বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় দরকার নেই: ইউনুছ আলী আকন্দ

কামরুল ইসলাম ফকির
প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:৩৯

ইউনুছ আলী আকন্দ। ফাইল ছবি।
সুপ্রিম কোর্টে চার দশক ধরে আইন পেশা পরিচালনা করছেন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট শতাধিক মামলা করে পক্ষে রায় পেয়েছেন ড. মো. ইউনুছ আলী আকন্দ।
আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও বিচার বিভাগের কল্যাণে সব সময় সোচ্চার থেকেছেন এই প্রবীণ আইনজীবী।
মিছিল-মিটিংয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পিপার স্প্রে বন্ধ, সাইনবোর্ড-বিলবোর্ড ও গাড়িতে বাংলা ভাষার ব্যবহার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে এমপি-মন্ত্রীদের সভাপতি হওয়ার পথ বন্ধসহ অসংখ্য জনগুরুত্বপূর্ণ মামলা রয়েছে তার।
বিচার বিভাগের সংস্কার, রাজনীতি ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে তার ভাবনা জেনেছে সাম্প্রতিক দেশকাল।
অন্তর্বর্তী সরকারের করা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অন্যতম একটি সুপারিশ ছিল বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপন। ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে এই সচিবালয় কতটা জরুরি?
আমার মতে, বর্তমানে এটা যেভাবে আছে, সেভাবেই (বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকা) থাকাটাই ভালো। এখন বিচার বিভাগ 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স' অবস্থায় আছে। এতে বিচার বিভাগে ভারসাম্য বজায় থাকছে। পৃথক সচিবালয় হলে সেই ভারসাম্য নষ্ট হবে বলে আমি মনে করি।
সংস্কার কমিশন সংবিধান সংস্কারসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। এই সরকারের পক্ষে কি সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
সংস্কার কমিশনের কিছু ভালো সুপারিশ আছে। তবে এই সরকারের পক্ষে সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কারণ, এসব সুপারিশের মধ্যে কতগুলো সংবিধান সংশোধন সংশ্লিষ্ট সুপারিশও রয়েছে। আর সংবিধান সংশোধন করতে হলে সংসদ লাগবে। এখন যেহেতু সংসদ নেই, তাই সব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। তবে ভবিষ্যতে সংসদ গঠিত হলে এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হবে; রাজনৈতিক দলগুলো এমন অঙ্গীকার করতে পারে।
সংস্কার কমিশন ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন করতে চায়। এর আগেও ঢাকার বাইরে হাইকোর্ট বেঞ্চ করা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা টিকেনি।
ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের জন্য সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনেছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে।
তবে বর্তমান সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতি দেশের যে কোনো স্থানে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করতে পারেন। আমি মনে করি, সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশ ইতিবাচক। এটি বাস্তবায়িত হলে জনগণ উপকৃত হবে।
তবে আমি চাই, ভারতের মতো প্রদেশ গঠন করে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হোক। তা না হলে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট হতে পারে।
সবচেয়ে ভালো হয়, যদি সরকার প্রত্যেকটি জেলায় একটি করে সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করে। তাহলে আর স্থায়ী হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের প্রয়োজন হবে না।
উপজেলা পর্যায়ে আদালতের সম্প্রসারণের বিষয়েও সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে।
এটিও ভালো উদ্যোগ। এরশাদ সরকার ১৯৮২ সালে সব উপজেলায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন করেছিল, যা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। বর্তমানে ৬৭টি চৌকি আদালত এখনও কার্যকর আছে।
উপজেলা পর্যায়ে আদালত স্থাপন করা হলে জনগণ অল্প সময়ে আদালতে যেতে পারবে এবং খরচও কম হবে। স্বল্প খরচে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি মাইলফলক সিদ্ধান্ত হবে বলে আমি মনে করি।
প্রতি বছর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (বার) নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও এ বছর সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। আপনি নিজেও একাধিকবার বারে সভাপতি পদে নির্বাচন করেছেন। নতুন নির্বাচন হচ্ছে না কেন?
সুপ্রিম কোর্ট বারে আমি ১৩ বার সভাপতি পদে নির্বাচন করেছি। বর্তমানে এখানে বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা দায়িত্বে আছেন। নির্বাচন না হওয়ার জন্য এককভাবে তারাই দায়ী। এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তারা নির্বাচন আয়োজনের কোনো উদ্যোগই নিচ্ছে না, যা বারের আইনের পরিপন্থী। আমি অনুরোধ করব, অবিলম্বে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক, যাতে সুপ্রিম কোর্ট বারে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ফিরে আসে।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলি। আপনি এর আগে একাধিকবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। আগামী নির্বাচনেও অংশগ্রহণের ইচ্ছা আছে?
নির্বাচন হবে কি না, সে ব্যাপারে আমি এখনও সন্দিহান। নির্বাচন হলেও তা আওয়ামী লীগ মার্কা নির্বাচন হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে আমার মনে হয় না। এ কারণে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমি আগ্রহ পাচ্ছি না।
চার দশকের আইন পেশা চর্চা, রাজনীতি - এর বাইরে অন্য কিছু করার সুযোগ হয়?
না, অন্য কিছু করার একদম সময় পাই না। আইনজীবী হিসেবে সারাক্ষণ মানুষের সেবা করার বিষয়টিই মাথায় কাজ করে। আইনি সেবা দিয়ে মানুষের কল্যাণ ও মানবাধিকার রক্ষা করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সে কারণে যতটুক সম্ভব, আমি আমার পেশা ও শ্রম দিয়ে জনগণকে সহায়তা করার চেষ্টা করি।
আপনি তো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলা করে আলোচনায় এসেছেন। এই মামলাগুলোর খরচ কে দেয়?
জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলা নিজের টাকা খরচ করে করি। এতে মানুষের উপকার হওয়ায় আমি তৃপ্তি পাই। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এসব কাজ করি, যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই।