খাদ্যশস্যের দাম সহনশীল রাখাই লক্ষ্য: আলী ইমাম মজুমদার

আলী ইমাম মজুমদার ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। তিনি মন্ত্রিপরিষদসচিব, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। আলী ইমাম মজুমদারকে প্রথমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এরপর তাকে সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। খাদ্যশস্য আমদানি, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ, মূল্য সহনশীল ও বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে সম্প্রতি সাম্প্রতিক দেশকালের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম ডি হোসাইন।

বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য সহনশীল রাখতে অন্তর্বর্তী সরকার কী উদ্যোগ নিয়েছে?  

খাদ্যশস্যের মূল্য সহনশীল পর্যায়ে রাখতে সরকার দেশে কিছু মজুদ করছে। এর উদ্দেশ্য দুটি। একটা হলো মৌসুমে ফসলের দাম কমে যায়, এর জন্য সরকার ক্রেতা হিসেবে মার্কেটে আসে। তাই সরকারের কাছে মজুদ থাকে। দ্বিতীয়ত, কৃষক ন্যায্যমূল্য পায়। আপৎকালে সেই খাদ্যশস্য মার্কেটে ইনজেক্ট করা হয়। এটা খাদ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখে। ওএমএসের মাধ্যমে আমরা যখন বিক্রি করছি, তখন মার্কেটের ওপর চাপ কমছে। মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এগুলো চলমান আছে এবং জোরদার করা হবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কোন কাজকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন?

আপনার পকেটে ১০ হাজার টাকা থাকতে পারে, কিন্তু খাদ্য না থাকলে আপনি দুই দিনও বাঁচবেন না, মরে যাবেন। কৃষক ফসল ফলায়, তাদের সবচেয়ে বড় অবদান। বেসরকারি খাত খাদ্যশস্য আমদানি করে, এটাকেও আমরা উৎসাহিত করি। কিছু ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারিভাবে আমদানি করে মজুদ রাখা হয়। পরে যেন আমরা মার্কেটে ইনজেক্ট করতে পারি। বেসরকারিভাবে খাদ্য আমদানির সব ট্যাক্স উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবেও আমদানির বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মূলত আমরা খাদ্যশস্যের মজুদ বাড়িয়ে দাম সহনশীল রাখাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। বর্তমানে দেশে চাল মজুদ সক্ষমতা ২২ লাখ টন। এ সক্ষমতা ৩০ লাখ টনে উন্নীতকরণে সরকার কাজ করছে। এ লক্ষ্যে এখানে এক লাখ টনের বেশি ধারণক্ষমতার গুদাম নির্মাণের কাজ চলমান। আশা করা যাচ্ছে, আগামী ৬-৭ মাসের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে।

আমন ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কী?

আমন ধান-চাল সংগ্রহের জন্য যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা ইনশাআল্লাহ অর্জিত হবে এবং সেই অর্জন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।

কৃষকরা কি ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন?

খাদ্য নিরাপত্তার সম্মুখ যোদ্ধা হলেন এ দেশের কৃষকসমাজ। তারা উৎপাদন বাড়াতে পারেন, সে জন্য যথাযথ প্রণোদনার ব্যবস্থা- তারা যাতে উন্নত ও যথাযথ প্রযুক্তি, স্বল্পমূল্যে কৃষি উপকরণ পেতে পারেন, সে লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আমাদের তথ্য দিয়েছে, উৎপাদন খরচ কত। পাশাপাশি কৃষকদের কত লাভ দেওয়া সম্ভব। সেটা বিবেচনা করে এবার গতবারের চেয়ে তিন টাকা বেশি দরে ধান ও চালের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যশস্য কেনার পরিকল্পনা কী?

দেশে জুলাই-আগস্টে বন্যার কারণে আমনে কিছুটা ফসলহানি হয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে, এ জন্য খাদ্য উৎপাদনে কিছু ঘাটতি হতে পারে। আমরা খাদ্য আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে এক লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। আলোচনায় আছে, ভিয়েতনাম থেকেও চাল আমদানি করার। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরকার ওই সব দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাল আমদানি করবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারত থেকে কীভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন?

আমরা বাণিজ্যকে রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলি না। ভারত থেকে চাল কিনলে তুলনামূলকভাবে খরচ কম পড়বে। এ জন্য দেড় লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া আছে। আমরা আশা করি, সে চাল দ্রুত আসবে। এ ছাড়া আমরা একক কোনো দেশের ওপর নির্ভর করব না। যেহেতু খাদ্যঘাটতি আছে, আমরা অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে তা পূরণ করব। আমরা সে চেষ্টা করছি।

খাদ্যপণ্য মজুদে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?

দেশে সাতটি সাইলো গুদাম নির্মীয়মাণ রয়েছে। এগুলোর প্রতিটিতে প্রায় ৫০ হাজার টন খাদ্যশস্য রাখা যাবে। এর মধ্যে দু-একটি সাইলো গুদাম এমন জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আগের সরকারের একজন মন্ত্রীর ইচ্ছায় টাঙ্গাইলের মধুপুরে ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সাইলো নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে মালপত্র আনা-নেওয়ার খরচ অনেক বেশি হবে। দাতাগোষ্ঠী ও সরকারি কর্মকর্তারাও রাজি ছিলেন না। সাধারণত এসব সাইলো নির্মাণ করা হয় নদীর পারে বা যেখানে ট্রেন চলাচল করে। কিন্তু টাঙ্গাইলের পশ্চিমে যমুনা নদী থাকলেও সাইলোটি এমন জায়গায় করা হয়েছে, সেখানে ট্রাক ছাড়া অন্য কোনো বাহনে মালপত্র পরিবহন করা যাবে না। ময়মনসিংহেও প্রায় একই অবস্থা। ময়মনসিংহ সাইলোতে পরে রেলপথ টানা হয়েছে। এগুলো ব্যবহারযোগ্য হলে মজুদ বাড়ানোর সুযোগ হবে।

দেশে বর্তমানে চাল-গমের চাহিদা কেমন? ঘাটতি পূরণে কী পরিমাণ আমদানি হচ্ছে?

আমাদের বছরে তিন কোটি ৭৫ লাখ টন চাল এবং ৭০ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। চাল উৎপাদনে দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে চালের ঘাটতি দেখা দেয়। তখন আমদানি করে খাদ্যঘাটতি মেটানো হয়। চলতি বছর ১০ লাখ টন গম উৎপাদন হয়েছে। ফলে বাকি ৬০ লাখ টন আমদানি করতে হয়েছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের বড় নেটওয়ার্ক আমদানি কাজে যুক্ত। খাদ্যপণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে চাল ও গমসহ কয়েকটি পণ্য আমদানির জন্য সরকার কর ও শুল্ক তুলে নিয়েছে। এতে বেসরকারি আমদানিকারকরা উৎসাহিত হচ্ছেন। অনেক দেশ কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত চাল-গম দেয় না, এমন নজিরও আছে। তাই আমাদের বিকল্প পথও খোলা রাখতে হয়। কোনো কারণে প্রতিশ্রুত চাল-গম না পাওয়া গেলে বিকল্প উৎস থেকে সেটা পূরণ করতে হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh