‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গায় বন্ধ না হলে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বন্ধ হবে না’

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর দশা। একদিকে দুর্নীতির অন্যতম খাত, অন্যদিকে মানুষের অনাস্থা। দেশে এত বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকার পরও মানুষকে বিদেশ যেতে হচ্ছে। এসব নানা সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে সাম্প্রতিক দেশকালের মুখোমুখি হয়েছেন দেশের প্রখ্যাত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এইচএম লেলিন চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেলিম আহমেদ।

আমরা দেখি অনেকে রোগের ইতিহাস পুরোপুরি না শুনেই সেবা দিতে শুরু করেন। ফলে তাদের প্রতি মানুষ আস্থা রাখতে পারেন না।

বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের অনাস্থা রয়েছে এটা আংশিক সত্য। সার্বিক সত্য হচ্ছে এ দেশে প্রতিটি পেশার ওপরেই মানুষের অনাস্থা। সেটা রাজনীতিবিদ, বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ, ইঞ্জিনিয়ার অথবা অন্য কোনো পেশা হোক। দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতায় ভোগে, তার মানে মানুষ নিজের প্রতি আস্থাহীন। 

বাংলাদেশে এত বিশেষায়িত হাসপাতাল থাকতেও মানুষ চিকিৎসার জন্য কেন বিদেশমুখী?

দেশে কার্যকর কোনো রেফারেন্স সিস্টেম নেই। অর্থাৎ একজন রোগী প্রথমে একজন ডাক্তারকে দেখাবে। সেই ডাক্তার তার রোগের প্রাথমিক ইতিহাস দেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখল এটা সার্জারির কোনো ডাক্তারকে দেখতে হবে। সে একজন সার্জারি ডাক্তারের কাছে রেফার করল। পরে ওই সার্জারি ডাক্তার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ওই রোগীকে দেখবে। এরপর তিনি যদি মনে করেন বক্ষব্যাধির কোনো ডাক্তারের পরামর্শ দরকার, তাহলে ওই ডাক্তারের কাছে পাঠাবেন। এই কার্যকর রেফারেন্স সিস্টেম আমাদের চিকিৎসার নিন্ম থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত অনুপস্থিত। 

আবার এ দেশে যার টাকা আছে সে ছোট্ট একটি সমস্যার জন্যও ওই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তারকে টাকা দিয়ে দেখায়। আর যার দেখানো দরকার সে টাকা নেই বলে দেখাতে পারছে না। দেশে বিশেষায়িত চিকিৎসক এবং হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা দুটোই কম। অর্থাৎ বিত্তহীনদের বিশেষ চিকিৎসা পাওয়ার জন্য যে রাষ্ট্রীয় সহায়তা দরকার সেটাও নেই। এই অবস্থায় যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য রয়েছে তারা দেশের বাইরে যাচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে একাধিক মার্কেটিংয়ের লোক কাজ করে যাদের প্রধান কাজ- ওই সব দেশের চিকিৎসা ভালো, সেখানে গেলে সব সমাধান হয়ে যাবে এই প্রলোভন দেখিয়ে লোকজন নিয়ে যাওয়া। 

সরকারি হাসপাতালগুলোর অধিকাংশ ডাক্তার ঠিকমতো রোগী না দেখে তার প্রাইভেট চেম্বারে দেখা করতে বলেন। এই চর্চা বন্ধ করার উপায় কী?

একটি দেশের মানুষ কেমন স্বাস্থ্যসেবা পাবে সেটি সেই দেশের সরকারকে আইন দিয়ে বিধিবদ্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার যেহেতু দেশের প্রতিটি মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে পারছে না; যে কারণে বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় ৫৫ শতাংশের বেশি বেসরকারিভাবে স্বাস্থ্যসেবা পায়। সেই ক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব হচ্ছে যারা সরকারি হাসপাতালে চাকরি করে তারা বাইরে কোনো প্র্যাকটিস করতে পারবে না। প্রয়োজনে তাদের অধিক টাকা দিয়ে সরকারি হাসপাতালের জন্য নিযুক্ত করা হোক। একজন সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার যখন বাইরের রোগী দেখতে পারবেন না, তিনি বাধ্য হয়ে ভালো মতো রোগী দেখবেন। 

আমাদের দেশে অনেক চিকিৎসক গবেষণায় মনোযোগী না হয়ে রাজনীতি নিয়ে বেশি ব্যস্ত। এটা কেন?

যখন রাজনীতি ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, তখন সমাজের সব শ্রেণির মানুষই রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। আমরা দেখি যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ডাক্তারদের অঙ্গসংগঠনের নেতারা ভালো পোস্টিং ও প্রমোশন পান। ডাক্তারদের পোস্টিং-পদোন্নতি কেবল মেধার ভিত্তিতে হলে কিন্তু এই সংকটটা থাকত না। সেজন্য একটি বিধিবদ্ধ আইনি কাঠামো দরকার। সেটা আমাদের দেশে নেই।

বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে ভালো শিক্ষক-গবেষণাগার নেই, পড়ালেখার মান ভালো না। ফলে তারা সমাজে খুব একটা অবদান রাখতে পারছে না। 

এদেশের মেডিক্যাল কলেজে কেমন পড়ালেখা হবে তার একটি আইন রয়েছে। কতজন ছাত্রের বিপরীতে কতজন শিক্ষক থাকবে তা এই আইনি কাঠামোতে আছে। এই আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা নজরদারি করছেন না বলে বেআইনি পথগুলো তৈরি হয়। দেশে কতটা মেডিক্যাল কলেজ দরকার, বছরে কতজন ডাক্তার বের হলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা পরিপূর্ণ হবে, সে রকম কোনো পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরিকল্পনা স্বাধীনতার পর হয়নি। ফলে যে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তারা তার নিজস্ব কিছু লোককে টাকা-পয়সা আয়ের পথ হিসেবে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির অনুমতি দেয়। আইন মেনে সঠিক তদারকি হলে এই সুযোগ বন্ধ হয়ে আসবে।

প্রতিবছরই দেশে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেয়। এর স্থায়ী সমাধান কী?

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের প্রধান পথ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ। এ জন্য সারাদেশে একযোগে কিছু কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দরকার। এখন পর্যন্ত এডিস মশা নির্মূলের জন্য জাতীয় কোনো পরিকল্পনা নেই। অতএব রোগ তো ছড়াতেই থাকবে। শুধু বক্তৃতা ও গুরুগম্ভীর ধমক দিয়ে তো মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। 

আমাদের দেশে অধিকাংশ ফার্মেসিতে ওষুধ ঠিকমতো সংরক্ষণ হয় না। ফলে ওষুধের মান নষ্ট হয়ে যায়। এর জন্য কী করা প্রয়োজন?

ওষুধের দোকান আট-দশটি মুদি দোকানের মতো নয়। যিনি ওষুধের দায়িত্বে থাকবেন তাকে পাস করা ফার্মাসিস্ট হতে হবে। বাংলাদেশে অধিকাংশ ফার্মেসিতে প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট নেই। দ্বিতীয়ত ওষুধ রাখার বিধিবন্ধ নিয়ম রয়েছে। কোনটা ফ্রিজে রাখতে হবে, কোনটা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস টেম্পাচারে রাখতে হবে তা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু ড্রাগ অ্যাডমিনিস্টেশন-যাদের বিষয়টি দেখভাল করার কথা, তারা কাজটি ঠিকমতো করেন না। ফলে ওষুধের মান নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রত্যেকটি পদে আইনসম্মত, বিজ্ঞানসম্মত একটা ব্যবস্থা তৈরি এবং তার যথাযথ নজরদারি থাকলে এই বিষয়টির সমাধান হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাঙ্কিপক্সের ভয়াবহতা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশে এই নিয়ে কী ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বাংলাদেশে এখনো মাঙ্কিপক্স আসেনি, তবে আসার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। আসতে গেলে জলপথ বা স্থলপথ হয়ে আসবে। সুতরাং জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানের নিয়মমতে যে ধরনের তদারকি দরকার, তা কার্যকর হলে আমরা অনেকটা সুরক্ষা পাব। 

স্বাস্থ্য খাতকে বলা হয় অনিয়ম-দুর্নীতির অন্যতম খাত। এই খাতের দুর্নীতি বন্ধের উপায় কী?

দুর্নীতি দমন করতে হলে সরকারের সর্বোচ্চ জায়গা থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার প্রধান পদক্ষেপ হবে আমি দুর্নীতি করব না। রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, এমপিরা যখন দুর্নীতিতে লিপ্ত হন তখন অন্যের দুর্নীতি বন্ধ হবে কীভাবে? যদি তারা দুর্নীতি না করে তাহলে তা বন্ধ করা সহজ বিষয়। 

সম্প্রতি হামলার প্রতিবাদে সারা দেশে ‌‌‌‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করেছেন চিকিৎসকরা। এই আন্দোলন কতটা যৌক্তিক? 

ডাক্তাররা সবকিছু বন্ধ রেখে রোগী দেখবেন না বলেছে, তাহলে আমরা কি অ্যালাউ করব কিছু মানুষ মারা যেতে? কথাটা দুই ধরনের-এক. আমি একজনকে গুলি করলাম মারা গেল, দ্বিতীয়ত আমার সামনে একজন পানিতে ডুবে হাবুডুবু খাচ্ছে আমি তাকে হাত ধরে তুললাম না। ডাক্তাররা যদি সবকিছু বন্ধ করে, কিছু মানুষ চোখের সামনে মারা যাবে-এটা হতে পারে না। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কোনো প্রভাব কি স্বাস্থ্য খাতে পড়বে? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা কী থাকবে?

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতে যে কয়টি জনবান্ধব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ঘটনাক্রমে তার বেশিরভাগই অনির্বাচিত শাসক বলি তারা নিয়েছে। যেমন সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের শাসনামলে এ দেশে একটি জনবান্ধব ঔষধ নীতি প্রবর্তিত হয়েছে। এবারের জনসমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে অন্তত একটি স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করতে পারে-যার মধ্য দিয়ে আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনটি পাব। সেখানে যারা সেবা নেবে তাদের অধিকার এবং যারা দেবে তাদের দায়িত্বটাও পরিষ্কার করা হবে। আইনি মাধ্যমে যদি তা নির্ধারণ হয় তাহলে যিনি আইন ভঙ্গ করবেন তাকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা হবে। তাহলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //