
আবদুল মান্নান
অধ্যাপক আবদুল মান্নান। ১৯৯৯-২০০১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ২০১৫-২০১৯ সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ১২তম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ উপাচার্য ছিলেন। শিক্ষার সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন সাম্প্রতিক দেশকালের। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সেলিম আহমেদ।
সাম্প্রতিককালে শিক্ষক নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না কেন?
আমাদের শিক্ষা হয়ে গেছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক, গ্রেডকেন্দ্রিক। বাংলাদেশের মতো পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় সামাজিক, মানবিক মূল্যবোধের বড়ই অভাব। প্রথমত, পরিবার হচ্ছে আমাদের প্রথম স্কুল, সেই স্কুলটা বেশিরভাগ জায়গায় ভেঙে গেছে। পরিবার এখন কোনো সন্তানকে তেমন একটা সময় দিতে পারে না। এটা ভোগবাদী সমাজের বড় সংকট। দ্বিতীয়ত, এখন শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের যে মার্যাদা দেওয়ার কথা তা দেয় না। কারণ শিক্ষকদের যে মর্যাদা দিতে হবে তা পরিবার থেকেও বলে না, শিক্ষকরাও শেখান না। শুধু শিক্ষক কেন ছেলে বাবা-মাকে, বড় ভাই-বোন কিংবা ছোটরা বড়দের পেটাচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি অনেকের। আপনি কী বলবেন?
আমাদের ছোটবেলায় নৈতিক শিক্ষা বলতে একটা বিভাগই ছিল। আমরা এটাকে মডেল স্টাডিজ বলতাম। ক্লাস ৫ পর্যন্ত এটা ছিল। এখন আর এটা নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন মানুষ নয় রোবট তৈরি করছে। এটা কারো ব্যক্তিগত দোষ নয়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দোষ।
প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
শিক্ষা আইন আমি পুরোটা দেখিনি। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আইনটি নিয়ে প্রকাশিত খবরগুলো পড়েছি। আসলে আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই। কিন্তু একটা আইন বাস্তবায়নের জন্য যে ধরনের মনিটরিং দরকার তা নেই। আইন মনিটরিংয়ের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তা কোনো কাজে আসবে না। আইনটি হবে শুধু একটি কাগজ।
মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন শিক্ষকতায় আসছে না?
একটা সময় প্রবাদ ছিল ‘যার নেই কোনো গতি, সে করে ওকালতি’। আর এখন ‘যার নেই কোনো গতি সে করে শিক্ষকতা’। এখন যার গতি আছে সে প্রশাসনের ক্যাডার হয়ে ছড়ি ঘুরাচ্ছে। এখন কোনো মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসতে চায় না। আর মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসতে যদি উদ্বুদ্ধ করা না যায় তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হবে না।
প্রক্সি সংস্কৃতি বন্ধ হচ্ছে না কেন?
এটা কোনো বিচ্ছিন্ন জিনিস নয়। সমাজে দুর্নীতি, টাকা পাচার, পেশিশক্তির উত্থান- সব মিলিয়ে সমাজ তো ঘুণে ধরেছে বহু আগে। এটা এখন বিস্তার করছে। মানুষ যত দিন তার নিজে নিজেকে না শুধরাবে তত দিন এসব বন্ধ হবে না। আগে মানুষের মূল্যবোধ জাগ্রত হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণায় আগ্রহ কম কেন?
আমাদের দেশে গবেষণা কালচার এখনো গড়ে ওঠেনি। কিছু গবেষণা যে হচ্ছে না তা বলা যাবে না, তবে সংখ্যায় খুব কম। আর গবেষণা শুধুই বললে হবে। এর পরিবেশ থাকতে হবে, ফান্ডিং থাকতে হবে, যারা গবেষণা করেন তাদের মোটিভেট করতে হবে। যারা গবেষণা কাজে জড়িত তাদের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। প্রশাসনিক দায়িত্ব দিলে কেরানিগিরি করতে করতে গবেষণা করার আর সময় পাবে না। এ ছাড়াও আমরা শিক্ষার্থীদের বিদেশি বিষয় এনে পড়াই। অথচ আমাদের দেশের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতা পড়ানোর কথা ছিল। আমার দেশের ইকোনমি আর আমেরিকার ইকোনমি তো এক নয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিচিংনির্ভর। শিক্ষকদের নিয়মিত ক্লাস নিতে হয়। যার ফলে অনেক শিক্ষকের গবেষণা করার মতো সময় থাকে না। আমি ইউজিসির চেয়ারম্যান থাকাকালে প্ল্যান করেছিলাম একটা বিশ্ববিদ্যালয় করা হবে শুধু গবেষণার জন্য। সেখানে বলা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএচডি ডিগ্রি দেওয়া হবে আর গবেষণা হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয় হলেই গবেষণা খাত অনেক সমৃদ্ধ হবে। গবেষণার জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে।
উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে ইউজিসির অবদান কতটুকু?
আমাদের মঞ্জুরি কমিশন হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল কমিশন। আইন যতটুকু আছে কমিশনের ক্ষমতা ততটুকু। শিক্ষায় মান উন্নয়ন হয়নি তা বলা যাবে না। তবে যতটুকু হওয়ার কথা ছিল তার থেকে আমরা অনেক দূরে আছি। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে কয়েকটি হলো- আমরা মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে পারিনি, সিলেবাসে আপডেট নেই, গবেষণায় বরাদ্দ নেই।
১৯৭২ সালের ইউজিসি যখন গঠন করা হয়েছিল তখন সেখানে তার করণীয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ইউজিসি কিন্তু একটা আইনের বলে প্রতিষ্ঠিত। এটা কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসূত্র আছে। ইউজিসির প্রতিষ্ঠকালে ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এর মধ্যে ৪টি বিশেষায়িত আর ২টি সাধারণ। ৪টি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশের বলে সার্বভৌমত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো ইউজিসি একাডেমিক কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। তবে পরামর্শ দিতে পারবে। ১৯৭৩ থেকে ২০২২। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অর্ধশতাধিক আর প্রাইভেট শতাধিক। কিন্তু মঞ্জুরি কমিশনের আইনে কোনো সদস্যপদ ৩ থেকে ৫ ছাড়া কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমি চেয়ারম্যান থাকাকালে প্রধানমন্ত্রীর খুব সদিচ্ছা ছিল আইনের পরিবর্তন করা। কিন্তু নানা কারণে তা হয়নি।
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আপনার মন্তব্য
বিষয়টি পুরোপুরি আমার দেখা নেই। আর এগুলো বেশিরভাগ করে আমলারা। এক্ষেত্রে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। আমলাতন্ত্রের রাহুমুক্ত করতে না পারলে শিক্ষা ব্যবস্থায় আর কোনো উন্নতি হবে না।। আসলে পাকিস্তানের এখন যে দুর্দশা হয়েছে তা একদিনে হয়নি। ৮৭ পরবর্তীকালে সামরিক-বেসামরিক আমলারা মিলে পাকিস্তানের বারোটা বাজিয়েছে। তবে দেশের জন্য আমলা থাকবে, আমলাতন্ত্র নয়। আমলাতন্ত্র একটি ক্ষতিকারক মারাত্মক ব্যাধি। সবকিছু আমলারা জানে বাকিরা কিছু জানে না এই চিন্তা-চেতনা থেকে আমাদের বের হতে হবে। এই যে শিক্ষা নিয়ে এত কাণ্ডকীর্তি হয়, কয়জন শিক্ষাবিদ সেখানে সম্পৃক্ত থাকেন। মূলত যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে করতে হবে।