Logo
×

Follow Us

সাক্ষাৎকার

শিক্ষা তো বিনোদন নয়, জরুরি কাজ: ড. মনজুর আহমেদ

Icon

তানিয়া আক্তার

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১০:১১

শিক্ষা তো বিনোদন নয়, জরুরি কাজ: ড. মনজুর আহমেদ

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ।

ড. মনজুর আহমেদ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। গবেষণা ও শিক্ষায় তার অবদান দেশের শিক্ষানীতি এবং পরিকল্পনায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন করছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং লাইফ লং লার্নিংয়ের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় গুণমান ও সমতা অর্জনে তার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

তিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইউনিসেফের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এই সময় নিউইয়র্কে সিনিয়র এডুকেশন অ্যাডভাইজার; চীন, ইথিওপিয়া ও জাপানের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। এ ছাড়া তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিকাটের এসেক্সে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টে সিনিয়র রিসার্চারের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশকাল নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশকাল নিউজের রিপোর্টার তানিয়া আক্তার।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আনন্দ নেই- প্রায়ই এমন অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

শিক্ষা নিয়ে এই ধারণা স্পষ্ট করা দরকার। সাধারণত বলা হয়ে থাকে শিক্ষাটা আনন্দের ব্যাপার আর পরীক্ষা হলো উৎসব। শিক্ষা যন্ত্রণাময় বা বিরক্তিকর না হয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দময় অভিজ্ঞতা হতে হবে এটা ঠিক। কিন্তু শিক্ষা তো বিনোদন নয়, জরুরি কাজ। এদিকে পরীক্ষা নিশ্চিতভাবেই কোনো উৎসব নয়। শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার প্রস্তুতি নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ও ভাবনার মধ্যে থাকবে। এ জন্য বছরব্যাপী নিজেদের পড়াশোনায় নিয়োজিত রাখবে- এরপর পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কৃতকার্য হলে তার ভেতরে আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। এভাবে একটি আনন্দময় যাত্রায় পরীক্ষা শেষে সফলতা অর্জনের মাধ্যমে যে আনন্দ পাবে সেটি আসল আনন্দ। সুতরাং একটি কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করার যে আনন্দ সেই চর্চায় শিক্ষকের সহায়তা প্রয়োজন। শিক্ষককে উদ্যোগী হয়ে সেই আনন্দময় পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক রাখার পরও সামর্থ্যবানরা সন্তানদের সেখানে ভর্তি করান না। এ থেকে উত্তরণ কীভাবে সম্ভব?

এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাটা অবৈতনিক। তবে একেবারেই নিখরচাও নয় অভিভাবকদের জন্য। নানা রকম পরীক্ষা, অনুষ্ঠান ইত্যাদির ফি নেওয়া হয়। এ ছাড়া এখন প্রাথমিকেও প্রাইভেট- কোচিংয়ের সুবিধা নেওয়া হয়।

দ্বিতীয়ত, একটা ধারণা রয়েছে যে সরকারি প্রাথমিকে লেখাপড়া ঠিকমতো হয় না। এই ধারণা একেবারেই অমূলক নয়। তাই কোচিং বা টিউশন না দিলে ভালো পড়ালেখা হবে না- এই ভাবনা তৈরি হয়। ফলে সামর্থ্যবানরা প্রাইভেট স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনে তাদের সন্তানদের পাঠায় মূলত পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতেই। সাধারণ মানুষও মানসম্মত শিক্ষা হিসেবে সেই প্রতিষ্ঠান মেনে নিয়েছে। তবে যদি সরকারি প্রাথমিকেই মানসম্মত শিক্ষাটা দিতে পারত তাহলে অনেকেই ফিরে আসত। কিন্তু সরকারি মানসম্মত সেবা পাবার যে অধিকার, তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এ ছাড়া অবৈতনিক বলা হলেও দেশের জনগণ তো ট্যাক্স দিচ্ছে। কিন্তু জনসাধারণ এই অধিকারের জায়গাটি বুঝতে পারছে না। ফলে সরকারি প্রাথমিকে পড়াশোনার মান বাড়ছে না। সরকারি সেবাদাতারা যেহেতু এই সুবিধা দিচ্ছে না, তাই এ থেকে উত্তরণের জন্য কিছু ফি দিয়ে মান বাড়ানোর উদ্যোগ জনগণ নিতে পারে। যদিও এটি আদর্শ ব্যবস্থা না, তবুও অন্তর্বর্তীকালীন ট্রানজিশানের উপায় হিসেবে চেষ্টা করা যেতে পারে।

প্রাইভেট-কোচিং সুবিধা নেওয়ায় কি শিক্ষায় শ্রেণিবৈষম্য বাড়ছে? 

সামর্থ্যবানের সন্তানরা তিনটি টিউশন নিচ্ছে। কেউ হয়তো একজন টিউটরকেই রাখতে পেরেছে। ফলে বৈষম্য তৈরির পাশাপাশি অর্থ ও সময় খরচ হচ্ছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর লাভও হচ্ছে না। তবে প্রাইভেট-কোচিং মূল সমস্যা নয়। এটি মূল সমস্যার লক্ষণমাত্র। মূল সমস্যাটি হলো শ্রেণিকক্ষেই ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উদ্যোগী হয়ে শ্রেণিবৈষম্য দূর করতে পারে কি?

যেহেতু সব শিক্ষার্থীর মেধা এক রকম নয়, যারা পড়ায় পিছিয়ে আছে তাদের সাহায্য প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে একটি নিরাময়যোগ্য পাঠদান পদ্ধতি প্রয়োজন। যেখানে শ্রেণিকক্ষের বাইরে তাদের পাঠদান করতে হবে। এটি যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করে তাহলে ভালো। মানে ভালো দেশি-বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এমন ব্যবস্থা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সরকারি প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। এই পাঠদানে শিক্ষকের সঙ্গে কিছু স্থানীয় সহযোগী (বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পড়া) থাকে তাহলে ভালো হয়। সেই খরচ মেটাতে সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকদের কাছ থেকে ফি নেওয়া যেতে পারে। অভিভাবকদের তো অর্থ খরচ হচ্ছেই, যা তাদের সন্তানেরা উপকার পাচ্ছে না। তারা বরং এখানে বিনিয়োগ করতে পারে। তাহলে বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি অর্থেরও কার্যকর বিনিয়োগ হবে।

প্রাইভেট-কোচিংয়েই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারে শিক্ষার্থীরা। তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কেন প্রয়োজন?

সামাজিক দক্ষতা, চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করার দক্ষতা, নৈতিকতা ছাড়াও জ্ঞান দক্ষতা, ভাষা দক্ষতা অর্জন করতে হয়। এ ছাড়া একে অন্যের সঙ্গে মিশে কোনো বিষয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষমতা তৈরি হয়। ফলে দ্বিমত গ্রহণ করার অভ্যাসও তৈরি হয়। এগুলো স্কুলেই শেখা যায়। কারণ এগুলো কোচিং সেন্টারের মুখস্থ বিদ্যায় সম্ভব নয়।

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেই প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হচ্ছে কি?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাসহ বেশির ভাগ বিষয় শিক্ষার্থীরা শিখতে পারছে না। এমনকি এর প্রয়োজনটাও বুঝতে পারছে না। কারিকুলামে এসব বিষয়ে কিছুটা বর্ণিত আছে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন বা চর্চাটা যথেষ্ট হচ্ছে না। তবে এই পরিবেশ তৈরির জন্য শিক্ষকদেরও যথেষ্ট প্রস্তুতি দরকার। সে ক্ষেত্রে শিক্ষককে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মনে হয় এখনো যথার্থ প্রশিক্ষণ হচ্ছে না, তাই এটা খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ সামগ্রিকভাবে কী শিক্ষা দিচ্ছি তা থেকে পড়তে ও লিখতে পারার পাশাপাশি বিশ্লেষণী ভাবনা প্রকাশের দক্ষতা তৈরি হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। এই চর্চা আমাদের নেই। এখনো কিছু প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা ছাড়াও জীবনব্যাপী দক্ষতা অর্জনের দিকে মনোযোগী হতে হবে। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার ধরন পরিবর্তনে গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়নে জোর দিতে হবে এবং শিক্ষককে প্রস্তুত করতে হবে। এ জন্য প্রথমেই শিক্ষার্থীর জীবনে এই বিষয়গুলো যে প্রয়োজন তা স্বীকার করতে হবে। পরে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নে যেতে হবে। মূলকথা হলো, গোড়া থেকে ধীরে ধীরে এগোতে হবে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের ভারসাম্যহীনতা শিক্ষার গুণগত মানকে যেহেতু প্রভাবিত করে, সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?

সরকারিভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ একজন শিক্ষকের অনুপাতে ৩০ শিক্ষার্থী থাকবে। কিন্তু আমাদের স্কুলগুলোতে অনেক জায়গায় দেখা যায় একজন শিক্ষকের বিপরীতে ১০০ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, প্রশিক্ষণ, ছুটি এসব তো আছেই। ফলে একদিকে শিক্ষকদের ঘাটতি থাকে, অন্যদিকে শিক্ষার্থী সংখ্যাও বেশি। কিন্তু ভালো লেখাপড়ার জন্য ৩০-এর বেশি শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে থাকা উচিত নয়। এ জন্য অবশ্যই অবকাঠামোর বদল করতে হবে। শ্রেণিকক্ষের পরিমাণ ও শিক্ষক নিয়োগ বাড়াতে হবে। প্রাথমিকের চেয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সমস্যাটা বেশি। মাধ্যমিকের পাঠদান ভিন্ন, তাদের শিক্ষকদের প্রস্তুতিও ভিন্ন। সে ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষগুলো হয়তো আরও ছোট করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত যদি ঠিক থাকে তাহলে সময়টা যথাযথ কাজে লাগানো যাবে। তা না হলে শ্রেণি-পাঠদান নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাবে না। বরং উপস্থিতি নিতেই অনেকটা সময় চলে যাবে। কারণ বিষয়ভিত্তিক পাঠদান করতে হয় শিক্ষার্থীর অবস্থান দেখে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীর প্রশ্নের সুযোগ দেওয়াসহ নানা ধরনের দলগত কাজ দিতে হয়। ফলে সুষ্ঠুভাবে এসব করার জন্য সময় সংকুলান হয় না। সে জন্য অনুপাত ঠিক রাখা জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষার্থী কতটুকু শিখবে সেই তত্ত্বাবধান করতে হবে। কীভাবে আয়োজন করলে তা ফলপ্রসূ হয় তা দেখতে হবে। তারপর শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় বদলানোর দরকার রয়েছে কি না সে বিষয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু সেই চিন্তা কোথায়?

শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো কতটা প্রয়োজন?

শিক্ষা খাতে অগ্রাধিকার দিয়ে বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে সরকারকে। এখন পর্যন্ত আমরা যে অবস্থায় আছি, সেটি অনেক গরিব দেশের তুলনায়ও কম বিনিয়োগ করছি। তবে বিনিয়োগ শুধু বাড়ালেই হবে না, সেটি যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। সে জন্য শিক্ষকদের তৈরি করতে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৮০ ভাগ প্রণোদনা দিতে হবে। প্রথমে ব্যয় বাড়ালে হয়তো কিছু অপচয় হবে, তা মেনে নিতে হবে। তাই একটি লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষায় ধীরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫