অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৫০ পিএম
আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৫১ পিএম
প্রকাশ: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৫০ পিএম
অনলাইন ডেস্ক
আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৫১ পিএম
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হয়েছেন ড. আহসান এইচ মনসুর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশের ত্রয়োদশ গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে ড. আহসান এইচ মনসুর পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাতের বিভিন্ন দিক এবং সংস্কার নিয়ে একটি গণমাধ্যমে কথা বলেন তিনি। ড. আহসান এইচ মনসুরের এ সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে দেয়া হল।
প্রশ্ন: নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এই মুহূর্তে তাদের কোন দিকগুলোতে নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর: বাংলাদেশে খুব দ্রুত একটি বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। এত দ্রুত সবকিছু ঘটে যাবে, সেটা কেউ কল্পনাও করেনি। ফলে কোনো কিছুই পরিকল্পিত নয়। আমাদের অর্থনীতিতে যে সমস্যাগুলো চলছে, সেগুলো বহুদিন ধরেই চলে আসছে। বিগত সরকার এ সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করে আসছিল, অনেক সমস্যা ইচ্ছাকৃতভাবেও তৈরি করা হয়েছিল। লুটতরাজ, ঋণখেলাপিসহ অনেক সমস্যাই ইচ্ছাকৃত এবং পরিকল্পিত। ফলে নতুন এ সরকারকে অনেক দিকই সামাল দিতে হবে।
সর্বপ্রথম এ সরকারকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে এবং এর সঙ্গে আর্থিক খাতের দৃশ্যমান বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এখানে আমি অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কথা বলছি না বরং বাহ্যিক বিশৃঙ্খলা যেমন রাস্তাঘাটে গোলাগুলি, একপক্ষ আরেকপক্ষের ওপর হামলা, বাজার নিয়ন্ত্রণ এসব বিষয়ের কথা বলছি। সম্প্রতি একটি ব্যাংকে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। সেটি অপ্রত্যাশিত, তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই এটা হয়ে থাকে। আমি মনে করি, এগুলো খুব দ্রুতই সমাধান করা সম্ভব।
প্রশ্ন: নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক খাতের সংস্কার কীভাবে হতে পারে বলে মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর: অর্থনৈতিক খাতের সমস্যাগুলোকে আমি মূলত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে চাই। প্রথমত, অর্থনৈতিক খাতের রাজনৈতিক সমস্যা। রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমেই এর বিশুদ্ধকরণ প্রয়োজন। পরবর্তী সরকার যেন আরেকটি স্বৈরাচারে পরিণত না হয়, সেজন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণভোটের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এই মুহূর্তে নির্বাচন দিয়ে দিলে এই অন্তর্নিহিত সমস্যার সমাধান হবে না। আজ এক পরিবার রয়েছে, এ পরিবার গেলে কাল আরেক পরিবার আসবে এবং বাংলাদেশ এই পরিবারতন্ত্র থেকে বের হতে পারবে না। এখান থেকে বের হতে গেলে কিছু ফান্ডামেন্টাল পরিবর্তন আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেকটি সার্ভিস সেক্টরকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে নিজ দখলে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ভূমি অফিসে এক হাজার টাকায় যে সেবা পাওয়ার কথা সেখানে চাওয়া হবে ১ লাখ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে ৫-১০ লাখ টাকা। আর এটা তারা করছে কারণ তাদের হাতে ক্ষমতা আছে। এটা ক্ষমতার চরম অপব্যবহার। আমি পাসপোর্ট বা জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করেছি, দেখা যাবে তাতে ভুল রয়েছে। এটা তারা ইচ্ছে করে কি না, আমি জানি না। তবে এই ভুল সংশোধন করতে আমাকে চরম আর্থিক এবং মানসিক হয়রানির শিকার হতে হয়। এভাবে প্রতিটি সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিতে হচ্ছে। দেশে যে সরকারি সেবাগুলো বিনামূল্যে পাওয়া উচিত সেগুলো জনগণকে উচ্চমূল্যে কিনতে হচ্ছে। আর এভাবে চলতে চলতে দেশের জনগণ চরমভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে।
আমি পশ্চিমা দেশগুলোতে পেশাগত কারণে ৩২ বছর বসবাস করেছি। সেখানে কোনো দিন আমাকে কোনো সরকারি সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়নি। ৩২ বছরে কোনো দিন কাউকে বলতে হয়নি, এখানে এই কাজ হবে না। আমি একবার সেখানকার একটি ভূমি অফিসে গিয়েছিলাম। গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে দেখলাম সেখানে লেখা রয়েছে, ১৫ মিনিটের জন্য গাড়ি পার্ক করতে পারবেন। আমি ভাবলাম, আজ আর আমার কাজটি হবে না। আমি শুধু অফিসটা চিনে চলে যাব। কারণ আমার হাতে সময় ১৫ মিনিট। আমি অফিসে ঢুকলাম, আমার ঠিকানা দিয়ে আমি একটি জমির দলিলসংক্রান্ত কাজের কথা বললাম। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম কত সময় লাগবে? তারা আমার কাছ থেকে পাঁচ মিনিট সময় নিল। আমি নির্দিষ্ট জায়গায় ফি জমা দিয়ে আসলাম। এর মধ্যে আমার কাজ হয়ে গেছে। আমি দেখলাম আমার হাতে এখনো ৭-৮ মিনিট সময় রয়ে গেছে।
অথচ আমি যদি বাংলাদেশের কোনো একটি ভূমি অফিসে গেলে কী হতো? বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারি সেবায় যেভাবে দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়ন করা হয়েছে, সেখান থেকে জনগণ মুক্তি চায়। সরকারি সেবা প্রাপ্তির পথ সুগম হলে জনগণ সব থেকে বেশি খুশি হবে। থানায় গেলে ঘুষ দিতে হয়, ঘুষ না দিলে এফআইআর হবে না এটাই আমার ফান্ডামেন্টাল রাইটসকে চ্যালেঞ্জ করছে। সরকার যদি এ জায়গাগুলোতে পরিবর্তন আনতে পারে তাহলে আমি মনে করি এ দেশের মানুষ সারা জীবন এই সরকারকে মনে রাখবে। আমি মনে করি চাইলেই এটা সম্ভব।
প্রশ্ন: সরকারি অফিসগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব কি?
আহসান এইচ মনসুর: অবশ্যই সম্ভব। সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন সেটা তদন্ত করে দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি একাধিক ব্যক্তি একই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এবং অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে তাকে বহিষ্কার করতে হবে। সরকার যদি এমন কঠোর অবস্থান নিতে পারে তাহলে এ দেশটা আমূলে বদলে যাবে।
যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তারাই বিদেশে টাকা পাচার করে। দুর্নীতি বন্ধ করতে পারলে টাকা পাচারও বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের রিজার্ভ সংকট অনেকাংশে কমে আসবে। সামাজিক ভারসাম্য ফিরে আসবে। এখন দেখা যায়, একজন ছোটখাটো কর কর্মকর্তার ঢাকা শহরে পাঁচটি বাড়ি। রাজউকের একজন পিয়নেরও দশটি বাড়ি, ১০০ কোটি টাকার মালিক। কীভাবে তারা এই অর্থ উপার্জন করছে? আমাদের সমাজকে এ জায়গাটা থেকে বের করতে হবে। দুর্নীতি, অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। এ সমাজকে বাঁচাতে হবে।
প্রশ্ন: দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর: দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দুই ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি হলো সামষ্টিক অর্থনীতির সংস্কার, যার মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা, আমদানি সংকট এবং অর্থ পাচারের মতো সমস্যাগুলো। এই মুহূর্তে দেশে প্রচুর লোকের হাতে বস্তা বস্তা টাকা রয়েছে। বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকা নিয়ে তারা আত্মগোপন করে আছে। তারা যে কোনো সুযোগে এ টাকা বিদেশে পাচার করার চেষ্টা করবে। এ পাচার যথাসম্ভব ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বৈদেশিক রিজার্ভের সংকট নিরসন করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তাতে এই মুহূর্তে বড় আকারের আন্তর্জাতিক ঋণ সহায়তা পাওয়া একদমই কঠিন হবে না।
আরেকটি হলো, কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ। দেশের ব্যাংক খাতে যে ধরনের লুটপাট হয়েছে সেটা কাটিয়ে ওঠা আসলেই কঠিন হবে। প্রথমে তদন্ত করতে হবে, কোন ব্যাংকের অবস্থা এই মুহূর্তে কেমন। লুটপাটে কারা সম্পৃক্ত এবং লুটপাটের পরিধি কতটা ভয়াবহ। যেসব বড় বড় গ্রুপ এই লুটপাটে যুক্ত তাদের ধরার জন্য সরকার একটি আলাদা কমিশন গঠন করতে পারে।
দেশের ভেতরে এবং বাইরে লুটপাটকারীদের ধরার জন্য আইনগতভাবে যা যা ব্যবস্থা নেওয়া যায় সবই করতে হবে সরকারকে। তার আগে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ করতে হবে। সব ব্যাংক রাখার দরকার আছে কি না এবং কোনো কোনো ব্যাংককে মার্জ করে দেওয়া সম্ভব কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কিছু কিছু ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তন করতে হবে। দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীর হাত থেকে ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করতে হবে। ব্যাংক ধরে ধরে একটি রোডম্যাপের ভিত্তিতে এ সংস্কারগুলো করতে হবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার দরকার কী? কীভাবে সেটি করা যায়?
আহসান এইচ মনসুর: মাও সে তুংয়ের একটি উক্তি ছিল—মাছের পচন শুরু হয় তার মাথা থেকে। অর্থাৎ মাথাগুলো যদি ঠিক থাকে তাহলে নিচের দিকের পতন রোধ করা অনেকটা সহজ হয়। আর মাথায় যদি পচন ধরে তাহলে তা ঠিক করা কঠিন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সব থেকে বড় সমস্যা ছিল, দেশের মাথাটা ছিল চরম দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো নৈতিকতা বিবর্জিতভাবেই দেশের মাথাকে সাপোর্ট করে গেছে। ব্যাংক লুটপাটগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সুতরাং মাথাগুলোকে যদি ঠিক করা যায় তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে।
আরেকটি জায়গায় বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, সেটি হলো দেশের রাজস্ব খাত। রাজস্ব খাতের অন্তর্গত তিনটি খাতকে সংস্কারের জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করতে হবে। তারা পৃথকভাবে প্রতিটি খাতের সংস্কারের রোডম্যাপ তৈরি করবে। এরপরের কাজ হবে সেই রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করা। সম্পূর্ণ রাজস্ব খাতটি অনলাইনভিত্তিক অটোমেশনের সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। কর কর্মকর্তা এবং করদাতা এ দুই শ্রেণির মধ্যে যেন কোনোভাবে সামনাসামনি দেখা না হয়। এ ব্যবস্থাটি করতে পারলে এখানে ঘুষ বন্ধ হয়ে যাবে। আমেরিকায় এ সিস্টেমটি কঠোরভাবে ফলো করা হয়।
প্রশ্ন: অনেকে বলেন, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর একটি বড় সমস্যা এর পরিচালনা পর্ষদ। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী? এর কি কোনো সমাধান নেই?
আহসান এইচ মনসুর: এখানে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় রয়েছে। তবে সব থেকে বেশি দায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এদের ধরা যাবে না। ব্যাংকিংয়ের মূলনীতি হলো ফিট অ্যান্ড প্রোপার টেস্ট। ফিট অ্যান্ড প্রোপার টেস্টে যারা পাস করবে না তাদের ব্যাংকের মালিক করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের দেশে লুটেরা গ্রুপগুলোকে ব্যাংকের মালিকানা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার ইন্টেনশনালি এটা করেছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরের একটি বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। এটাকে কমিয়ে আনার জন্য কী করা যেতে পারে?
আহসান এইচ মনসুর: শুধু খেলাপি ঋণের আকার নয় বরং প্রকারও দেখতে হবে। কারা ঋণখেলাপি হয়েছে, কোথায় কোথায় হচ্ছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত—প্রত্যেকটি ব্যাংকের লিস্ট তৈরি করে এ তথ্য বের করতে হবে। কতদিনের খেলাপি সেই সময়টা দেখলে এটা বুঝতে পারা একদমই কঠিন নয় যে, খেলাপি ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সৎ ব্যক্তিদের দিয়ে পরিচালিত হয় এবং যদি কোনো রাজনৈতিক চাপ না আসে, তাহলে ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনা মোটেই কঠিন হবে না।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের করণীয় কী?
আহসান এইচ মনসুর: আমরা সবসময় বলে এসেছি, সরকার নয়-ছয় সুদের হার করে আমাদের একটি বেড়াজালের মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং আমাদের মুদ্রানীতি ইন এফেকটিভ হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমরা নয়-ছয় মুদ্রানীতিতে চলছি। আমরা সবসময় বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার কথা বলে এসেছি। কিন্তু সরকারের ওপরমহল থেকে সবসময় ফোন করে বিনিময় হার মেনুপুলেট করা হয়েছে। আমরা সবসময় বলে এসেছি, সরকারের বাজেটের জন্য টাকা ছাপানো যাবে না এবং ব্যাংক রক্ষার নামে ব্যাংকে লিকুইডিটি দেওয়া যাবে না। কিন্তু সরকার কোনোটাই শোনেনি। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংকগুলোকে ব্যাপকভাবে লিকুইডিটি দেওয়া হয়েছে। এই টাকাগুলো বাজারে চলে এসেছে এবং মূল্যস্ফীতিতে এর একটু হলেও প্রভাব রয়েছে। সরকার যদি নীতি গ্রহণ করে যে, কোনো অবস্থাতেই টাকা ছাপানো যাবে না, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমতে বাধ্য।
প্রশ্ন: প্রতি মাসে বিদেশি ঋণ পরিশোধে একটি বড় অর্থ চলে যাচ্ছে রিজার্ভ থেকে। আমাদের সংকটাপন্ন রিজার্ভকে কীভাবে ঠিক করা যায়?
আহসান এইচ মনসুর: এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অবশিষ্ট রিজার্ভ এবং বৈদেশিক পাওনার একটি পরিপূর্ণ মূল্যায়ন প্রয়োজন। সরকার হয়তো এই মুহূর্তে সব বৈদেশিক পাওনা পরিশোধ করতে পারবে না। কীভাবে এগুলো পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। এ সরকার সবকিছু সংস্কার করবে। আর সেই সংস্কারের জন্য অর্থনৈতিক সাপোর্ট হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে। সরকারপ্রধান আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে খুব সহজেই ৮-১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা নিয়ে আসতে পারবেন বলে আশা করি।
প্রশ্ন: অর্থনৈতিক চাপ নিরসনে রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর: রেমিট্যান্সের মাধ্যমে ইমিডিয়েট কিছু রেসপন্স আসবে কিন্তু সেটা খুব বেশি হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ এখান থেকে অনেক টাকা হুন্ডি এবং অন্যান্য মাধ্যমে পাচার হবে। দেশে যারা কোটি কোটি টাকা জমিয়ে রেখেছে, তারা অর্থ পাচার করবে। রপ্তানির আয় হঠাৎ অনেক বেড়ে যাবে, সেটা বলা ঠিক হবে না। যেটুকু আছে তার মধ্যেই আমাদের থাকতে হবে। একই সঙ্গে চেষ্টা করতে হবে যতটুকু সম্ভব বাড়ানোর জন্য। ট্রান্সপোর্টের চাঁদাবাজি, বন্দরে সময় কমানোর চেষ্টা করতে হবে। অন্যান্য সমস্যা সংশোধনের জন্য সময় দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি ম্যানেজ করতে হবে।
প্রশ্ন: স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কোনো উন্নতি ঘটানো সম্ভব কি?
আহসান এইচ মনসুর: স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। উপজেলা এবং জেলা পরিষদগুলোকে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। তাদের কিছু ট্যাক্সেশন অথরিটি দিতে হবে এবং কিছু রাষ্ট্রীয় সেবা তাদের মাধ্যমে দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি এডুকেশন জেলা পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। এটাকে ঢাকাকেন্দ্রিক রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা আমি দেখি না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাটি কেন্দ্রীয়ভাবে থাকুক।
স্থানীয় স্বাস্থ্য বা গণস্বাস্থ্য এবং টিকাদান কার্যক্রমও জেলা পর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। এটা ঢাকা থেকে করার প্রয়োজন হয় না। লোকাল হাসপাতালগুলো জেলা প্রশাসনের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায়। তবে মেডিকেল কলেজগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক থাকতে পারে। স্থানীয় সরকার ক্ষমতাশালী হলে সেটা রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। লোকাল পর্যায় থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। নমিনেশন কেনাবেচা এবং কে কাকে চেনে তার ভিত্তিতে নমিনেশন দেওয়া এই সিস্টেমটি বন্ধ করতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ে থেকে রাজনীতিবিদরা উঠে এলে দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে একটি বিরাট পরিবর্তন দেখা যাবে।
প্রশ্ন: আমাদের উচ্চপ্রবৃদ্ধিকে বলা হচ্ছিল কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। এর ফলে আয়বৈষম্য বেড়েছে এবং ধনী-গরিবের ব্যবধান ব্যাপক হয়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরকার কী করতে পারে?
আহসান এইচ মনসুর: কর্মসংস্থান সৃষ্টি অন্যতম বড় একটি চ্যালেঞ্জ। কোটাব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বাতিল করেও এ সমস্যার সমাধান হবে না। প্রতি বছর আমাদের প্রয়োজন ২০-৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। এই বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য আগে আমাদের ছাত্রদের সত্যিকারের শিক্ষিত হতে হবে। সত্যিকারভাবে তাদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে। তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য তাদের সহযোগিতা করতে হবে। এর বড় একটি অংশের বিদেশে চাকরি খুঁজে নিতে হবে। আমরা জানি পৃথিবীর অনেক দেশেই জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে, এসব দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ বিদেশির কর্মসংস্থান হচ্ছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি চীন, জাপান, কোরিয়ার মতো দেশগুলোও প্রতি বছর বিদেশ থেকে লাখ লাখ কর্মী নিচ্ছে। দক্ষতা থাকলে আমাদের তরুণরাও এসব দেশের চাকরির বাজারে ঢুকতে পারে। আমাদের তরুণদের সামনে একটি বিরাট সুযোগ রয়েছে কিন্তু সেই সুযোগ গ্রহণের আগে আমাদের তরুণদের যোগ্য হয়ে গড়ে উঠতে হবে। জনশক্তিকে জনসম্পদের রূপান্তরিত করতে হবে।
আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা হলো, আনুষ্ঠানিক খাতের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বেশি। অর্থাৎ আমি কৃষকের সন্তান, আমার পারিবারিক কৃষিতে যে কাজ একজন করতে পারে, সে কাজ ১০ জন মিলে করছি। একজন দোকানদার তার দোকানে যেখানে একজন কর্মী প্রয়োজন সেখানে পাঁচজন কর্মী নিয়ে কাজ করছেন। এই কর্মীরা সবাই তার আত্মীয়স্বজন। এভাবে উৎপাদনশীলতা বাড়ে না। হয়তো ভাগাভাগি করে খাওয়া হয়। দুজনের উপার্জন দশজনের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। এভাবে দেশকে বেশিদূর এগোনো নেওয়া যাবে না। আমাদের আনুষ্ঠানিক খাত উন্নত করতে হবে। এখানে বেতনও ভালো, অনেক ধরনের কাঠামোগত সুবিধাও রয়েছে। আনুষ্ঠানিক খাতের উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই দেশ উন্নয়নের দিকে যাবে।
প্রশ্ন: ব্যাংক খাত সংস্কার করতে আপনি কোন কোন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকারে রাখবেন?
আহসান এইচ মনসুর: ব্যাংক খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে আলাদাভাবে নজর দিতে হবে। চার-পাঁচজন ব্যক্তির সমন্বয় একটি টিম গঠন করে দিতে পারে যারা ব্যাংকিং সেক্টরের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অভিজ্ঞ। এমন একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে পারলে ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
সব থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দিয়ে এই রিফর্ম শুরু হতে পারে। সম্পূর্ণ ব্যাংকিং সেক্টর অডিট করে কোথায় কোথায় গলদ রয়েছে, কোথায় কতটুকু চুরি-ডাকাতি-লুটপাট হয়েছে, তা বের করতে হবে। তারপর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। সবকিছুর ওপর বলব জনগণকে ধৈর্য ধরতে হবে।
আমি সুপারিশ করব, যদি সম্ভব হয় সরকারকে ১০০ দিনের মধ্যে তাদের স্ট্র্যাটেজির একটি আউটলাইন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। যার মধ্যে থাকবে পলিটিক্যাল রিফর্ম, সার্ভিস ডেলিভারি রিফর্ম এবং ইকোনমিক রিফর্ম। এর সঙ্গে অন্যান্য সেক্টর যুক্ত থাকতে পারে। অর্থাৎ এ সরকার কোন কোন সেক্টরে সংস্কার করতে চায়, তার একটি কমপ্লিট আউটলাইন জনগণের সামনে তুলে ধরা উচিত। এ আউটলাইনটি সামনে এলেই এ সরকারের একটি বৈধতা ও দেশ পরিচালনার যৌক্তিকতা তৈরি হবে। বাংলাদেশকে আমরা দেখেছি, এখানে বিরোধী গোষ্ঠী হতে বেশি সময় লাগে না। তাই সরকারকে যা কিছু করার খুব দ্রুতই করতে হবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh