ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকে বুঝতে হবে: ফরহাদ মজহার

ফরহাদ মজহার। কবি, ভাবুক এবং পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী। প্রথাগত কোনো রাজনৈতিক দলে নেই; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক সব সময়ই। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, অন্তর্বর্তী সরকার, রাষ্ট্রক্ষমতা, ধর্মসহ নানা বিষয়ে ‘সাম্প্রতিক দেশকাল’কে দেওয়া দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে সবিস্তারে বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব অভিনেত্রী, লেখক ও শিক্ষক ফ্লোরা সরকার। 

বিগত সরকারের সময় আমরা দেখেছি ক্ষমতার প্রশ্নটি খুব বড় আকারে সামনে চলে এসেছিল। আপনার ২০০৬ সালে প্রকাশিত গণপ্রতিরক্ষা বইয়ের ভূমিকায় আপনি বলেছিলেন, ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকে বুঝতে হবে। এই কথাটার অর্থ কী?

এই কথাটাকে আপনি বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে পারেন। আমি যখন লিখছিলাম, তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আমার মাথায় ভর করেছিল- রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় ‘ক্ষমতা’ যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা রাজনৈতিক বর্গ সেটা আমরা খুব একটা খেয়াল রাখি না। ক্ষমতা কী? অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি বা রাজনীতির কোন পরিসরে কীভাবে ক্ষমতা তৈরি হয়? ক্ষমতা কি স্রেফ বল প্রয়োগের? নাকি চিন্তাচেতনা, আদর্শ, শিক্ষা, সামাজিক শৃঙ্খলা এবং তার ফল ও প্রয়োগ? সেখানেও কি ক্ষমতা সক্রিয়? কীভাবে সক্রিয়? এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

তা ছাড়া ক্ষমতা সম্পর্কে বাংলাদেশে আমাদের ধারণাটা অত্যন্ত প্রাচীন। অতিরিক্ত পুরোনো ও জীর্ণ। এই ধারণা এখন আসলে কোনো ব্যবহারে লাগে না। লাগে কি?

কেন প্রাচীন? ধরেন ষাটের দশকে বামপন্থি আন্দোলনের সময় আমরা ক্ষমতা বলতে কী বুঝতাম? আমরা রাষ্ট্রক্ষমতাই শুধু বুঝতাম। বল প্রয়োগ রাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একচেটিয়া ক্ষমতা আকারে মজুদ থাকে। ক্ষমতা বুঝি হাতুড়ি বা অস্ত্রের মতো। রাষ্ট্র একচেটিয়া তা ব্যবহার করে, আর কারো সশস্ত্র বল প্রয়োগের এখতিয়ার থাকে না। ক্ষমতা যেহেতু হাতে ধরে রাখা বলপ্রয়োগের হাতিয়ার, অতএব একবার হাতে পেলেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল হয়ে গেল। 

রাষ্ট্র কিংবা ক্ষমতা কোনোটাই এর দ্বারা বোঝা যায় না। কিন্তু এটাই তো আমরা বুঝতাম। এখনো বেশির ভাগ তরুণ এটাই বোঝে। রাষ্ট্রক্ষমতা হলো বলপ্রয়োগের হাতিয়ার মাত্র। আমাদের বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা এটাই আমাদের শিখিয়েছিল। লেনিনের মাধ্যমেই আমরা জেনেছি যে রাষ্ট্র হলো স্রেফ বল প্রয়োগের হাতিয়ার। 

কিন্তু মানুষ জন্তু-জানোয়ার নয়, যে স্রেফ বলপ্রয়োগ দ্বারা তাদের শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং সামাজিক ও সামষ্টিক অভিপ্রায় যেমন আছে তেমনি নীতি-নৈতিকতা, বিশ্বাস, শিক্ষা ও সংস্কৃতিও আছে। সেই নীতি-নৈতিকতার পরম নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তি (Ethical Life) রূপে রাষ্ট্র হাজির হয়- হেগেলের এই তত্ত্ব ভুল সেটা আমরা এঙ্গেলস এবং ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ পড়ে মুখস্থ করেছি। আসলে কি ভুল? মানুষের কি শুধু রক্তমাংসের চাহিদা! জীবের অতিরিক্ত তার কোনো ইচ্ছা বা অভিপ্রায় কি নাই? আছে। ফলে আমরা খুবই কাঁচা অর্থে ‘ক্ষমতা; বুঝেছি। আমরা শুধু বল প্রয়োগের দিকটা দেখেছি, কিন্তু কীভাবে আমাদের ইচ্ছা, অভিপ্রায়, কামনা, বাসনা ইত্যাদিকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা তৈরি করা হয় সেটা আমরা দেখিনি বা দেখি না। তাই রাষ্ট্রক্ষমতা শুধু বল প্রয়োগের হাতিয়ার না কিংবা ক্ষমতা মানেই কাঁচা বল প্রয়োগ নয়- ক্ষমতার এই দিকটা আমাদের বোঝাবুঝির বাইরে থেকে গেছে। 

ধরুন, আমরা কোনো সেমিনার বা কনসোর্টিয়ামে বল প্রয়োগ করে কি মানুষকে আনি? না, আনি না। মানুষ যখন পীর-ফকির-দরবেশের কাছে যায়, তারা কি র‌্যাব পাঠিয়ে তাদের আনেন? মানুষ যখন ওয়াজ শোনে তখন কেন ওয়াজিয়ানের পক্ষে অনেকে মরতে তৈরি হয়ে যায়? যদি বল প্রয়োগই ক্ষমতার প্রধান উপাদান হতো তাহলে মাস্তানি বা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের জন্য পুরা সময় ব্যয় না করে মার্কস, এঙ্গেলস কিংবা লেনিনকে এত গাদা গাদা বই লিখতে হলো কেন? 

আমরা তাদের লেখালেখির খবর জানতাম। মতাদর্শিক লড়াই-সংগ্রামের কথা বলতামও বটে, কিন্তু মতাদর্শিক সংগ্রাম বিদ্যমান ক্ষমতার বিপরীতে জনগণের পক্ষে ক্ষমতা তৈরির প্রক্রিয়া, এটা আমরা পুরোপুরি বুঝতাম কি? মতাদর্শিক সংগ্রামের কথা আমাদের মুখস্থ থাকলেও মতাদর্শিক লড়াইয়ের দার্শনিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য আমাদের কাছে পরিষ্কার ছিল না। ফলে আমাদের রাজনৈতিক চর্চায় গায়ের জোর, সশস্ত্রতা কিংবা বলপ্রয়োগ যতটা মুখ্য বিষয় ছিল, মতাদর্শিক সংগ্রাম সেই তুলনায় মুখ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি।

মতাদর্শ ক্ষমতার দ্বারা যেমন তৈরি হয়, তেমনি ক্ষমতা তৈরির প্রক্রিয়াও বটে। ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মতাদর্শ, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ইত্যাদি। অর্থাৎ জ্ঞানচর্চা ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। এই যে ইডিওলজি (বা মতাদর্শ) তৈরি, জ্ঞানচর্চা, পর্যালোচনা ইত্যাদি যে ক্ষমতা উৎপাদন করে, এটাকে আপনি বলতে পারেন বল প্রয়োগের বিপরীতে একটা সফট পাওয়ার। ক্ষমতাকে এভাবে বুঝতে আমাদের সময় লেগেছিল। তাই বলেছিলাম ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকে বুঝতে হবে, কাঁচা বল প্রয়োগ হিসেবে বুঝলে চলবে না। কিংবা একে স্রেফ অর্থনীতি কিংবা শ্রেণি-সংগ্রামের সাংঘর্ষিক মডেল দিয়েও বোঝা যাবে না। তাই মতাদর্শিক সংগ্রামও যে শ্রেণিসংগ্রাম- এটা বুঝতে আমাদের সময় লেগেছে।

তো সফট পাওয়ার নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন লুই আলথুজার, ওনার ‘Ideology and Ideological State Apparatuses (Notes Towards an Investigation)’ একটা বিখ্যাত প্রবন্ধ। তিনি সেখানে আর্গুমেন্ট করেন, শিক্ষাব্যবস্থাও রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যেখান থেকে ইডিওলজি তৈরি হয়, সমাজের বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মতাদর্শ বানানো হয়। শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।

মানে ক্ষমতাসীনরা যেভাবে শিক্ষা দেয়, আপনি সেভাবেই ক্ষমতার সম্পর্ক বজায় বা পুনরুৎপাদনের জন্য আচরণ করেন। তাহলে শিক্ষা কী? শিক্ষাও বল প্রয়োগের হাতিয়ার। কেন? শিক্ষা আমাদের স্বাভাবিক বা সহজাত বৃত্তির বিকাশ ঘটতে দেয় না। বরং বাইরে থেকে জবরদস্তি করে শিক্ষার্থীর কামনা-বাসনা ও আকাঙ্ক্ষাকে সমাজের বিদ্যমান ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কারিগরি, ক্ষমতার সম্পর্ক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের নাম শিক্ষাব্যবস্থা। একে বলা যায় Coercive Reconfiguaration of Desire–জোরজবরদস্তি করে আমাদের সহজাত কামনা-বাসনা ও ইচ্ছা-অভিপ্রায়কে সমাজের বিদ্যমান উৎপাদন ও ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্যে নাটবল্টুর মতো ফিট করে নেওয়ার কারখানা, নিয়ন্ত্রণের কারিগর। আপনার মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আছে, আপনাকে যদি আমি ছেড়ে দিতাম শিক্ষা ছাড়া, আপনি প্রাকৃতিকভাবে, নিজস্ব ফিতরাত অনুযায়ী, নিজস্ব স্বভাব অনুযায়ী জগতের সঙ্গে সম্পর্ক করতেন, জানতেন, বুঝতেন। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা কী করে? আপনাকে সেটা করতে দেয় না। শিক্ষা বিদ্যমান সমাজের যে বিভিন্ন শ্রেণি আছে, স্বার্থগোষ্ঠী আছে, সেই অসম শ্রেণি সম্পর্ক পুনরুৎপাদন করে, ক্ষমতাসীন শ্রেণির ক্ষমতা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে। সেই ক্ষমতা শ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্যই শিক্ষার কারখানায় আপনাকে বানায়, সেভাবে তৈরি করে। নরম কাদামাটি দিয়ে যেভাবে কুমার তার ইচ্ছা মতো মৃৎপাত্র তৈরি করেন, সেভাবে শিক্ষা আমাদেরও তৈরি করে। ওই যে সেই গানটার মতো, ‘একখান চাবি মাইরা দিচ্ছে ছাইড়া জনম ভইরা’র মতো। শিক্ষাও ঠিক ওই রকম। স্টেট বা সমাজ আপনাকে যেভাবে চায়, শিক্ষাও আপনাকে সেভাবে চাবি মেরে ছেড়ে দেয়। আপনি ঠিক সেভাবে ঘুরছেন।

তাহলে বুঝতে হবে এডুকেশন, মতাদর্শ, চিন্তা ইত্যাদি ক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্র। অথচ এগুলো সম্পূর্ণভাবে আমাদের রাজনৈতিক আলোচনায় উপেক্ষিত। এমনকি বামপন্থি আন্দোলনের সময় আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম, বামপন্থার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল মতাদর্শিক সংগ্রাম। কিন্তু মতাদর্শিক সংগ্রামের বিষয়টি অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে জনগণের পক্ষে ক্ষমতা তৈরির ব্যাপারটা আশির দশকের পর থেকে হারিয়ে গেছে। আমরা পুরানা মাওবাদী বিপ্লবীরা কিছুটা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে এখনো বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই যে আসলে জনগণের পক্ষে ক্ষমতা তৈরির লড়াই- এই প্রাথমিক বৈপ্লবিক শিক্ষাটা প্রাণপণ ধরে রাখার চেষ্টা করছি। এখন আপনি খুব কমই রাজনৈতিক পরিসরে মতাদর্শিক সংগ্রাম দেখবেন।

একটা চিন্তা আছে, যেমন সেক্যুলারিজম বনাম ধর্ম। আমাদের সমাজে মনে করা হয়, সেক্যুলারিজম এবং ধর্ম বুঝি দুটো আলাদা জিনিস। একটার সঙ্গে আরেকটার বিরোধ চলছে। আসলে তো তা নয়। মানুষ যখন বাজরে যায় সে কি কোরআন-হাদিস পকেটে করে নিয়ে যায়? না। তারও তো একটা সেক্যুলার বা ইহলৌকিক জীবন আছে। অন্যদিকে যে লোকটা নিজেকে সেক্যুলার মনে করে, তারও তো একটা মতাদর্শ আছে, তার মতাদর্শই তো তার ধর্ম। সেই ধর্মের আকিদাও আছে। কারণ তার চিন্তা অনুযায়ী তার পারিবারিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক জীবন পরিচালিত হয়। কোরআন শরিফ যে পড়ে তারও একটা মতাদর্শ আছে। দুটোই মতাদর্শ, দুটোর মধ্যেই ধর্ম আছে, চিন্তা আছে, যুক্তি আছে- আলাদা কিছু না। প্রত্যেকেই তার অনুমান, বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি দ্বারা কাজ করে। ফলে মতাদর্শিক আন্দোলন বা সংগ্রামটা বিপ্লবী বা আর্থ-সামাজিক ও ক্ষমতার রূপান্তরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। অথচ মতাদর্শিক সংগ্রাম, অর্থাৎ ক্ষমতা নির্ণয়ের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার রাজনৈতিক গুরুত্ব আমাদের সমাজ থেকে একদম হারিয়ে গেছে। এই উপলব্ধি থেকেই আমি ধর্মের পর্যালোচনা, মতাদর্শিক পর্যালোচনা- এসব শুরু করেছি।

যারা নিজেদের বাম, মার্কিস্ট বলে দাবি করে, তারা আদৌ বাম বা মার্কিস্ট কি না সন্দেহ আছে। নইলে বামদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবক্ষয় এত ভয়াবহ রূপ নিল কেন?

এখন কথা হলো, ক্ষমতা মানে হাতের মোয়া না যে আপনি পাবেন আর খাবেন। মতাদর্শিক লড়াই-সংগ্রাম অর্থাৎ জ্ঞানোৎপাদন ও জ্ঞানোৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই কিন্তু ক্ষমতা তৈরি হয়, ক্ষমতার রূপ বদলায়। মিশেল ফুকো এ বিষয়ে চিন্তার নতুন দিগন্ত হাজির করেছেন। ফলে আপনি যে প্রশ্নটা করেছিলেন, ক্ষমতাকে ক্ষমতার জায়গা থেকে বুঝতে হবে এই চিন্তাটাও এখন অত্যন্ত প্রাচীন ধারণা। ক্ষমতা যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বর্গ সেটা আমাদের নতুন করে চিন্তা করতে হবে। মতাদর্শ, ক্ষমতা, শিক্ষাব্যবস্থা, ইডিওলজিকাল স্টেট অ্যাপারেটার্স ইত্যাদি ভালো করে পর্যালোচনা করবার ক্ষমতা আমাদের বৃদ্ধি করতে হবে।

এবার আমরা একটু অন্য জায়গায় যাই এবং এটা হলো ফুকোর বক্তব্য। ফুকো বলেছেন, দেখুন এই যে কাছাখোলা বাজারব্যবস্থা, নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এখন এসেছে এবং একই সঙ্গে আমরা যে প্রতিনিয়ত মতাদর্শিকভাবে লড়াই করছি- এসব নতুন ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরি করে। তার আগে কারাগারের কথা তিনি বলেছেন। কারাগারে আপনি লোক ধরে নিয়ে যাচ্ছেন, রাখছেন কেন? যাতে সে সমাজ বিশেষত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহ বা অপরাধ করতে না পারে। তাকে পানিশমেন্ট আপনি দিচ্ছেন প্রকাশ্যে। কিন্তু প্রকাশ্যে শাস্তি দিচ্ছেন কেন? যাতে ক্ষমতার বিরুদ্ধে, রাজা বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ লড়াই না করে। এই শাস্তি শাসিতদের বুঝিয়ে দেয় যে রাজাকে মারলে কী দশা হবে। ফুকোর ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশমেন্ট বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে দেখেছেন কীভাবে হাত-পা বেঁধে টেনে নিতে নিতে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এটা করছে যাতে আপনি ক্ষমতার বিরুদ্ধে কিছু না বলেন। এটা দেখাচ্ছে যে রাজাকে মারলে তোমার কী দশা হবে! ওই নৃশংস হত্যা দৃশ্য দেখলে আপনি রাজার বিরুদ্ধে আর কিছু বলবেন না। কিন্তু মজা হচ্ছে, এটা দেখার পর দেখা গেল, আসলে যে ইফেক্টটা সমাজে ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে, সেই ইফেক্টটা হচ্ছে না, বরং উল্টা হচ্ছে। বরং এই নৃশংসতা জনগণকে উল্টা রাজার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলছে। এরপর তারা শাস্তি দেওয়া শুরু করল গোপনে, কারাগারের ভেতরে। এই যে রাষ্ট্র বা রাজা নিজেকে রক্ষা, ক্ষমতা চর্চার নতুন নতুন পদ্ধতি বের করল, তার ইতিহাস বোঝাও ক্ষমতার রূপ নির্ণয়ের মধ্যে পড়ে। এটাও কিন্তু ক্ষমতার একটা আচরণ, ক্ষমতা কী করে নিজেকে সক্রিয় রাখে, বজায় রাখে, সেসব বোঝার পথ।

ফলে ক্ষমতা বলতে আমরা যে পুরোনো ধারণা পোষণ করি, রাষ্ট্রের মধ্যেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে, পুরোনো লেনিনীয় ধারণা- এই ধারণাটার উপযোগিতা শেষ হয়ে গেছে কিংবা আগের মতো নেই। ক্ষমতা এখন কীভাবে চর্চা করা হয়, তার রূপ কেমন ইত্যাদি আমাদের নতুনভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। এটাই আমি বলতে চেয়েছি। আমি যখন বইটা লিখেছিলাম তখন মার্কসবাদীদের জন্যে লিখেছিলাম, যাদের নিয়ে আমি ভাবতাম এবং ধরেই নিতাম এরাই বিপ্লবটা করবে। এরা বিপ্লবের কর্তা। ফলে তারা যদি ক্ষমতাটা বোঝে তাহলে মতাদর্শিক লড়াইটা তারা করবে। 

এটা গেল ১ নম্বর। ২ নম্বর হলো, ক্ষমতা যে আগের মতো নেই, শুধু রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত না, এটা নানাভাবে সমাজে ছড়িয়ে আছে। ফুকো বলছেন, আপনি যে কর্তা, যে কর্তাটা আপনার মধ্যে তৈরি হচ্ছে, যেমন আমি বা ফ্লোরা নামে যে কর্তা তৈরি হচ্ছে, এই কর্তাটাও তৈরি করে পুঁজি, ক্ষমতা। মার্কস বলেছেন, পুঁজি আর ফুকো বলেছেন ক্ষমতা। এখানেই পার্থক্য। পার্থক্যটা কিন্তু খুব বড়। তবে ফুকো কিন্তু বলেননি, মার্কসের আর্থ-সামাজিক ব্যাখ্যাটা ভুল। ফুকো বলেছেন, আমারটা সাপ্লিমেন্ট। আমারটা বুঝলে আমি ক্ষমতাকে ভালো করে বুঝব। মানে একদিকে পলিটিকাল ইকোনমি সে তার নিজস্ব গতিতে একটা ক্ষমতার সম্পর্ক তৈরি করছে, যাকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বা উৎপাদন সম্পর্ক হিসেবে বুঝতে হবে, অন্যদিকে তাকে ক্ষমতা তৈরি ও বহাল রাখার জন্য জ্ঞানোৎপাদনের পরিসর থেকেও বুঝতে হবে। 

আমাদের সমাজের প্রত্যেকে স্বাভাবিক মনে করে যে আরেকজন লোকের কাছে আপনি নিজের শ্রম বা শ্রমশক্তি বিক্রি করছেন। এটা কিন্তু অস্বাভাবিক কেউ মনে করছে না। অথচ নিজের শ্রম অন্যের কাছে বেচে দেওয়া যে দাসত্ব, জীবনের কিছু সময়ের জন্য অন্যের দাস হওয়া- এটা আমরা বুঝি না, ধরতে পারি না। এটা দাসত্ব। ফলে মার্কস যেটা বলেছেন, ফুকো কিন্তু সেটাই বলেছেন। মানে আপনি যেটাকে স্বাভাবিক মনে করে কারখানায় যাচ্ছেন, স্যুট-টাই পরে কোম্পানির অধীনে কাজে যাচ্ছেন, আপনি ঠিকই ক্ষমতাসীনদের হুকুমের দাস বা র‌্যাব হয়ে গুলি করছেন ইত্যাদি। অর্থাৎ ক্ষমতা কিন্তু এভাবেই ফাংশন করে। সে কিন্তু আপনার মধ্যে একটা কর্তা তৈরি করে, যে কর্তা ক্ষমতার অসম সম্পর্ক উৎপাদন করে। 

এই যে ক্ষমতা বা ক্ষমতার অসম সম্পর্ক উৎপাদন, ক্ষমতাকে নতুন করে পর্যালোচনা বা বিচার- প্রশ্ন হলো, এই নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আমরা তাহলে কীভাবে মোকাবিলা করব? নতুন রাজনীতি বা মানুষের সঙ্গে মানুষের নতুন সম্পর্ক তৈরির কারবার প্রধান বিবেচ্য বিষয় বা নতুন রাজনীতির সম্ভাবনা এখানে নিহিত। এর আগে এই বাস্তবতা আমরা আগে কখনো বুঝিনি, তাই দেখিওনি। আগে আমরা বুঝতামও না। তাহলে আমরা যদি নতুন ক্ষমতা তৈরি করতে পারি, যেটাকে আমি বলি, ‘গণক্ষমতা’ অর্থাৎ সামষ্টিক ক্ষমতা, কালেকটিভ উইল, যেটা রুশোর জেনারেল উইল থেকে এসেছে, তাকে নতুন করে পর্যালোচনা করতে শিখতে হবে। এমনকি আমাদের পুরানা টুকলিফাই সংবিধানে কোটেশান মার্কা বাক্য বলা হয়েছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’ তো সংবিধানের এই প্রকার ধারণার মানে কী? জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিকে কীভাবে চিনব? এটাই তো রাজনীতি। তাহলে এই রাজনীতিটা যদি আপনি করতে চান, কীভাবে করবেন? এই ২০২৪ সালে, এটাই হচ্ছে আমাদের প্রধান ইস্যু। 

আমার ‘গণপ্রতিরক্ষা’ বের হয়েছিল ২০০৬ সালে। তখন থেকে আমি বলে আসছি নতুন গণরাজনীতিটা আমরা কীভাবে করব? আমরা যদি নতুন গণরাজনৈতিক ধারা গড়ে তুলতে চাই, গণরাজনৈতিক ক্ষমতা বানাতে চাই, তাহলে আমাদের রাজনৈতিক নীতি ও কৌশল কী হবে বা পুরোনো ভাষায় বলতে পারেন, আমাদের রণনীতি ও রণকৌশল কী হবে? এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘গণপ্রতিরক্ষা’ বইটা লেখা হয়েছিল। ক্ষমতা সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করার জন্যে।


এখান থেকে আরেকটা প্রশ্নে আমরা যেতে পারি, একদিকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে সংবিধান, আইন, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যদিকে এই শৃঙ্খলাকে যাতে বিশৃঙ্খল করা না হয়, সেটা মোকাবিলা করার জন্যে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের এই দুই কাজের মধ্যে দ্বন্দ্বটা কোথায়?

আপনার কথায় বোঝা যাচ্ছে সংবিধানকে প্রথমে আনতে হবে। তাহলে ছোট একটা প্রশ্ন করি, সংবিধানকে প্রথমে আনতে হবে কেন? আপনি তো স্বাধীন। আপনাকে সংবিধান মানতে হবে কেন? আপনাকে যদি প্রথমেই শেখানো হয়, সংবিধান পবিত্র কোরআন শরিফের মতো। তাহলে যারা পবিত্র সংবিধান বলে, তাদের সঙ্গে তো ধর্মবাদীদের কোনো পার্থক্য নেই। একই কথা। একজন বলছে কোরআন হলো সংবিধান, আরেকজন বলছে সংবিধান হলো কোরআন। এটাই পার্থক্য। এই যে আমরা একটা ধর্মতাত্ত্বিক স্তরে বাস করছি, এটা তো অতিক্রম করতে হবে, আমরা কি এই ধর্মতাত্ত্বিক স্তর অতিক্রম করতে পেরেছি? আমরা মুখে বলছি, সেক্যুলার, কিন্তু আসলে আমাদের চিন্তা-চেতনা রাজনীতি সবই ধর্মতাত্ত্বিক অর্থাৎ থিওলজিকাল। 

দেখুন, এখন অনেকে বলেন, সংবিধান ছাড়া নাকি শাসন করা যায় না। তাহলে হুজুররা কী অন্যায় করেছে? তারা বলে, কোরআন দ্বারা শাসন করবে। একই তো কথা? তাহলে কী করতে হবে? কাজটা হচ্ছে মানুষের যে বিকাশ ঘটছে, তাকে যদি বিকশিত হতে দিতে চান, তাহলে স্বভাবতই আপনাকে বলতে হবে, জনগণ তার চিন্তা-চেতনার দ্বারা যখন নতুনভাবে ভাবতে পারে, কল্পনা করতে পারে, সেই আলোকে সে নতুন করে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করবে। তাহলে জনগণই সার্বভৌম, কোনো লিখিত গ্রন্থ বা কেতাব নয়। এই দাবি ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, কারণ কোরআনুল করিম কখনই নিজেকে ‘আইন’ বা ‘বিধান’ বলে দাবি করেনি, কোরআন এসেছে মুত্তাকিনদের হেদায়েতের জন্য। অর্থাৎ জ্ঞানী ও মুত্তাকিনরা সব সময়ই কোরআন পাঠ ও রুহানি প্রেরণায় পর্যালোচনা করতে পারেন এবং মানুষের কর্তব্যকর্ম নির্ণয়ের জন্য হেদায়েত লাভ করতে পারেন। তার মানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নতুনভাবে নির্ণয় করা যেতেই পারে। আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নতুন হতেই পারে। আজ থেকে ১৯৭২ সালে যে সংবিধান আমরা লিখেছি, এখন ২০২৪ সালে তাতে কাজ হবে না, আমাদের নিজেদের নতুনভাবে গঠন করতে হবে। ফ্লোরার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন হবে, এটা তো আমার আলোচনার বিষয় না। ফ্লোরা আমার আপন মায়ের পেটের বোন না, কিন্তু আমি তাকে বোনের মতো দেখছি, এটা এথিকাল বা নৈতিক সম্পর্ক, আমাকে এভাবেই ধর্ম শেখানো হয়েছে। ফ্লোরা তোমার বোন, সে তো রক্তের না, কিন্তু তোমার বোন। তার সঙ্গে আমার আচরণ বোনের মতোই হতে হবে। তাহলে এসব আমি শিখি কোত্থেকে? সমাজের নীতিনৈতিকতা, শিক্ষাব্যবস্থা, আদর্শ থেকে শিখি। 

আচ্ছা, আইন আমাকে কী বলে? যদি তুমি ফ্লোরাকে খারাপ কাজ করাও বা তার প্রতি খারাপ দৃষ্টিতে তাকাও বা খারাপ আচরণ করো, তাহলে তোমাকে শাস্তি দেওয়া হবে। এখন দেখেন নীতি আর আইন কিন্তু পাশাপাশি চলে। আবার ফকিররা কী বলবে? তুমি খারাপভাবে তাকাবাই বা কেন? তোমার স্বভাবটাই হতে হবে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শের ভিত্তিতে। কেন? কারণ, যদি তিলার্ধ নাই ব্রজ ছাড়া কে তবে মথুরাতে রাজা হলো? ব্রজধামের বাইরে বা ব্রজধামের অতিরিক্ত মথুরা এলো কোত্থেকে? অর্থাৎ বৈষ্ণবরা যদি প্রেমের দ্বারা বা প্রেমের ভিত্তিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নির্ণয় সম্ভব বলে মানে তাহলে কৃষ্ণকে আবার মথুরার রাজা ভাবতে হবে কেন? মথুরাতে কৃষ্ণের আবার রাজা হওয়ার দরকার কী? অর্থাৎ রাজার দরকার নেই, আমার রাষ্ট্রের দরকার নেই, আমাদের দরকার সমাজ। এটাই হলো ফকিরি রাষ্ট্রতত্ত্ব। কারণ মানুষের সঙ্গে মানুষের ভালোবাসা ও প্রীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব।

রাষ্ট্র মানেই তো একটা পরজীবী, একটা প্যারাসিটিক প্রতিষ্ঠান। তাহলে এই প্যারাসিটিক প্রতিষ্ঠানকে আমরা ফেলে দিয়ে সত্যিকার একটা সমাজে ফিরে আসব। এটাই একালের প্রধান রাজনীতি। আমরা তো প্যারাসাইট নিয়ে সমাজ চালাতে পারব না। তাহলে আমরা কীভাবে পারব? যদি আমরা আইনকে ধীরে ধীরে নীতি-নৈতিকতার জায়গায় নিয়ে এসে নিজেদের স্বভাবের অন্তর্গত করতে পারি। আপনার মনের মধ্যে যদি পুলিশ থাকে, বাইরের পুলিশ তো আর আপনার লাগবে না। 

আপনার গণ-অভ্যুত্থান ও গঠন বইতে যাকে আপনি বলেছেন প্রাকৃতিক আইন?

প্রাকৃতিক আইন তো আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। গাছে ফুল ফুটছে, ফল ধরছে, গাছ কেটে ফেলা ঠিক না- সন্তানকে ভালোবাসতে হবে, মাকে ভক্তি করতে হবে, বাবার কথা শুনতে হবে, এসব আমরা প্রাকৃতিকভাবে শিখেছি। 

কিন্তু আমি যখন স্বাধীন হয়ে গেলাম, পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, আমি তো ব্যক্তি এখন। আমি তো এখন আর প্রাকৃতিক আইন দিয়ে চলি না। ছেলেমেয়েদের যখন বিয়ে দেন, মেয়েরা তাদের স্বামীর মা-বাবার সংসারে থাকতে চায় না। আমাদের সময়ে কিন্তু থাকত। এটাকে তারা স্বাভাবিক বলে মেনে নিত। কিন্তু বর্তমানের আধুনিক মেয়েরা বলে, আমি তো স্বাধীন, স্বামীর মা-বাবার সঙ্গে থাকব কেন, তাই বেশির ভাগ সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা কিন্তু এখনো মা-বাবার প্রতি অনুগত। হয়তো সম্পত্তিতে ছেলের প্রধান অধিকার, সেটা কারণ। কিন্তু মেয়েরা স্বাধীনভাবে তার স্বামীর সংসারে থাকতে চায়। এটা কি অন্যায়? না অন্যায় না। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সমাজে এটাই ঘটতে বাধ্য। এটাই যদি ঘটে, তাহলে আমাকে সাপ্লিমেন্ট দিতে হবে। অর্থাৎ মা-বাবার প্রতি নীতি-নৈতিকতার দায়টা কীভাবে আমরা মেটাব? আগে কী করতাম? একসঙ্গে থাকতাম। একান্নবর্তী পরিবারে- বড় ভাই যা আয় করত, তা দিয়ে সংসার চলত, ছোট ভাইকে পড়াচ্ছে, এই যে প্রাকৃতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে পারিবারিক গার্হস্থ্য অর্থনীতি চলল, তা এখন আর নেই, ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভেঙে দেওয়ার পর এখন দুটি জিনিস লাগবে- একটা হলো স্বাধীন ব্যক্তির বিকাশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নৈতিকতা বা এথিক্স। নৈতিক শিক্ষাকে আমরা ধর্ম শিক্ষাও বলতে পারি।

শুধু ধর্ম শিক্ষা কেন? ধর্ম ছাড়াও তো সাধারণ নীতি-নৈতিকতা আছে?

নৈতিক শিক্ষা মানেই ধর্ম শিক্ষা। আমরা যদি বিভ্রান্ত না হই, বলতে পারি ধর্ম মানেই আত্মার বিষয়, আত্মার যত্ন। অন্যদিকে শরীরের যত্ন করে ইকোনমি। দারুণ ব্যাপার! আত্মার যত্নের জন্যে ধর্ম আর শরীরের যত্নের জন্য অর্থনীতি।

এই দুটোকে মেলাতে হবে। ধরেন, আপনি ধর্মকে চাইছেন না। পুরোনো ধর্মের বিবর্তন ঘটছে, আগে প্রস্তাবনাগুলো ছিল ধর্মতত্ত্ব আকারে, ধর্মীয় আইন আকারে, এগুলোকে আপনি ক্রিটিক করবেন। তার মর্মশাঁসটা কী? ধর্ম আসলে কী বলতে চেয়েছে? এটাকেই আমরা বলি মার্ক্সবাদী ক্রিটিক। 

আপনি বাদাম খান? বাদাম কীভাবে খান? ছিলে তারপর খান। ওপরে একটা খোসা আছে না? খোসাটা ভেঙেই তো খান, তাই না? তো ধর্মতত্ত্বের মধ্যে দর্শনটা ওই খোসা দ্বারা আবৃত। মার্কস বলছেন, খোসাটা ভাঙ্গ। দেখবে ভেতরে ভাবের লীলা কি চমৎকার! অর্থাৎ মানুষের এথিকাল জীবন, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় জীবনটা ধর্ম ওই বাদামের খোসার ভেতরে ধরে রেখেছে। এটাকে নষ্ট করা যাবে না। নীতি-নৈতিকতা ছাড়া আপনি চলবেন কী করে? তাহলে পুঁজিতন্ত্রই আপনার ওপর শাসন করবে। আপনি একটা কমোডিটি বা পণ্য হয়ে যাবেন, আপনাকে সে ব্যবহার করে কমোডিটি হিসেবে। সে যেভাবে অন্যান্য পণ্যকে ব্যবহার করে, ঠিক সেভাবে পুঁজি আপনাকেও ব্যবহার করে। 

কয়েক দিন পরে মেয়েরা বলবে সন্তান চাই না। এটা বলা তার অধিকার আছে। ব্যক্তি অধিকার, পুঁজিতান্ত্রিক বা বুর্জোয়া সমাজে এটাই পরম ধর্ম। তাহলে সন্তান উৎপাদন কীভাবে করবেন? টেস্টটিউবে? আচ্ছা এটাও মেনে নিলাম। কারণ এটা নারীবাদীরা দাবি করেছে। আমি কিন্তু নারীবাদীর পক্ষে বললাম। কিন্তু একটা মেয়ে যখন বলে আমি সন্তান চাই না, তার তো এটা বলার অধিকার আছে। শুধু সেটাই না। আজকাল তো সেক্স পরিবর্তন করতেও চাচ্ছে।

এটাও তার ব্যক্তি অধিকার। আপনি তো তাকে ফেরাতে পারবেন না। তাহলে এই পথটাকে আপনি ফেরাতে পারবেন কী দিয়ে? ব্যক্তিতন্ত্র প্রবল হয়ে গেছে। আমার মধ্যে ‘আমি’ এসে গেছি। আপনি কি মনে করেন অতীতে সমকামী ছিল না? অবশ্যই ছিল। আমাদের গ্রামে যখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতাম-খেলতাম, আমাদের দাদা-নানারা কিছু কিছু ছেলের সঙ্গে মিশতে দিত না। কিন্তু এটাকে তারা বিরাট কোনো ব্যাপার বানিয়ে ফেলত না। কেন বানাত না? প্রথম কথা হলো, প্রেম কোনো ছেলের সঙ্গে ছেলের হতেই পারে কিংবা মেয়ের সঙ্গে মেয়ের। ইসলামে তাররিজি আর রুমির প্রেমের কথা আমরা জানি। আমাদের নবীজির সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক কী ছিল? হাবিব ছিল। প্রেম ছিল। এটা তো সমকামি না। প্রেম তো ঐশ্বরিক ব্যাপার। লাভ তো লিঙ্গ মানে না। কিন্তু এখন যে সমস্যাটা হচ্ছে সেটা হলো, আপনি প্রেম করছেন, কিন্তু আপনি আবার দাবি করছেন সন্তানও বড় করবেন। সন্তান যখন বড় করছেন, তখন বলছেন আপনি ফ্যামিলিও চান। কিন্তু আপনি প্রেমও করতে চান। এখানেই কন্ট্রাডিকশন। 

আপনি কী করছেন, টেস্ট টিউবে সন্তান ধারণ করছেন বা অন্যের সন্তানকে অ্যাডপ্ট করছেন। ওটা তো তার সন্তান। তোমাকে তো আল্লাহ তৈরি করে নাই সন্তান করতে। এখানে খুব কঠিন প্রসঙ্গ তুলছি আমরা। ব্যক্তিতান্ত্রিক জগতে অর্থাৎ বুর্জোয়া গণতন্ত্রে ব্যক্তিটা মুখ্য, সমাজটা গৌণ। সমাজটা গৌণ হলে ব্যক্তি সব সময় সমাজকে বাধা মনে করে। যেমন- কাল থেকে যদি মেয়েরা দাবি করে আর সন্তান উৎপাদন করবে না। অথবা এটা বাদ দেবে, কথাটা হয়তো পুরুষতন্ত্র হয়ে যাবে। কাল থেকে যদি ছেলেরা দাবি করে এরপর থেকে তারা বীর্য পতন ঘটাবে না, বীর্য দান করবে না, তাহলে প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। অর্থাৎ ছেলেরও একটা দাবি আছে। অথবা একটা ছেলে হয়তো অসুস্থ অথবা জমিতে কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে এবং সেই জমির যে সয়াবিন তেল খাবেন, তার দ্বারা একটা অটিস্টিক বাচ্চা উৎপাদন হবে। এখন আপনি কি অটিস্টিক বাচ্চা চান নাকি সুস্থ বাচ্চা চান? এটা যদি আপনি বুঝে থাকেন, তাহলে প্রাচীনকালে অদ্ভুত কিছু নিয়ম ছিল, যেমন- কোনো ব্রাহ্মণ যদি রুগ্ণ থাকত, সন্তান উৎপাদনে অক্ষম থাকত তাহলে ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদন করাটা বৈধ ছিল। অর্থাৎ তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষকে দিয়ে সন্তান উৎপাদন করাত। নিৎসের যে কনসেপ্ট ভালো প্রজাতি তৈরি করা, সেখানেও এটা আছে। 

এগুলোকে তো আপনার ফেলে দিলে চলবে না। এথিক্যালি শুনতে খারাপ লাগে। তোমার স্ত্রী অন্যের কাছে যাবে কেন? কিন্তু একটু খেয়াল করলে বুঝবেন, বিষয়টি সমগ্র মানুষের জন্য। স্বভাবতই আপনাকে চিন্তা করতে হবে, আপনি কীভাবে সুস্থ, হেলদি বাচ্চা তৈরি করবেন। যদি সুস্থ বাচ্চা তৈরি করতে না পারেন, তাহলে একটা প্রজাতি তো কিছুদিন পরে ধ্বংস হয়ে যাবে। তার বুদ্ধিমত্তা, শারীরিক বিকাশ কিছুই ঘটবে না। তারা দুর্বল জাতিতে পরিণত হবে। তাহলে দেখতে পারছেন, এথিক্স এবং ইকোনমিক্স ও এথিক্স এবং বায়োলজি হাত ধরাধরি করে চলে। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটাকে নিয়ে চলতে পারবেন না। ব্যক্তি কতটুকু স্বাধীন, এটা যেমন সমষ্টি দ্বারা নির্ধারিত হয়, তেমনি সামষ্টিকতা কতটুকু সত্যিকার অর্থে সামষ্টিক এটা নির্ভর করে সে (সমাজ) কতটুকু ব্যক্তিস্বাধীনতা দিয়েছে। কারণ আগের মতো প্রাকৃতিক দৃষ্টিতে আপনি কিন্তু সমাজকে দেখতে পারছেন না। কাজেই স্বাধীন ব্যক্তিকে নিয়েই আগামী দিনের সমাজ গঠিত হবে।

না। ব্যক্তিকে দমন করা যাবে না। কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতা যখন দেওয়া হচ্ছে, একই সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে এই স্বাধীনতাকে কতটুকু পর্যন্ত আমি নিতে পারব?

রাইট। এটা কিন্তু আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন, তাই না? তাহলে ব্যক্তি আর সমাজের যে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব এটাই রাজনীতিতে এখন প্রধান বিষয়। এটার সমাধান করতে হবে আগে। ব্যক্তি কতটা স্বাধীন এবং সমষ্টি কতটা ব্যক্তির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারছে। আইন বলতে এটাই বোঝায় এবং আইন সমষ্টির পক্ষে। ব্যক্তি তো আর আইন না। কিন্তু সমাজে বাস করতে হলে তো আইন লাগবে। আইন ছাড়া সে কীভাবে চলবে? তখনই ব্যক্তিকে আইনের কথা বলতে হবে।

হ্যাঁ। কনফ্লিক্টটা এখানে। পরে আপনি বলছেন রাষ্ট্রের এই শৃঙ্খলাকে বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষার জন্যে প্রতিরক্ষারও ব্যবস্থা রাষ্ট্র করে।

এখনকার আধুনিক রাষ্ট্র, নিরাপত্তাসর্বস্ব। এই কনসেপ্টটা বুঝতে হবে আগে। নিরাপত্তাসর্বস্ব রাষ্ট্র গড়ে উঠল কেন? রাষ্ট্র কেন দাবি করে, নিরাপত্তা বা সিকিউরিটি দেওয়াই আমার একমাত্র কাজ? এটা করে এই কারণে যে, অবাধ বাজারব্যবস্থার নীতিটা যখন গ্রহণ করা হবে বা নিউলিবারেল ইকোনমিক পলিসি যখন গ্রহণ করা হলো, তখন তার অনিবার্য পরিণতিতেই নিরাপত্তাসর্বস্ব রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। কেন গড়ে ওঠে? কারণ রাষ্ট্র দাবি করছে, আমার আর আগের মতো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান অর্থাৎ মৌলিক অধিকারগুলো দেবার দরকার নেই। এটা আমার দায় না। এসব জনগণের নিজ দায়িত্বে করতে হবে। কীভাবে? তুমি বাজারে প্রতিযোগিতা করো, সেখানে টিকলে টিকবে না টিকলে নাই। আশির দশকের পর থেকে আমরা নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসির অধীনে আছি।

আমরা যখন রাজনীতি করছি, আপনি তখন কোনো রাজনীতিবিদকে কি বলতে শুনেছেন যে নিউ লিবারেল ইকোনমির বিরুদ্ধে আমাদের কাজ করতে হবে? বলেছে কি যে আমাদের একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা লাগবে যার শিক্ষা, স্বাস্থ্য- এসব ব্যাপারে তার দায় আছে? আমি যদি বাজারের দ্বারাই ঠিক হই, তাহলে আর রাষ্ট্রের দরকার কি? রাষ্ট্র বলে হ্যাঁ দরকার আছে, তোমাদের নিরাপত্তার জন্যে। এখন রাষ্ট্র যে আমাকে নিরাপত্তা দেয় সেটা প্রমাণ করার জন্যে কয়েক দিন পর পর সে (রাষ্ট্র) সন্ত্রাসী আবিষ্কার করে। বলে এই যে দেখেন সন্ত্রাসী ধরেছি। কেন সন্ত্রাসী ধরছে? রাষ্ট্র বলে, এই সন্ত্রাসী না ধরলে তুমি নিরাপদ থাকতে পারতা না। কিছুদিন পর পর সমাজে মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক তৈরি করে। এই যে একটা আতঙ্ক তৈরি এবং সন্ত্রাসী ধরা, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই- এর সবই কিন্তু নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসির সঙ্গে যুক্ত। এটা ভালো করে বুঝতে হবে। এই রাষ্ট্রকে যদি মোকাবিলা করতে চান, তাহলে রাজনীতিতে প্রথমে আপনাকে নিউ লিবারেল ইকোনমিক পলিসির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। বাজার যে সব ঠিক করে দেবে- এই নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু আপনি এখন কী করছেন? এই যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেল এখন কী করছেন আপনি? 

সরকারের সমালোচনা করছি। 

সমালোচনা করা ভালো। আমাদের এখনকার রাজনীতির মূল যে জায়গাটা, অর্থাৎ অবাধ বাজারব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। অবাধ বাজারের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে আমি এই সিকিউরিটি স্টেটটাকে দমন করতে পারব না। তাহলে সিকিউরিটি স্টেটের বদলে আমার দরদি রাষ্ট্র লাগবে। বাজারের প্রতিযোগিতায় যে লোকটা টিকতে পারছে না, তার পক্ষে দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্রের কাজ হবে মানুষের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করা। ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি করে সে যেন বাজারে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা। বাজারটা কী রকম হবে? 


একদিকে বলা হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক বাজার। আবার অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে বাজারে সবাই প্রতিযোগিতা করতে পারছে না।

খুব ভালো। দেখেন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কিন্তু দোষ নেই। কিন্তু আপনি যখন প্রতিযোগিতায় নামছেন, আপনি কিন্তু প্রতিযোগিতা করতে দিচ্ছেন না। কেন? আপনি সাপোর্ট করছেন বড় সব কোম্পানি। বাজার তো খারাপ না। আমাদের ভাগ করতে হবে বাজার বনাম পুঁজিতান্ত্রিক বাজার, বাজার বনাম মনোপলি, বাজার বনাম অল্প কয়েকটা কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বাজার ইত্যাদি। তাহলে আমাদের রাজনীতির মূল দাবিটা কী এখন? জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে প্রধান ইস্যুটা কী? 

সঠিক বাজারব্যবস্থা।

অবাধ বাজারব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং আমাদের এমন বাজারের কল্পনা করা দরকার, যেখানে মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারবে। এখন আপনি যদি বলেন, এটা রাষ্ট্র করে দেবে, সেটা করা যাবে না। কেন? ওই যে পুরোনো সমাজতন্ত্র করেছিল। ব্যক্তির উদয় যখন হলো, ব্যক্তির মধ্যে যে উদ্যোগটা তৈরি হলো, তার নিজের স্বার্থে যে প্রণোদনা তা নষ্ট করলে কিন্তু আপনি অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারবেন না। যেটা আমরা অতীতে দেখেছি।

বিষয়টি আরেকবার বুঝিয়ে বলেন।

ব্যক্তি যদি নিজে তার স্বার্থটা না দেখে এবং প্রণোদিত বোধ না করে, তখন সে রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে যাবে। এ জন্য অবশ্যই প্রতিযোগিতায় থাকতে হবে। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে তারও ডেভেলপমেন্ট লাগবে। তাকে তো আপনি ভেজিটেবল বানাতে পারেন না। পুরোনো সমাজতন্ত্র আমাদের ভেজিটেবল বানিয়ে দিচ্ছিল। উল্টোদিকে নতুন ইকোনমি বলছে সবকিছুকে বাজার করে দাও। দুটোই এক্সট্রিম। এই দুই এক্সট্রিম থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। দুটোই খারাপ। এটাই এখন আমাদের ১ নম্বর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। এটা কিন্তু ইকোনমি না। আমরা মনে করি ইকোনমি, একদম না। এটাই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। এ জন্যই অর্থনৈতিক দিক থেকে ‘গঠন’ কথাটা আমি বলি। গঠন কথাটার অর্থ হলো এই অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্পূর্ণ নতুন করে গঠন। আপনি বলবেন ইকোনমি আমি বলব না। এটাই পলিটিক্যাল। আমি ফুকো, মার্কস, আগামবেন পড়ে আসার পর বলব, এটাই মূল জায়গা। তাহলে গঠন কথাটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? এই গঠন থেকে সব বেরিয়ে আসবে। আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নতুন করে বের করতে হবে। শুধু তা-ই না, অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে একটু আগে যে আলোচনাটা করেছিলাম, এই নারী-পুরুষ সম্পর্কও নতুন করে বের করতে হবে। প্রেমও নতুন করে বের করতে হবে। প্রেম বলতে আমরা কী বুঝি? প্রেম থাকবে বলে কি আমি সন্তান নেব না? সন্তান লাগবে না? তাহলে প্রজাতি পুনরুৎপাদনের চিন্তাটাও নতুন করে করতে হবে। আমি সমাজকে ভালো সন্তান উপহার দেব। কীভাবে দেব? আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু সেই শিক্ষা কি স্কুল দিতে পারবে? মায়ের চেয়ে একটা মাস্টার কি বেশি শিক্ষা দিতে পারে? তাহলে আমাদের মায়ের ভূমিকা নিয়েও আবার নতুন করে ভাবতে হবে। কিন্তু মায়ের রোলের কথা বললে দেখবেন প্রচলিত নারীবাদ বিরোধিতা করবে। তাহলে মায়ের রোল বাদ দেন। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিবারের যে একটা ভূমিকা, এটাকে তো শক্তিশালী করতে হবে।

বাচ্চারা স্কুলে কেন যায়? দরকার কী? স্কুলে যাবে ১০ জনের সঙ্গে মিশতে, সামাজিক হতে। আর এখন তো সব ঘরেই আছে। কম্পিউটার-টম্পিউটার সব টিপতে পারে। ফলে পুরা শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে আমাদের। খেলার মধ্যেই যেন সব শিখতে পারে। আজকে যে বিলগেটস, জাকারবার্গকে দেখছেন, এরা তো সব ড্রপ আউট। তাহলে আর এডুকেশন দিয়ে আপনি কী করবেন? হ্যাঁ লাগবে। যেমন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং শেখাবেন। প্রতিটি কারখানা একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। আমাদের দরকার কি আলাদা করার? এডুকেশন ও প্রডাকশনকে আমরা আলাদা করব কোন দুঃখে? কারখানায় সে তার স্কিল ডেভেলপ করছে। আর লাগবে একটা পাওয়ারফুল কালচারাল এথিক্স। 

এটার কথা কেন বলছি? ওই যে নীতি-নৈতিকতার কারণে। এই নীতি-নৈতিকতার বিকাশের জন্যে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব লাগবে এবং একালের সাংস্কৃতিক বিপ্লব মানেই ধর্মীয় বিপ্লব, যার লক্ষ্য আত্মিক বিকাশ। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য ক্যাপিটালিজমের বিপরীতে বিনোদন দেওয়া না। নতুন নতুন নীতি-নৈতিকতা তৈরি করা। আর ক্যাপিটালিজম কী করে? ক্যাপিটালিজম আমাদের কালচার দিতে পারে না, শুধু বিজ্ঞাপন দেয়। যা কিছু ক্যাপিটালিজম করে সেটা পণ্য তৈরি এবং পণ্য বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন। তাই বিজ্ঞাপনকে সংস্কৃতি বলা যায় না। কাজেই বিজ্ঞাপনের বিপরীতে আমাদের একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন লাগবে, নতুন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। 

খুব ভালো। কিন্তু আপনি যখন বললেন, একালের সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলো ধর্মীয় আন্দোলন।

একালের ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। কারণ ধর্মের উদ্দেশ্যই হচ্ছে আত্মার যতœ, সংস্কৃতিরও। একই কথা। সংস্কৃতি বিনোদনের পণ্য হয়ে উঠেছে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে। ফলে ধর্ম কথাটা শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ-কালাম পড়া না। আমি কি নামাজ-কালাম বাদ দিতে বলছি? বলছি না। এর দ্বারাও আপনি আত্মার যত্ন করতে পারেন। কিন্তু এর দ্বারা যদি আপনি আত্মার যতœ না করে  কয়েক দিন পর পর এসে ওয়াজ করেন, দাসির সঙ্গে সহবাস করা বৈধ নাকি ইসলামে? এটা তো ধর্ম না। এটা দিয়ে তো ওয়াজিয়ান ট্রাইবাল সমাজে, বহু দূরের অতীতে চলে গেছে, এর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নাই। তাহলে ইসলাম বলতে যারা দাবি করে, আমি ইসলামি, আসলেই কি ইসলামে এটা বলেছে? এটা তো প্রশ্ন করতে হবে। এই প্রশ্নটা কারা করবে? কারা তোলে। সেটা তোলে দর্শন। 

এই পয়েন্টে আগেই আমি একটা প্রশ্ন তৈরি করে রেখেছিলাম, ধর্মের সঙ্গে দর্শনের পার্থক্য তাহলো কোথায়?

ওই যে চিনাবাদাম। ধর্মের সঙ্গে দর্শনের পার্থক্য হলো ধর্ম হলো চিনাবাদাম আর দর্শন হলো শাঁস।

মানে দর্শন আরো ভেতরের জায়গা?

ভেতরের না। বের করে আনতে হবে। দর্শনের কাজ ক্রিটিক করা। ধর্ম কী করে? ধর্মের মধ্য দিয়েও আমরা চিন্তা করি, কিন্তু চিন্তার একটা রূপ আছে। তাহলে চিন্তার ধর্মতাত্ত্বিক রূপ খসিয়ে তাকে চিন্তার স্বরূপে হাজির করে দর্শন। তা ছাড়া আমাদের ভেতরে সহজাত নানা রকম বৃত্তি আছে, এই বৃত্তির বিকাশটা আমাদের দরকার। এই বৃত্তিকে ধরিয়ে দেওয়া এবং তাদের বিকাশ নিশ্চিত করবার কাজ করে দর্শন।

কিন্তু এতে করে কি আমরা ধর্মকে খাটো করছি না?

না। আমি আসছি এই বিষয়ে। আপনি যখন মায়ের পেট থেকে বের হয়েছেন তখন আল্লাহর কাছ থেকে কী কী নিয়ে আসছেন? 

আল্লাহর কাছ থেকে আমি কথা নিয়ে আসছি, শরীর নিয়ে আসছি।

কল্পনা নিয়ে এসেছেন, বুদ্ধি নিয়ে আসছেন। আরো নানা বৃত্তি, অনেক কিছু নিয়ে আসছেন। কিন্তু কোরআন শরিফ নিয়ে কি এসেছেন? না। আল্লাহ কেন কোরআন শরিফ আপনার জন্মের সময় হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাঠান নেই? 

কারণ আমাদের বিবেক, বুদ্ধিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এই যে ঢুকলাম। এই তো ঢুকলাম আমরা দার্শনিক আলোচনায়। দর্শনের কাজ বুদ্ধিসহ আমাদের সহজাত বৃত্তির বিকাশ। একে আপনি রুহানি বিকাশ বলতে পারেন, অর্থাৎ জীবমাত্র না থেকে জীবের অতিরিক্ত কিছু হওয়ার চেষ্টা করা। 

কোরআন নিজেকে কী বলে? এটাকে কি আইনের বই বলে?

না।

হুদাললিল মুত্তাকিন অর্থাৎ যারা আত্মসমর্পণকারী, তাদের জন্যে এটা উপদেশের বই। হেদায়েতের বই। আইনের বই না। এখন আপনি যে হেদায়েত নিবেন বা পরামর্শ নিবেন, এটা নিতে গেলে কী লাগবে আপনার? কোরআন পড়ে আপনি হেদায়েত পেতে চান। কেন পেতে চান? পেতে চাই এই কারণে যে আপনার ভেতরে যে বিবেক, বুদ্ধি অর্থাৎ আপনার ভেতরে যে বৃত্তিটা আল্লাহ দিয়েছেন, সেটার বিকাশ করতে আপনি চান। এই বৃত্তিটা কিন্তু গিভেন। আপনাকে কিন্তু এসব দিয়েই দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। আপনাকে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি করা হয়েছে এই কারণে যে, আল্লাহ বলছেন সব বৃত্তি দিয়েছি তো আমি। এখন কোরআন পড়ে, কখন কী করতে হবে সেটা বুঝে যাবেন। 

তো আপনি বৃত্তি-টিত্তি কোনো কিছুর ব্যবহার করেন না। শুধু এটাকে বই আকারে পাঠ করেন। তাহলে আপনি কি ইসলাম বুঝবেন? না। ইসলামের পতনটা হয়েছে ঠিক এভাবে। ইসলাম পড়ে গেছে এভাবে পাশ্চাত্য থেকে, পাশ্চাত্যের পেছনে। আপনি তো শোনেন নাই। আপনি খেয়ালই করেন নাই যে আপনাকে খলিফা আকারে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। ‘খলিফা’ কথাটার মর্মও বোঝেন নাই। আর আপনি কোরআন পড়তে শুরু করছেন। আপনার ধারণা, আল্লাহর বোধহয় একটা প্রিন্টিং প্রেস আছে, ওখানে কোরআন ছাপিয়ে ছাপিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। 

খুব ভালো লাগল। এখন আলাদা একটা প্রশ্ন করি, সেটা হলো, আপনি বোধহয় প্রথম বলেছিলেন বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার খুব দরকার। কেন দরকার?

আমাদের বড় দুটো শত্রু দেশ আছে, ভারত আর মিয়ানমার। আপনি শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। আপনার কি মনে হয় বর্তমান সেনাবাহিনী দিয়ে আপনি দেশকে রক্ষা করতে পারবেন? তাহলে আমাদের প্রতিরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। সেই প্রতিরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাববার জায়গা থেকে আমি বলেছি যে আমাদের বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা লাগবে। কিন্তু তার সঙ্গে এটাও যোগ করেছি, জানি না আগের বইটিতে পরিষ্কার করে আছে কি না। সেটা হলো, যারা ইন্টারমিডিয়েট পাস করবে, তারা দুটি বছর রাষ্ট্রীয় বৃত্তি পাবে। এই দুই বছরের বৃত্তিতে সে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা নেবে। সেনাবাহিনীতেই সে পড়বে এবং সেখানেই তার চাকরি হবে। সেনাবাহিনীতে যে দক্ষতা, টেকনিক্যাল স্কিল, যা যা দরকার সেই শিক্ষা সে সেই সময়েই নেবে। আপনি যদি দেশের নাগরিক হতে চান তাহলে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা লাগবে। এর মধ্য দিয়ে একটা ডিসিপ্লিন মানব সম্পদ তৈরি হবে, যা দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দরকারি শিক্ষাকে যদি সঠিকভাবে হাজির করতে পারেন, সত্যিকারের শিক্ষা তাহলে সম্ভব। 

সামরিক শিক্ষা বলতে শুধু অস্ত্র চালনা নয়, আমি যে আত্মার যত্ন কথাটা বলছিলাম, সামরিক শিক্ষার সঙ্গে তার যোগ করতে পারলে আপনি অত্যন্ত উন্নত একটা নাগরিক তৈরি করতে পারছেন। ওই শিক্ষার পর তার আর তথাকথিত উচ্চ শিক্ষার দরকার নেই। এর মধ্যে তার ২১-২২ বছর হয়ে গেছে, সে তখন কিছু একটা করে খেতে পারবে। আর যারা একাডেমিক লেভেলে যেতে চায়, তখন তারা হায়ার এডুকেশনে চলে যাবে। তাহলে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মিলিটারি ডিভিশনের লেভেলে আনতে হবে। আলাদা করে ক্যান্টনমেন্ট বানানোর দরকার নেই। বলতে পারেন ক্যান্টনমেন্টকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করুন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ছিল, তেমন থাকবে। পাশাপাশি সামরিক শিক্ষারব্যবস্থা করতে হবে। আপনি যখন নতুনভাবে বাংলাদেশ গঠন করবেন তখন প্রতিটি ক্ষেত্র নতুন করে গঠন করতে হবে। ‘গঠন’ কথাটা অনেক বিস্তৃত ও গভীর ধারণা। 

এই কারণেই আপনার শেষ বই গণ-অভ্যুত্থান ও গঠন গঠনের ওপর এত গুরুত্ব দিয়েছেন?

একদম তাই।

তাহলে আপনার সেই বই ধরে আরেকটা প্রশ্ন করি, আপনি যে গঠন গঠনের ওপর বারবার এত জোর দিচ্ছেন, তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে বাহাত্তর সাল থেকে যদি ধরি, তখন থেকে এই ২০২৪ সাল পর্যন্ত- বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা কখনো গঠিত হয়নি?

বাংলাদেশ রাষ্ট্র কখনই গঠিত হয়নি। আমাদের এখানে রাষ্ট্রের কোনো ধারণাই নেই। গঠন হবে কীভাবে? আমাদের সমাজই তো নেই, রাষ্ট্র হবে কীভাবে? সবাই শুধু রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে। আমাদের এখানে সবাই সরকার বোঝে, রাষ্ট্র বোঝে না। 

আপনি বলেছেন বাইরের শত্রু থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে এবং এজন্য সামরিক শিক্ষা দরকার। আমার প্রশ্ন, ভারত আমাদের শত্রু না মিত্র?

উত্তর খুব সহজ। আপনি যদি নিজেকে রাষ্ট্র বলে দাবি করেন, তার মানে হলো সব রাষ্ট্র আপনার সম্ভাব্য শত্রু- এটাই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা। রাষ্ট্র মানেই সম্ভাব্য শত্রু দ্বারা আপনি বেষ্টিত। যদি আপনি রাষ্ট্র না হন, তাহলে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে মিশে যান না কেন?

ধর্মের কথায় একটু যেতে চাই। এখানে যখনই ধর্মের কথা ওঠে, সব সময় কেন শুধু ইসলাম ধর্মের কথা ওঠে। কেন অন্যান্য ধর্মের কথা ওঠে না? আমাদের এখানে কি অন্য ধর্ম নেই? অন্য ধর্ম নিয়ে কি আমরা কথা বলতে পারি না?

হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আমরা ইসলাম নিয়ে কথা বলি, তার প্রধান কারণ আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। কিন্তু অন্য ধর্ম নিয়ে তো আমি সারাক্ষণ কথা বলছি। শুধু হিন্দু বা খ্রিস্টান নয়, রামমোহন রায়ের দিকে তাকান, ব্রাহ্মদের ইতিহাসের দিকে তাকান। তারা পৌত্তলিক ছিল না। ব্রাহ্মরা ছিল মনোথেয়িস্টিক বা একত্ববাদী। বেদ, উপনিষদ ছিল একত্ববাদী। একত্ববাদ তো ইসলামের একচেটিয়া না। আপনি একত্ববাদ নিয়ে আলোচনা করলে তো সবাইকে নিয়ে, সকল প্রকার একত্ববাদ নিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে হবে। একত্ববাদ, মানে তৌহিদী জনতা নিয়ে কথা বললেও তো সব ধরনের একত্ববাদীর প্রসঙ্গ আসবে। ঔপনিবেশিক হিন্দু তো একত্ববাদী। একত্ববাদের আলোচনায় ওকে বাদ দেবেন কেমনে? আরবি শব্দ ‘তৌহিদ’ ব্যবহার করলেও তো সব হিন্দু বাদ পড়ছে না। একত্ববাদ চলে যাচ্ছে না। আহাদ বা এক থেকে তৌহিদ। দার্শনিক হিসেবে তাহলে আপনাকে প্রশ্ন করতে হবে, বেদের যে একত্ববাদ আর ইসলামের যে একত্ববাদ এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? এটা দর্শনের তর্কের বিষয়। ইসলামের একত্ববাদের যে আলাদা গুরুত্ব আছে, বা আদৌ আছে কি না- এ তর্ক তো আপনাকে জারি রাখতে হবে। এই তর্ক আমি লড়ি, আমি ছাড়া কেউ জারি রাখে না। কারণ দর্শন তাদের বিষয় না। আমরা পরিচয় দিয়ে ধর্ম ভাগ করি, এটা পরিচয়বাদিতার পরিণতি। 

ইসলামের একত্ববাদের তর্ক নির্ভর করছে গায়েবি আত্মসমর্পণের জায়গায়। ইসলাম একত্ববাদী ঠিকই, কিন্তু এই একত্ববাদ এপিস্টোমলজিক্যালি না, অর্থাৎ জ্ঞানতাত্ত্বিক না। বেদ, উপনিষদেও একত্ববাদ, কিন্তু সেটা জ্ঞানতাত্ত্বিক, অর্থাৎ বুদ্ধির দ্বারা তা নির্ণয় সম্ভব। জিন্তি যা ‘হায়েব’, নাই বা নিত্য অনুপস্থিত তাকে বুদ্ধির দ্বারা নির্ণয় করা যায় না। সেই জন্য যা নাই বা গায়েব, সেই নিত্য অনুপস্থিতির প্রতি আত্মসমর্পণের তর্ক আসে। 

আর অন্যদিক থেকে ইসলামের একত্ববাদ হচ্ছে পলিটিক্যাল। আপনি যদি ‘এক’-কে না মানেন, তাহলে তো আপনি রাষ্ট্রই গঠন করতে পারবেন না। কারণ এককে মানলে, একের অধীনে আমরা সবাই নিজেদের দাখিল করতে পারি, সবাইকে নিয়ে একটা বিশ্বসমাজ বা উম্মাহ গঠন করতে পারি। এভাবে ‘এক’-এর ধারণা বা ‘এক’-এর কাছে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই আমরা সবাই মিলে বিশ্বসমাজ বা উম্মাহ গড়ে তুলতে পারব। ইসলামের একত্ববাদের বৈশিষ্ট্য বা অপরাপর একত্ববাদ থেকে পার্থক্য হলো ইসলামের একত্ববাদ জ্ঞানতাত্ত্বিক না। আল্লাহ দেশকালপাত্রে ‘আছে’- এটা ইসলামের দাবি না। ইসলাম বলে যে, আল্লাহ এক হতে পারে, কিন্তু তিনি ‘গায়েব’। মানুষের উচিত এই গায়েবেরই উপাসনা করা। 

ঠিক করে শোনেন, মানুষের উচিত এমন ‘এক’-এর উপাসনা করা, যিনি নিত্য অনুপস্থিত, যিনি ‘নাই’- অর্থাৎ জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে ‘নাই’, কিন্তু মানুষের উপলব্ধির মধ্যে, মানুষের মধ্যে বিরাজ করেন। তিনি যা আছেন তার প্রমাণ স্বয়ং মানুষ। তাই মানুষ আল্লার ‘খলিফা’ বা আল্লার ‘চিহ্ন’-  প্রতিনিধি। তাই ফেরেশতাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন তারা আদমকে সেজদা করে। তাই আল্লাহ ‘এক’, এভাবে বলা ইসলামের তরিকা না। এখানে ইসলাম থেমে থাকে না। বেদ, উপনিষদ ব্রহ্মকে ‘এক’ বলে, কিন্তু ইসলাম বলে, মানুষের উচিত একের উপাসনা করা। অর্থাৎ এখানে ঔচিত্যের তর্কও এসে যায়। উচিত কেন? কারণ এ ছাড়া বিশ্বসমাজ বা উম্মাহ গড়া যাবে না। এই কারণেই ইসলাম পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করে। প্রত্যেকে যদি পৃথক পৃথক পূজা করে তাহলে ট্রাইবাল সমাজের মতো মানুষ সব সময় ভাগ হয়ে থাকবে, বিভক্ত থাকবে। তার মানে আপনি যদি সরস্বতী পূজা করেন, দুর্গাপূজা করেন আর কেউ যদি মক্কায় কাবা প্রদক্ষিণ করে, তাহলে তো মানুষ ভাগ হয়ে গেল। এভাবে ভাগ হয়ে গেলে তো পৃথিবীর মানুষকে আমরা আর এক করতে পারব না। তাই যদি বলেন, মানুষের উচিত শুধু একের উপাসনা করা, অথচ যিনি গায়েব বা নিত্য অনুপস্থিত, তাহলেই মানুষ নিজের মধ্যে আল্লাহকে খুঁজে পাবে, অপরের সঙ্গে এক হওয়ার, সবাই মিলে বিশ্বসমাজ গড়বার প্রণোদনা খুঁজে পাবে। ইসলামকে আমরা এখনো পুরাপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। 

আপনার মোকাবিলা বইয়ে আপনি ধর্মের পর্যালোচনা বলতে বলেছেন, ধর্মের মধ্যে চিন্তা যেভাবে নাজিল হয়। কী বুঝিয়েছেন এটা বলে?

ওই যে চিনাবাদামের কথা বলেছিলাম, চিন্তা সব সময় দর্শন। সব সময় বুদ্ধি বা যুক্তির জায়গায় দাঁড়িয়ে যা নেসেসারি এবং ইউনিভার্সাল সেটা আবিষ্কার বা প্রতিষ্ঠিত করে। চিন্তা সেটাই আবিষ্কার করে, যা সর্বজনীন এবং অনিবার্য। চিন্তার যুক্তি দ্বারা যে সিদ্ধান্ত অনিবার্যরূপে হাজির হয় এবং যা সর্বজনীন, সেটাই দর্শনের আরাধ্য। চিন্তার এই চরিত্রকেই বলে দর্শন। ধর্মও দর্শন। কিন্তু ধর্ম দর্শনের আকারে হাজির থাকে না। 

মানেটা কি? বুদ্ধির রূপে, বুদ্ধি যেভাবে যুক্তি দেখায় বুঝিয়ে বুঝিয়ে বক্তব্য হাজির করে, দর্শন এই বুদ্ধির যুক্তির দ্বারা বুঝিয়ে বুঝিয়ে দেখায় যে সে একটা সিদ্ধান্ত থেকে আরেকটা সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্তভাবে নিষ্পন্ন করেছে। ধর্মতত্ত্বে এটার দরকার পড়ে না। ধর্ম বলে হাদিসে যা আছে সেটা সত্য, কোরআন বলছে তাই সত্য। ধর্ম কিন্তু বুদ্ধির কাছে সব সময় যায় না। অর্থাৎ বুদ্ধির দ্বারা সব তর্ক নিষ্পন্ন করা বুদ্ধির কাজ না। তাহলে পর্যালোচনার অর্থ হলো আপনি বুদ্ধির দ্বারা ধর্মের উপলব্ধি, বক্তব্য বা সত্য, যা ধর্ম বলছে- সেই সত্যটা ব্যাখ্যা করবেন, তার কোনো সর্বজনীন ও অনিবার্য সত্য থাকলে বুদ্ধিরস্বরূপে হাজির করবেন। ধর্মের সত্য আপনি বুদ্ধির দ্বারা প্রমাণ করবেন। এটাই তফাৎ।

তাহলে তো হেগেল ঠিকই করেছিলেন। উনি চিন্তার জায়গা থেকে ধর্মের পর্যালোচনা করেছিলেন। আর ফয়েরবাখ করেছিলেন মানুষের জায়গা থেকে। তাহলে আমি বলব, হেগেলই ঠিক করেছিলেন।

না। দুজনই দুই রকম ভুল করেছিলেন। হেগেল যখন ইতিহাস চিন্তা করেছিলেন, তখন তিনি মানুষের ইতিহাসের কথাই বলছেন। কিন্তু রক্ত-মাংসের মানুষকে বাদ দিয়ে গেছেন। তিনি চিন্তার ইতিহাস বয়ান করতে নেমেছিলেন। কারণ চিন্তা তো হাওয়ায় ভাসে না। কোনো না কোনো জীবিত মানুষের কাছ থেকে চিন্তা আসে, উৎপাদিত হয়। 

আমি যদি কালকে মরে যাই, তাহলে আমার লাশটা পড়ে থাকবে, আমি তো আর কথা বলতে পারব না। তাহলে চিন্তা মাত্রই জীবিত মানুষের চিন্তা। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সেই জীবিত মানুষ কী করে বর্তমান থাকে? অর্থাৎ জীবিত মানুষ কী করে ইহলৌকিকভাবে বর্তমান থাকে। এর রহস্য তো আগে বের করতে হবে। তাহলে সে কী করে বর্তমান থাকে তার এই বর্তমান থাকার পদ্ধতি ও প্রকরণটা বুঝলে মার্কস বলেছেন তার চিন্তার ধরনও বোঝা যাবে। ফলে হেগেল থেকে ফয়েরবাখ, ফয়েরবাখ থেকে মার্কস- এই ধারায় শক্তিশালী বিপ্লবী চিন্তা বা জগৎ বিচারের পদ্ধতি বিকশিত হয়েছে। খুব সহজ ব্যাপার। 

আপনাকে আগে এই সমাজকে, সমাজের বৈষয়িক ভিত্তি, ইহলৌকিক যে বৈশিষ্ট সেটা বুঝতে হবে। বুঝতে পারলে এই সমাজে ‘আমি’ বলে যে সত্তাটা নিজেকে চিহ্নিত করে তাকেও বোঝা যাবে। সে যে কথাটা বলে সেই কথাটার মানেটা কি, সেই মানে বুঝতে পারবেন।

শেষ প্রশ্ন- অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেকে শিবির বা জামায়াত অর্থাৎ ইসলামিস্ট সরকার বলছে। কেন?

এটা একটা প্রপাগান্ডা। শোনেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ না থাকলে মনে করা হয় বাকি সবাই ইসলামিস্ট। আওয়ামী লীগ থাকলে মনে করে ইসলাম নেই, ইসলাম অদৃশ্য হয়ে যায়। সেক্যুলার আর আওয়ামী লীগ না থাকলে তাই সবাই মনে করে বাংলাদেশ ইসলামিস্টে সয়লাব হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের মতো এমন নৃশংস ফ্যাসিস্ট সরকার এই সমাজে কখনো আসেনি এবং এখন আবার ইসলামি জাতিবাদ, অর্থাৎ জাতিবাদী মুসলমানদের হুংকার আমরা দেখছি, যেহেতু তারা একটা শিথিল সরকার পেয়েছে। কিন্তু মানুষ গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ইসলাম বনাম সেক্যুলারিজমের বিভাজনের দিন শেষ হয়ে গেছে। আমার কথা শুনে বুঝতাছেন বাংলাদেশ এগিয়ে চলে গেছে। তরুণরা আর পেছনে ফিরে তাকাবে না। জুলাই অভ্যুত্থান প্রমাণ করে দিয়েছে ৫ আগস্টের আগে বাংলাদেশ আর কখনো ফিরে যাবে না।

তার মানে অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে আপনি আশাবাদী?

আশার কথাটা ভিন্ন। আমি তো ক্রিটিক করব। আমি যেমন সরকার চেয়েছি, সেটা পাইনি। সেটা ভিন্ন আলাপ। আমি তো একটা পূর্ণ বিজয় চেয়েছি। পূর্ণ বিজয় পাইনি। আমার এখনকার কাজ হলো, একটা পূর্ণ বিজয়ের দিকে জনগণকে নিয়ে যাওয়া। যে জনগণের আবির্ভাবটা ঘটেছে ৫ আগস্টে, এই জনগণকে পূর্ণ বিজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া আমার রাজনীতি। আগামী দিনে আমি এই রাজনীতিই করব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh