের ভেতরে ঢুকিয়ে অভ্যুত্থান বানিয়েছে। আর এখনো বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান। এগুলোর জন্য আমাদের দেখানো হচ্ছে আইন। আইন দেখে কি আমরা সরকার পতন করেছি? যখন আমাদের ধরে ধরে গুলি করা হচ্ছে তখন এই কোর্ট-কাচারি বা আইন মন্ত্রণালয় কি আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে? আমাদের তাহলে কেন এখন এই আইন মন্ত্রণালয়ের কথা শুনতে হবে?

লেখক: জয়নাল আবেদীন শিশির, যুগ্ম সদস্যসচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫