সাহিত্যে দলবাজি, পাড়ার ছিঁচকে মাস্তানির মতো: ফয়েজ আলম

ফয়েজ আলম, কবি, উত্তর-উপনিবেশি তাত্ত্বিক এবং অনুবাদক হিসাবে সবিশেষ পরিচিত। তার সৃষ্ট সমৃদ্ধরচনা পাঠে উত্তর-ঔপনিবেশিকতা সম্বন্ধে জানাশোনার চমৎকার ভিত্তি বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে। তবে ফয়েজ আলমের তাত্ত্বিক লেখালিখির সাথে বাংলাদেশের মানুষ যতটা পরিচিত, তার কবিতার সাথে অতটা পরিচিত নন; কিন্তু তার কাব্যভুবনে পাঠকের মন পড়ে রবে, যদি পাঠক সে ভুবনের খোঁজ পান। নেত্রকোনায় জন্ম নেওয়া ফয়েজ আলম পেশায় একজন ব্যাংকার।  

সম্প্রতি এই মানুষটি তার সাহিত্যচিন্তা, তাত্ত্বিকক্ষেত্র এবং কবিতার ভুবন নিয়ে কথা বলেছেন- আড্ডা দিয়েছেন। আড্ডায় তার মুখোমুখি হয়েছিলেন সাম্প্রতিক দেশকাল-এর সাহিত্য সম্পাদক এহসান হায়দার।

প্রশ্ন: আপনার লেখালিখির শুরুর সময় কেমন ছিল? 

খুব সম্ভবত ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় জসীমউদ্দীনের একটা গল্প নকল করে লেখার চেষ্টা করেছিলাম। সেটিই আমার প্রথম চেষ্টা; কিন্তু কেন আর কীভাবে এ নেশায় আক্রান্ত হলাম, এখন আর পরিস্কার মনে পড়ে না। আমার ধারনা পাঠ্যবইয়ে লেখকদের পরিচিত এবং বড়দের মুখে তাদের সুনাম করা থেকে খ্যাতিমান হওয়ার নেশা এদিকে টেনে এনে থাকবে। 

শুরুটা কবিতা দিয়ে। নবম শ্রেণি থেকেই হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করতাম। ততদিনে লেখার নেশা পাকাপোক্ত হয়ে গেছে। মফস্বল শহর নেত্রকোনায় বাস। মাঝেমধ্যে লিটল ম্যাগাজিন, ভাঁজপত্র এইসব বের হলে লেখা ছাপার সুযোগ হয়। এইচএসসি পরীক্ষার পর প্রথম কবিতা ছাপা হয় দৈনিক জাহানে। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল তখন ওটার সাহিত্য পাতা দেখতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর সব দৈনিকে লেখার সুযোগ এসে যায়। ইত্তেফাক, সংবাদ, দৈনিক বাংলা, বাংলাবাজার, মানব জমিন, আজকের কাগজ সব জায়গায় কমবেশি লিখেছি। তবে লিটলম্যাগেই আমার প্রকাশ। 

প্রশ্ন: আপনি মূলত অনুবাদের জন্য পাঠক মহলে সুপরিচিত। তবে এর বাইরে সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। আপনার এদিকটা নিয়ে সাধারন পাঠকদের ধারনা কম। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কি?

আমার প্রকাশিত বই ‘ব্যাক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়াম মানুষ’ কবিতার সংকলন, বের হয় ১৯৯৯ সালে। মূলত এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদের দুটো বিখ্যাত বই “অরিয়েন্টালিজম” এবং “কাভারিং ইসলাম”-এর অনুবাদই আমাকে বিশেষ খ্যাতি এনে দেয়। তবে উত্তরউপনিবেশি চিন্তাভাবনা, বিউপনিবেশায়ন, উপনিবেশি জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য এসব নিয়ে প্রচুর লিখেছি, নানা অনুষ্ঠানে আলাপ করেছি, সাক্ষাৎকারে কথা বলেছি। এদিকটা নিয়ে আমার তিনচারটা বই বের হয়েছে: “উত্তরউপনিবেশি মন(২০০৬), ভাষা ক্ষমতা, আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (২০০৮)”, ”বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব(২০১২)” এসব বই কিন্তু বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, দুএক বছর পরপরই নতুন সংস্করণ হচ্ছে। ২০২২ সালে বের হওয়া “ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস”এবং ২০২৩ সালের “বাঙালির ইতিহাস চর্চার পথের কাঁটা” এরই মধ্যে ২/৩ বার ছাপা হয়ে গেছে। বাংলাদেশে উত্তরউপনিবেশি চিন্তার শুরুটা করতে পেরেছিলাম ভালোভাবেই। এখন অনেকে গরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, উত্তরউপনিবেশি দৃষ্টিভঙ্গিতে যাচাই করে নিচ্ছেন সাহিত্য-সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক। 

চারটা কবিতার বইও বেরিয়েছে। কবিতায় মৌলিক কিছু কাজ করেছি। যেমন আমি বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ কথ্য ভাষায় কবিতা লিখি। আমার কবিতার উপমা-উৎপেক্ষা প্রতীক রূপক সবই জনমানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের ভাষা থেকে নেওয়া। তো, যা বলছিলাম, অনুবাদের বাইরে অনেক কাজ করেছি। 

প্রশ্ন: ভাষা মানুষের বিকাশ ও সভ্যতার অগ্রযাত্রায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। বলা হয় বাংলা ভাষার আধুনিকায়ন ঘটেছে। তা থেকে বাঙালি জাতি কতটা সভ্যতার দিকে নতুন করে অগ্রসর হয়েছে বলে মনে করেন? 

সভ্যতার বিকাশে ভাষার ভূমিকা অপরিসীম। মানুষ অর্জিত জ্ঞান আরেকজনের কাছে তুলে দিত ভাষার সাহায্যে, যেটি ছিল হাতেকলমে কাজ করার জ্ঞান। মানুষ যখন লিখতে শিখলো তখন সে পেলো হাতবদলি জ্ঞান, ভাষার মধ্যে যে জ্ঞান সঞ্চিত করে রাখা হয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। হাতবদলি জ্ঞান সভ্যতার গতি অনেক গুন বাড়িয়ে দিয়ে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে। এর পেছনে ভাষার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। 

এ অর্থে এ দেশে সভ্যতা বিকাশে আমাদের ভাষারও অবদান আছে; কিন্তু বাংলা ভাষার আধুনিকায়ন হয়নি, একেবারেই না। বরং বলা যায় বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের নিয়মের দাস বানিয়ে তার প্রকাশ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেন। ভাষা হচ্ছে একটা মানবগোষ্ঠীর ভাব বিনিময়ের মাধ্যম। তার মুখের বুলি। সময়ের সাথে সেই মানুষগুলোর জীবনযাপন, পরিপার্শ্ব, সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে, তাই তার বদলে যাওয়া ভাব বহনের জন্য তার ভাষাও বদলাচ্ছে। অর্থাৎ ভাষা সচল জীবনের সাথে জড়ানো একটা ব্যাপার। তাই ভাষাকে জীবন্তই বলা যায়। এখন এমন এক ভাষার কথা ধরুন যেটি কোনো মানবগোষ্ঠীর ভাষা না, যেটি কেউ মুখে বলে না। সে ভাষার সাথে জীবনের কোনো সম্পর্ক নাই, মানবসভ্যতার প্রবাহমানতার সম্পর্ক নাই। সে ভাষাটিই হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃত কোনোকালে কোনো মানবগোষ্ঠীর ভাষা ছিল না। তার সাথে জীবনের অবিরাম গড়ানের সম্পর্ক নাই, মানুষের আত্মার ওম নাই। সম্পর্ক আছে স্থির ধর্মবিশ্বাস ও আচার-প্রথার। সেই ভাষায় মধ্যযুগে প্রচুর ধর্মগ্রন্থ লেখা হয়েছে, রামায়ন মহাভারতের মতো কিছু লোককাহিনী পুরাণ ইত্যাদি লেখা হয়েছে। এমন একটি অনড় ভাষিক ছাঁচ যখন গাঙের গড়ানের মতো চলমান বাংলা ভাষার উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো তখন তার গতি শ্লথ হয়ে এলো, প্রকাশ ক্ষমতা কমে গেলো, জনমানুষের জীবনের সাথে তার সরাসরি সম্পর্ক ছিঁড়ে গেলো চিরতরে। এর সর্বশেষ রূপ ‘প্রমিত বাংলা’ বাংলাদেশের নাগরিক মানুষদের কেবল একটা ক্ষুদ্র অংশের জীবন রূপায়নে সক্ষম। এ ভাষা বাকি ৯০ বা ৯৫ শতাংশ মানুষের চলমান জীবন আর তার চলমানতা ধরার উপযোগী নয়। আসুন একটু উল্টো করে ভেবে দেখি। জনমানুষের ট্যাক্সের টাকায় বানানো রাষ্ট্রীয় যোগাল যেমন ইস্কুল কলেজ পাঠ্যবই আর মিডিয়া ব্যবহার করে আমরা প্রমিত বাংলাকে চাপিয়ে দিয়ে রেখেছি সাধারণ মানুষের উপর। যদি এমন হয় কাল থেকে এগুলো চালাবে প্রকৃত জনমানুষেরা, যারা প্রমিত জানে না, কেবল জানে নিজের ভাষা, নিজের বাপ-মার ভাষা। তাহলে কী ঘটবে! আমরা প্রমিতভাষীরা নিতান্ত সংখ্যালঘু, বিভাষীতে পরিণত হব। আমরা মনে করি এমনটি ঘটবে না, বিশ্বাস করি রাষ্ট্রযন্ত্র সবসময় ৫ ভাগ মানুষের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দিয়ে রাখবে বাকি ৯৫ ভাগের উপর; কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে কিন্তু এটি উল্টে যেতেও পারে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম জনমানুষের সাধারন কথ্যবাংলায় যেভাবে দেদারসে লিখছে। তো, প্রমিত বাংলাকে কোন যুক্তিতে আধুনিকায়িত ভাষা বলবো। তাই এ ভাষার আশ্রয়ে সভ্যতার দিকে অগ্রসর হওয়ার দিকও ঠিক থাকবে না। গণমানুষ থেকে কেবলই বিচ্ছিন্নতার দিকে এগুবে। 

প্রশ্ন: বাংলাভাষার চর্চায় প্রমিত যেমন জরুরি তেমনি আঞ্চলিক ভাষাও জরুরি। কারো গুরুত্ব কারো থেকে কম নয়। কারো কারো মতে প্রমিত ভাষা আঞ্চলিক ভাষার উপর চেপে বসে আছে। আবার একদল লোক পূর্ববঙ্গের ভাষা ও পশ্চিমবঙ্গের বলে যে একটা বিভাজন তৈরি করে থাকে, এই বিষয়ে আপনার মত জানতে চাই।

খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। প্রমিত আর আঞ্চলিক ভাষা রীতির বিষয়টা একটু  বোঝা দরকার। আপনি তো জানেন বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ যেটাকে বলি- সেটিকে একরকম আধা-কৃত্রিম ভাষা বলা যায়। উনিশ শতকের শুরুতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত পণ্ডিত আর পরবর্তীকালের সংবাদপত্রের লেখকরা দীর্ঘদিন তর্ক-বিতর্ক ও শলাপরামর্শ করে মূলধারার বাংলা এড়িয়ে সংস্কৃতের অনুকরণে এমন এক বাংলা গদ্য তৈরি করেন যার অধিকাংশ শব্দই সাধারন বাংলাভাষীর অজানা। প্রায় আড়াইশ বাংলা শব্দ বাদ দিয়ে তার বদলে সমার্থক সংস্কৃত শব্দ ঢোকানো হয়। তারা বাংলা ভাষার মূলধারাটিকে প্রায় বর্জন করেন বলা যায়; কিন্তু  সংস্কৃত পণ্ডিতদের সেই লেখ্য ভাষা স্কুল-কলেজ-পাঠ্যপুস্তক-সংবাদপত্র ইত্যাদি মারফত চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হলেও তারা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা কিন্তু বদলে দিতে পারেননি। 

আবার, বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরী মিলে ভগিরথীর দুইপাড়ের মানুষের কথ্যবাংলার অনুকরণে লেখ্যবাংলাকে ঘষে-মেজে নতুন রূপে হাজির করেন, যেটিকে আমরা এখন চলিত বাংলা বা প্রমিত বাংলা বলি। তো, এই যে দুই দ্ইুবার বাংলা ভাষার রূপ বদলে নেওয়া হলো, তার কোনোটিতেই বাংলাদেশের মানুষের কথ্যরীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা ছিল না, যদিও কলিকাতা ও আশপাশের এলাকার মানুষের ভাষার রীতিকে গ্রহণ করা হয়েছিল। ফলে আদি ও মধ্যযুগ হয়ে বহমান মূলধারার বাংলা ভাষা টিকে থাকলো বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ কথ্যরীতি হিসাবে, আর লেখার ভাষা হলো কলিকাতা-ভগিরতী পাড়ের মানুষের কথ্যরীতির আদলে পরিবর্তিত প্রমিত বাংলা। এই দুয়ের বিভাজন তো ঐতিহাসিক বাস্তবতা, যেটির সূচনা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজেরে পণ্ডিতদের হাতে। তো, যেটা বললেন, একদল পূর্ববঙ্গের ভাষা ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বলে বিভাজন তৈরি করে; আসলে এ ধরনের বিভাজন কেউ তৈরি করে বলা উচিত হবে না মনে হয়, বলা দরকার তৈরি করা বিভাজন আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বিভাজন তো তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকের শুরুতে সংস্কৃত পণ্ডিতদের হাতে। 

ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, একটা জনগোষ্ঠীর জীবনাভিজ্ঞা, ইতিহাস, ধর্মবোধ, সংস্কৃতি সবকিছুর বয়ান জমা হয়ে থাকে তাদের ভাষার মধ্যে। একইভাবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের সাংস্কৃতিক জ্ঞানতাত্ত্বিক সঞ্চয় জমা হয়েছে সাধারণ কথ্যবাংলায়। এ কারণেই প্রমিত বাংলা বাংলাদেশের অল্পসংখ্যক মানুষের প্রকাশমাধ্যম হয়ে থেকেছে, যাদের অনুভূতির ভাষা অনেকটাই বানোয়াট বলবো আমি। প্রমিত কখনো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ঐতিহ্য ও জীবনের বাহন হয় উঠতে পারেনি, পারবেও না। কারণ এ ভাষারীতির সাথে তাদের জীবনের সংযোগ নেই। 

আরেকটা কথা বলা দরকার। বাংলাদেশে আঞ্চলিক কথ্যরীতির বাইরে একটা সর্বাঞ্চলীয় কথ্যরীতি কিন্তু চালু আছে বহুকাল আগে থেকে। নোয়াখালি, সিলেট, রংপুর, বরিশালের মানুষ একসাথে হলে তারা নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না, বরং কথা বলে একটা সর্বাঞ্চলীয় কথ্যরীতিতে। এটিই বাংলাদেশের মান কথ্যরীতি, একটু আগে যে কথা বলেছি। বাংলাদেশে এ রীতিতে কথা বলা লোকের সংখ্যাই সবেচেয়ে বেশি। গত কয়েক বছর এই সর্বাঞ্চলীয় কথ্যরীতি কিন্তু অনেকের লেখার ভাষা হয়ে উঠেছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্তের যারা নেটে লিখেন, তাদের। আমি নিজেও বাংলাদেশের কথ্যরীতিকে লেখার ভাষা হিসাবে নিয়েছি। আমরা ভাষার আলোচনায় কেবল প্রমিত আর আঞ্চলিক ভাষার কথাটাই বলি, সর্বাঞ্চলীয় কথ্যরীতির কথাটা না আনলে বাংলাদেশের ভাষা বিষয় আলোচনা পূর্ন হয় না।

প্রশ্ন: দীর্ঘ বঞ্চনা ও নানামাত্রিক উপনিবেশি শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করেছি বলে আমরা মনে করি। সাহিত্যের চিন্তায় আমাদের নিজস্বতা যেভাবে তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। আমাদের চিন্তায় পশ্চিমাবিশ্বের চিন্তা কাঠামো আজও আদৃত। জাতি হিসাবে আমরা এই দিকে এখনও নিজেদের তৈরি করতে না পারার দিকটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? 

উপনিবেশি জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য হতে মানসিক মুক্তির পথ নিয়ে ভাববার জন্যই আমি অরিয়েন্টালিজম-এর অনুবাদ শুরু করি। পশ্চিমা চিন্তা কাঠামো কীভাবে আমাদেরকে পশ্চিমের আধিপত্যে আচ্ছন্ন করে রাখে তার একটা দুর্দান্ত বিশ্লেষণ আমরা পাই সাঈতের বইটিতে। ফলে আমার আশা ছিল অরিয়েন্টালিজম পড়ার মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে এ বিষয়ক ক্রিটিক্যাল চিন্তার পিপাসা তৈরি হবে। সেটি হয়েছেও। আমরা নামকরা সব উত্তরউপনিবেশি চিন্তাবিদসহ উত্তরাধুনিক চিন্তা পড়ছি; কিন্তু সমস্যা হচ্ছে  বাছবিচার করে পড়তে পারছি না। কোনটা আমার জন্য জরুরি কোনটা না, সেটি যাচাই করছি না। এটি এক বিরাট সমস্যা। পশ্চিমা চিন্তা ও সাহিত্যের প্রতীকগুলো এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে। 

আরেকটা সমস্যা হলো উত্তরউপনিবেশি চিন্তাভাবনা আমাদের সৃষ্টিশীলতার জগতকে যেন স্পর্শই করতে পারছে না। কবিতা এখনও তিরিশের ভাব-ভাষা-প্রকাশভঙ্গিতেই অনেকটা আটকে আছে। কথাসাহিত্যে জনমানুষের জীবনাভিজ্ঞার বদলে আইডিয়া-নির্ভর জনজীবনের বয়ান তৈরি হচ্ছে। আমাদের সৃষ্টিশীল সাহিত্যে মহৎ আইডিয়া হিসাবে জায়গা করে নিচ্ছে পশ্চিমা চিন্তাকাঠামোর আধিপত্যবাদী প্রতীকগুলোই।  সচেতনভাবে উপনিবেশি বয়ানের বিপরীতে দাড়ানো, চিন্তা-ইতিহাস-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে উপনিবেশি প্রভাবের রূপটা চিহ্নিত করা এবং সেগুলো কাটিয়ে ওঠার সচেতন চেষ্টা আমাদের সৃষ্টিশীলতার জগতে দেখছি না। আপনি দেখেন, আমেরিকা, ইউরোপ এমনকি ভারতেও রূপকথা কিস্সা কাহিনী নিয়ে এমন সব সিনেমা তৈরি হচ্ছে যা সহজেই সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। অথচ আমরা আমাদের সমৃদ্ধ জনসাহিত্যের খবরও রাখি না। তাহলে, কোন নিজস্বতার উপর দাড়াবেন আপনি? তবে তরুণদের অনেকের লেখায় আত্ম-উদ্বোধন আর মূল সন্ধানের ইশারাও রচিত হচ্ছে। হয়ত আরো একটু সময় লাগবে, পুরোপুরি জেগে ওঠার জন্য।

প্রশ্ন: আমরা অর্জন করেছি আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা; কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছে কতটুকু? পৃথিবীর উন্নত দেশগুলির শিক্ষার্থীদের এবং বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের তফাৎ বিস্তর, এরজন্য কী কোনোভাবে  ভাষা-শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিবন্ধকতা , বিস্তারিত জানতে চাই?

আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা কেবল রাজনৈতিক বললে হয়ত একটু বেশি বলা হয়ে যাবে। তবে নির্ধিদ্বায় বলতে পারি সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে আমরা স্বাধীন হতে পারি না। প্রথমে উপনিবেশ সাংস্কৃতিক আধিপত্য, এখন গোটা পশ্চিমের সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রভাব, সংস্কৃতায়িত প্রমিত বাংলার শিরা বেয়ে আসা ভারতীয় সংস্কৃতিক আধিপত্য আমাদেরকে চিন্তা ও চর্চার জায়গায়টায় স্বাধীন হতে দেয়নি। এ কারণে বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতির একটি সর্বজনমান্য বয়ানও খাড়া হয়নি। তবে শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্যা ভাষাকেন্দ্রিক সমস্যা তেমন নয়, যতটা শিক্ষা দেওয়া ও মান নিয়ন্ত্রনের সমস্যা। আরেকটা বিষয়, আমরা যদি চিরদিন পশ্চিমা শিক্ষাকে মানদণ্ড মেনে এর পেছনে দৌড়াতে থাকি, তাহলে সবসময় পেছনে থেকেই দৌড়াবে, আর আমাদের কেবলই মনে হবে আমরা পিছে পড়ে আছি। 

প্রশ্ন: আমার কাছে কবিতা সর্বজনীন, সারা পৃথিবীর মানুষের। বাংলা ভাষায় যে মহৎ কবিতাটি আপনি চর্চা করছেন-লিখে রাখলেন আজ, সেটি কেবল আপনার নয়, সেই কবিতাটি সকলের- পৃথিবীর সব মানুষের জন্য। বিষয়টি সম্পর্কে আপনার বিস্তারিত মূল্যায়ণ প্রত্যাশা করছি।

অবশ্যই, কবিতা সর্বজনীন, আবার আঞ্চলিকও। কবিতাই হোক আর নাচ, গান বা সিনেমাই হোক, তার কিন্তু একটা ভুগোল আছে, পরিপার্শ্ব আছে, আছে দীর্ঘ সাংস্কৃতিক সিলসিলার ভিত্। ভোক্তা হিসাবে আমি যখন এগুলোর মুখোমুখি হবো, তখন একই ভূগোল-পরিপার্শ্ব-ঐতিহ্যের মানুষ হলে আমি এর গোটা শিল্পরসটাই উপভোগ করতে পারব। তা যদি না হয় তবে আমি কেবল ঐ শিল্পের মানবিক অংশটাই উপভোগ করতে পারব। এই জন্য শিল্প একই সাথে সার্বজনীন আবার আঞ্চলিকও।     

প্রশ্ন: আপনি পেশাগত জীবনের বাইরে বাংলাদেশের উত্তর-উপনিবেশি তাত্ত্বিক, প্রাবন্ধিক ও কবি হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের বিখ্যাত গ্রন্থ অরিয়েন্টালিজমের ভাষান্তর করেছেন, নেত্রকোনায় জন্মেছেন আপনি। এটা শিল্প-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল। কবি চন্দ্রাবতী বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সন্তান।  এই সময়ে এসে বিষয়গুলো নিয়ে কীভাবে ভাবেন?

আমি যেখানে জন্মেছি সেখানকার মাটি, গাছগাছালি, মানুষ আর এসব মিলিয়ে সবকিছুর কাছে খুব কৃতজ্ঞ। বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিস্তীর্ন সবুজ প্রকৃতি, হাওড়-বিল-গাঙের এলাকা। বর্ষায় প্রচুর অবসর সময়। সেই সময় ওখানকার মানুষ প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে খুব নিজের করে পায়। এ অবস্থা মানুষকে সহজ আর আবেগী করে। আমার বহুরাত কেটে গেছে আষাঢ়ের উথালপাতাল ভাসানে  খোলা নৌকায় শুয়ে জ্বলজ্বলে জোছনার নিচে গভীর হাওয়ায় উড়তে উড়তে। এ এমন এক পরিবেশ আপনি কবি না হলে গায়ক হবেন নয়ত পালাকার, না হলে অন্তত মনে মনে নায়ক, মোটকথা কল্পনায় ভেসে না গিয়ে আপনি পারবেন না। আমি কৃতজ্ঞ, আমার প্রথম কবিতার লাইন নিশ্চয়ই ঐসব রাতের কোনো একটির জোছনার জ্বলজ্বলে চাওনির নিচে আমার বিস্মিত রুহ-তে এসে জমেছিল অপরূপ এক ফোঁটা উঁশের (শিশির) মতোন। 

প্রশ্ন: তত্ত্বীয় ক্ষেত্র এবং সৃষ্টিশীলতার জগত- এই দুটি বিষয়ের মধ্যে বিশেষভাবে প্রাধান্য দিতে চান কোনটিকে- যেহেতু আপনি একই সঙ্গে তাত্ত্বিক এবং কবি?

আমি রক্তে আবেগে বুদ্ধিতে মূলত সৃষ্টিশীল মানুষ। আমি সৃষ্টিশীলতার জগতেই বেশি আনন্দ পাই। তাহলে কীভাবে গেলাম তত্ত্ব চর্চায়! আমার তাত্ত্বিক হয়ে ওঠারও একটা বুদ্ধিবৃত্তিক সফর আছে। সংক্ষেপে বলি, আমি যখন বুঝতে পারি আমার ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিন্তার উপর এক দীর্ঘ আধিপত্যের ছায়া তখন থেকেই আমি এ দিকটায় ঝুঁকে পড়ি। এই আধিপত্যের ইতিহাস, স্বরূপ, ফলাফল চিহ্নিত করার জন্য, মানুষকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। তাই বলবো আমার বুদ্ধিবৃত্তিক তাত্ত্বিক কাজগুলো সামাজিক দায় থেকে করা। আর সৃষ্টিশীলতার জায়গাটা আনন্দের, অপার মুক্ত আনন্দের। 

প্রশ্ন: আপনার নিজের দৃষ্টিতে গদ্যভাষা কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

আমি মনে করি গদ্যের ভাষা হওয়া উচিত বেশিরভাগ মানুষের কাছে সুবোধ্য, জনমানুষের দৈনন্দিন ভাষার কাছাকাছি একটা রীতি। যা কিছু অলংকরণ, মুদ্রা, ছন্দ দিয়ে আমার চিন্তার রূপায়ন করতে চাই সেটি ঐ ভাষার সীমানাতেই করা উচিত। কারন আমার জনসমাজের জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার প্রতিফলন জনমানুষের ভাষাতেই ছাপ ফেলছে। ফলে সেই ভাষা জীবন্ত এক স্রোত প্রায়। সেই তুলনায় প্রমিত বাংলা খানিকটা কৃত্রিম, জনবিচ্ছিন্ন, প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত।

প্রশ্ন: গোষ্ঠীবাদিতার বিষয়গুলিকে কীভাবে দেখেন? ঢাকার সাহিত্য চর্চার বলয় থেকে প্রান্ত বা আঞ্চলিক সাহিত্যকর্মীর চর্চার ক্ষেত্র কতটা মুক্ত বলে মনে করেন?

খুব খারাপ মনে করি। ঢাকার সাহিত্য চর্চার সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটাই হলো দলবাজি, একেবারে পাড়ার চিঁছকে মাস্তানীর মত। নিজেরা লিটলম্যাগ করে দলের লোকদের লেখা প্রকাশ করা, সাহিত্য পাতার সম্পাদক হয়ে অনুগত লোকদের প্রকাশ-প্রচার করা, একজন আরেকজনের প্রশংসা করা এবং দলছুট একাকী মেধাবী মানুষকে প্রচারবঞ্চিত করে রাখা- এসবই হলো ঢাকার সাহিত্যের দলবাজির স্বরূপ। এইসব দলের আবার একজন ডন থাকে, পুরা মাফিয়া স্ট্রাকচার। এরাই আবার ক্ষমতাসীনদের পা চেটে পুরস্কার হাতিয়ে নেয়, সারক্ষণ প্রচারের মধ্যে থাকে। দলবাজির শিকার হয়ে বহু মেধাবী মানুষ লেখালিখিই ছেড়ে দিয়েছে। সৃষ্টিশীলতার পথে এটি বিরাট বৈরি এক পরিবেশ। এর জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষত্রিগ্রস্ত হচ্ছে ঢাকার বাইরের লেখকরা।  

প্রশ্ন: শিল্পকে অস্বীকার করা, নতুনকে না মেনে নেওয়া-দৃষ্টিভঙ্গির অনুদারতা না-কি এগুলিকে সাহিত্যের রাজনীতি বলবেন?

আমার পর্যবেক্ষণ হলো দুটোই আছে। কিছু লোক আছে অভ্যস্ততার মধ্যে শান্তি পান, আরাম বোধ করেন। এরা নতুন কিছু দেখলে অস্বস্তি বোধ করেন, বিরোধিতা করেন, ঐ অভ্যস্ততার কারনে; কিন্তু, এমন অনেক মানুষ আছেন নতুনের প্রতি যাদের প্রতিক্রিয়াটা রাজনৈতিক। কারণ তিনি যে পুরনো ফর্মে নিজেকে তুলে ধরে একটি গুরুত্বের জায়গা তৈরি করেছেন নতুন চিন্তা প্রতিষ্ঠিত হলে হয়ত তার অবস্থানটাও নড়বড়ে হয়ে উঠবে। এ ভাবনা থেকে তারা নতুন চিন্তাকে উপেক্ষা করেন, ফেলে দিতে চান। ঠিক এই কারণেই আমাদের দেশে উত্তরউপনিবেশি সাহিত্য সমালোচনা এখনো দাড়ায়নি। 

প্রশ্ন: অনুবাদসাহিত্যে এদেশের সাহিত্যিকরা গত এক দশকে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন, বিষয়টিকে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ন মনে হয়, নিজের ভাষায় ভীনদেশি সাহিত্যপাঠ অন্যদেশে অনেক বেশি আবার নিজের ভাষার সাহিত্যকে ভীনদেশি ভাষায় প্রকাশ করার ব্যাপারও খুব জরুরি- এ বিষয়ে আপনার মতামত জানাবেন কী?

ভিনদেশি সাহিত্যের অনুবাদ খুব জরুরি একটা কাজ, যেটি এখন আমাদের এখানে বিশেষ গতি পেয়েছে। তবে মানসম্পন্ন অনুবাদ কম হচ্ছে। পরের যে কথাটা বললেন আমাদের সাহিত্য বিদেশি ভাষায় অনুবাদ সেটি প্রায় হচ্ছে না বললেই চলে। আমাদেরকে আন্তর্জাাতিক পাঠকপরিমণ্ডলে ঢুকতে হবে। সেজন্য ভিন ভাষায় আমাদের লেখাজোঁকা অনুবাদের সংগঠিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। 

প্রশ্ন: দীর্ঘদিন হয়ে গিয়েছে আপনি লিখছেন, লেখার কারণে বাংলা সাহিত্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের সঙ্গেও আপনার সুসম্পর্ক এবং আড্ডাযাপন রয়েছে। এমন কোনো ঘটনা রয়েছে কী কারও সঙ্গে- যা সব সময় মনে হয়, সামনে চলার প্রেরণা পান সেই ঘটনা থেকে?

একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে। খুব সম্ভবত ১৯৯৮ সালের দিকে। বাংলা বাজারের সাহিত্য পাতায় অন্নদাশঙ্কর রায় ‘আদিপর্ব’ শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লিখে দাবী করেন, বাঙালি বলতে তিনি বুঝেন বাঙালি হিন্দু, তাই তার বিবেচনায় বাঙালি সংস্কৃতি হলো বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতি। আমি এর জবাবে লেখা একটা নিবন্ধে প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে দেখাই যে, বাঙালি জাতি এবং সংস্কৃতি বাংলাদেশের বর্তমান ভৌগোলিক সীমানায় গড়ে ওঠা হাজার হাজার বছরের এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা যার উত্তরাধিকার এদেশের মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ সকলেই, যাতে বহুকাল পরে এসে যুক্ত হয় পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা। লেখা যেদিন বাংলা বাজারে ছাপা হয় সেদিন সকাল বেলা ছফা ভাই বনানীতে আমার অফিসে এসে হাজির। সোজা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ফয়েজ একটা জাতীয় দায়িত্ব পালনা করলা। সকালবেলা তোমার লেখাটা পইড়া এই কথাটা বলার জন্যই স্কুটার নিয়া আইসা পড়ছি।’ 

ছফা ভাইর সাথে আমার তেমন কোনো ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল না। মাঝেমধ্যে দেখা হলে সালাম দিতাম, উনি জিজ্ঞেস করতেন ভালো কি না, এইটুকুই; কিন্তু ঐদিন যে আবেগ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে আমার লেখার প্রশংসা করেছিলেন সেটি আমার জীবনে অন্যতম প্রেরণার জায়গা হয়ে আছে। 

প্রশ্ন: একজন সৃষ্টিশীল মানুষ আপনি, আপনার নিকট সমাজের দায়বদ্ধতার জায়গাটি ব্যাখ্যা করবেন কীভাবে?

আমি মনে করি সমাজের কাছে একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় সৃষ্টিশীলের দায় আরো বেশি। আমি কোনোদিন শিল্পীর ঈশ্বরত্বে বিশ্বাস করি না। সমাজের যে-সব জ্ঞানতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক যোগাল আর সব মানুষকে আক্রান্ত করে, আধিপত্যের জোয়াল পরিয়ে দেয় সেগুলো সৃষ্টিশীল মানুষকেও কব্জা করে নিতে পারে। ফলে তিনি যা সৃষ্টি করেন তার মধ্যে সমাজের বাস্তবতা অবশ্যই ছাপ ফেলবে। আবার তার সৃষ্টি সমাজের উপর অনবরত তৈরি করবে এক ধরনের প্রভাব যত দুর্বল বা সবল হোক। তাই, তিনি কোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যের শিকার হচ্ছেন কি না এবং সেই আধিপত্যের কারনে তার সৃষ্টিও সমাজের উপর কোনো বৈরি প্রভাব তৈরি করছে কি না সেটি দেখার দায়িত্ব তারই। শিল্পের জন্য শিল্প বলে কিছু নাই, এগুলোও এক ধরনের সামাজিক উৎপাদন। লেখার সময় আমি এই দায়বদ্ধতার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন থাকি। একটু আগে সেটিই বলছিলাম, আমার তত্ত্বচর্চার সূচনা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে।

প্রশ্ন: আপনার নিজের সাহিত্যচর্চার মূল্যায়ন আপনার নিকট কেমন, এবং আপনার সাহিত্যচিন্তা সম্পর্কে জানতে চাই...

নিজের লেখার বা চিন্তা মূল্যায়ণ নিজে করবো কীভাবে। করা উচিতও না। শুধু এইটুকু বলি, খানিক আগেও বলেছি, যখন আমি বুঝেছি আমার সমাজ নানা রকম আধিপত্যের চিহ্ন বহন করে চলেছে তখনই আমি তত্ত্ব চর্চায় নেমেছি। এর অর্থ হলো আমি যা লিখছি তাতে আমার বিশ্বাস ষোল আনা। আমি মনে করে বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তির জন্য যেমন উপনিবেশি আধিপত্য থেকে বের হওয়া উচিত তেমনি ভাষার আধিপত্য থেকেও মুক্তি খুঁজতে হবে। যে ভাষা আমার জনমানুষের আত্মার ওম  নেই, সে ভাষায় সাহিত্য চর্চা জাতি হিসাবে আমাদেরকে খুব বেশি দূর নিয়ে যেতে পারবে না। এ জন্য কবিতায় জনসমাজের ভাষা, বাকভঙ্গি ও জনসংস্কৃতির নির্যাস ব্যবহার করছি আমি। 

আমি মনে করি বাংলাদেশের জনমানুষের জীবন আমাদের কবিতায় নেই বললেই চলে। জসীমউদ্দীন, আল মাহমুদ এক ধরনের কাজ করে গেছেন। তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত আধুনিক বাকভঙ্গি ও ফর্ম এড়াতে পারেননি। মানে যেটাকে বলা যায় আধুনিক নাগরিক কবির মুখে গ্রাম বাংলার কথা, কমন পিপলের বিবরণ, সেটা করে গেছেন। অন্যদিকে, আমি চেষ্টা করছি বাংলাদেশের জনমানুষের মাঝখান থেকে উঠে আসা সাধারণ কথ্য বাংলায় জনমানুষের সংস্কৃতি, তার আকাক্সক্ষা, তার রুহানিয়াত কবিতায় ধরার। উপনিবেশি সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রভাব পড়েছে প্রধানত নগরকেন্দ্রগুলোতে। তাই, যে মফস্বলে পড়াশোনা করে বড় হয়েছে এবং লিখছে সে যদি নগরসংস্কৃতির ধাঁচটা না নেয় তাহলে তার লেখায় উপনিবেশি প্রতীকগুলোর প্রভাব খুবই কম পড়বে। আমি এই কায়দায় উপনিবেশি প্রভাব থেকে বের হওয়া চেষ্টা করেছি। মফস্বলে বড় হয়ে ওঠার প্রতিটি দিন আমি যা শিখেছিলাম, যা শরীর ও মন দিয়ে অনুভব করেছিলাম, আজো বারবার সেখানে ছুটে গিয়ে যা দেখি সেই জনজীবনের আবেগ-অনুভুতি-আইডিয়াগুলো আমি কবিতায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি এবং জনমানুষের ভাষায়। এর ফলে যেমন উপনিবেশি প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে লিখা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের জনমানুষের ঐতিহ্যিক সঞ্চয় ও জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা কবিতায় নিয়ে আসতে পারছি। আমি মনে করি এদিকটায় বাংলা কবিতার জন্য ফাঁকা পড়ে আছে এক বিশাল দিগন্ত। আমি তো মনে করি একদিন এটিই আমাদের কাব্যভাবনায় মুক্ত চিন্তার দিশা দেখাবে। 

প্রশ্ন: তরুণ প্রজন্মের জন্য কিছু বলুন...

তরুণদের একটা দল আমাকে খুব উজ্জিবীত করে। দেশ ও মানুষের প্রতি এদের দরদ আছে, দায় আছে। এরা নিয়ত আত্ম-অনুসন্ধানে সচল; কিন্তু সামগ্রিক অর্থে আমাদের সাহিত্যে একটা সঙ্কট চলছে। আমার হিসাবে এ সঙ্কট ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ভাষার সঙ্কট। বাংলাদেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া ইতিহাসে রয়ে গেছে অনেক তথ্যবিভ্রান্তি, অনেক বানোয়াট বয়ান। তাই ইতিহাসের পুনর্লিখন প্রয়োজন। তেমনি দরকার জাতীয় সংস্কৃতির একটি সর্বজনীন বয়ান। কবিতায় প্রয়োজন একটা নতুন কাব্যভাষা। নতুনরা অবিরাম সেই কাব্যভাষার খোঁজ করছেন। আর নানা নিরীক্ষায় আমাদের কবিতা হয়ে উঠছে পরস্পর সমপর্কহীন একাধিক আবেগের কোলাজ। কবিতার ফর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমি তাদেরকে বিনয়ের সাথে বলতে চাই সাহিত্যের মালমশলা ও নতুন কাব্যভাষার জন্য আমাদের জনসমাজের দিকে ফিরা উচিত। ইতিহাস, সংস্কৃতির পুনর্লিখনের কাজে হাত দেওয়া উচিত। তাহলে সাহিত্যও নতুন সমৃদ্ধির পথে এগুবো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh