আইনের শাসনের মূল প্রতিবন্ধকতা হলো সুশাসনের অভাব

আহমেদ সেলিম
প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২১, ১১:৫৩

রুহুল কুদ্দুস কাজল
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। দেশের বর্তমান বিচার ব্যবস্থা, আইনের শাসন ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আহমেদ সেলিম।
দেশে আইনের শাসন বাস্তবায়নে এ মুহূর্তে কী কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাচ্ছেন?
আইনের শাসনের মূল প্রতিবন্ধকতা হলো বাংলাদেশে সুশাসনের অভাব। দেশে কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকার কারণে আইনের শাসন, মানবাধিকার, মূল্যবোধ কোনোটাই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একটা প্রতিশ্রুতি দরকার। দেশে নিয়মিত নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ এবং জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত এই অনিয়মগুলো রাষ্ট্রে বিরাজমান থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে না।
মামলাজটের কারণে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। এটা নিরসনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি?
মামলাজট নিরসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমি এ মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি না। উল্টো প্রতিনিয়ত মামলাজট বাড়ছে। অনেকে বলে থাকেন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ করলে মামলাজট কমে যাবে; কিন্তু আমি তা মনে করি না। এর মূল সমাধান হলো আঁতুড়ঘরে মামলা শেষ করতে হবে। বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলার ৯০ শতাংশ রাজনৈতিক কারণে হয়ে থাকে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য সামান্য কোনো ঘটনা ঘটলেই শত শত মানুষকে মামলা দেওয়া হয়। অথচ দোষী ১-২ জন ব্যক্তি। এই যে অসংখ্য মানুষকে মামলা দেওয়া হয়, এর কারণেই কিন্তু মামলাজট বাড়ে। এই মিথ্যা বানোয়াট মামলা বন্ধ করতে হবে। কোনো কারণে যদি কেউ মিথ্যা মামলা দেয়, তাকে সাজার আওতায় আনতে হবে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে ছোট-খাটো মামলা শেষ করতে হবে।
বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে কি?
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র একটা। একক রাষ্ট্র, একক রাজধানী। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ফেডারেল কোর্ট আছে; কিংবা প্রাদেশিক কোর্ট আছে। আমাদের যেহেতু ছোট দেশ, সুতরাং সুপ্রিম কোর্ট একটি। এর কেন্দ্রবিন্দু ঢাকাতেই থাকতে হবে। এরশাদের আমলে হাইকোর্ট বিভাগীয় শহরে করার কারণে আদালতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের দালাল শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। ফলে ন্যায় বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল। জুডিশিয়ারির অপর কেন্দ্রীয়ভাবে যে নিয়ন্ত্রণ, তা ব্যাহত হয়েছে। জুডিশিয়ারিকে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার যে আশ্রয়স্থল বলা হয়, তা ব্যাহত হয়েছে। তাই আমি মনে করি, হাইকোর্টকে বিভাজনের কোনো প্রয়োজন নেই। বরং সুপ্রিম কোর্টে যোগ্যতম, দক্ষতাসম্পন্ন, সৎ ব্যক্তিকে বিচারপতি নিয়োগদানের মধ্যমে সুবিচার নিশ্চিত এবং এই আইন অঙ্গনকে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো যোগ্য করে তোলা উচিত।
নিম্ন আদালতের বিচারকদের আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেখে স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা কতটুকু সম্ভব?
এটা একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা। কাগজ-কলমে আমরা বিচার বিভাগকে স্বাধীন বললেও, প্রকৃতপক্ষে নিম্ন আদালতের বিচারকরা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তাদের নিয়োগ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে হলেও বদলি, পদোন্নতি এসব বিষয় মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকার কারণে সুপ্রিম কোর্ট এবং বিচার বিভাগ যদি স্বাধীন হয়, তাহলে পুরো বিচার ব্যবস্থাকে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আনতে হলে সুপ্রিম কোর্টকে সেভাবে শক্তিশালী করতে হবে।
সারাদেশে বিভিন্ন বিষয়ে কিছু আলোচিত মামলা বছরের পর বছর শুনানির অপেক্ষায় থাকে। বিচার শেষ হয় না। কারণ কী?
আমাদের লম্বা সময় ধরে বিচার প্রক্রিয়ার কারণে মামলাগুলো দ্রুত শেষ হয় না। এ জন্য দক্ষ, যোগ্য বিচারক, বিচারপতি ও আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। ন্যায় বিচার কিন্তু বাদী-বিবাদী দু’জনকেই পেতে হবে।
দেশে আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে পর্যবেক্ষকমহলের অভিমত। আপনি কী মনে করেন?
আমিও তাই মনে করি। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে অধঃপতন হয়েছে, তার হাওয়া সুপ্রিম কোর্টেও লেগেছে। আমাদের দেশে সবই চলছে অস্থায়ীভিত্তিতে। ক্ষমতাসীনরা যে যখন ক্ষমতায় যান, তাদের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য যখন যেভাবে প্রয়োজন অস্থায়ীভিত্তিতে স্বল্প মেয়াদি আইন করে থাকেন; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটি সচল রাষ্ট্রের অন্যতম কাজ হচ্ছে এমনই একটা সমতল ভূমি তৈরি করা, যেখানে সব কিছু নিয়ম এবং আইন মাফিক হবে। মূল কথা হলো দেশে সুসাশন স্থাপন করতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন।
উচ্চ আলাদতের বিচারপতি নিয়োগপ্রক্রিয়া যথাযথভাবে হচ্ছে বলে আপনি কি মনে করেন?
উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ করতে হলে সংবিধানে তিনটি কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- নিম্ন আদালতের বিচারক হিসেবে ১০ বছরের যোগ্যতা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা এবং আইন দ্বারা অন্যান্য যেসব যোগ্যতা নির্ধারণ করা হবে; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আইন দ্বারা কোনো কিছুই হচ্ছে না। বরং আমরা দেখছি, আজ থেকে ১০ বছর আগে রাজনৈতিক কর্মীদের বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলেও, দক্ষতা এবং যোগ্যতাসম্পন্ন লোককে নিয়োগ দেওয়া হতো; কিন্তু সম্প্রতি উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগে একমাত্র যোগ্যতা আমরা দেখেছি রাজনৈতিক আনুগত্য।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এটা কতটা সংবিধানসম্মত?
সার্চ কমিটি বলতে কোনো কিছু সংবিধানে নেই। সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কীভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, সেই আইন আমরা করতে পারিনি। দেখেন বাংলাদেশকে আমরা গণতান্ত্রিক দেখতে চাই না অগণতান্ত্রিক দেখতে চাই, আমরা কী সুশাসন চাই না দুঃশাসন চাই- এটাতো নির্ধারণ করবে রাজনৈতিক দলগুলো। সার্চ কমিটি বলেন আর যা বলেন, এগুলো দিয়ে কখনো সমস্যার সমাধান হবে না। মূল সমাধান হচ্ছে সদিচ্ছা। আপনি কি চান বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তন করুক। যদি তাই চান তাহলে সদিচ্ছাই যথেষ্ট। ভোটের বর্তমান আস্থাহীনতা কাটিয়ে ওঠার জন্য অনতিবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হবে। যাতে মানুষ নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাতে পারেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। আইনটি বাতিল বা সংশোধন করা দরকার মনে করেন কী?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক কর্মী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং ভিন্নমতের মানুষদের হয়রানি করা হচ্ছে; কিন্তু আইনের উদ্দেশ্য তো তা হওয়ার কথা নয়। কোনো আইন যদি তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য হয়, তাহলে সেই আইন কখনো সফল হবে না। একদিকে আপনি ডিজিটাল উন্নতির কথা বলবেন, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন করা-তা কিন্তু স্ববিরোধী। সুতরাং আইনকে ব্যবহারের জন্য সৎ ইচ্ছা বজায় রাখতে হবে।
দেশে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কী কারণ বলে মনে করেন?
আমরা মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ দেশ হলেও আমাদের দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সম্প্রতি দুর্গাপূজার সময় বিভিন্ন মন্দির, হিন্দুদের ওপর এবং তাদের বাড়ি-ঘরে আক্রমণ করা হয়েছে। এটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। ক্ষমতাসীন সরকারের দায়িত্ব হলো দেশের সব মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়া। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। পাশাপাশি আগামীতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে জন্য মানুষকে সচেতন করা, নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।