বাংলাদেশের জনপ্রিয় গীতিকার, পাঠকপ্রিয় লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলী। নিজের মধ্যে নজরুলের চেতনাকে ধারণ করেন। তাই ছোটবেলা থেকে নজরুল হতে চেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ‘সাম্প্রতিক দেশকালের’ মুখোমুখি হন লতিফুল ইসলাম শিবলী। কথা বলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসহ নানা প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রবিউল কমল।
আপনি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে শুরু থেকেই ছিলেন, আমরা সেই গল্পটা জানতে চাচ্ছি...
আমার আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ফ্যাসিস্ট হাসিনার ক্ষমতার শুরুর দিন থেকে। তখন থেকে অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছি। কখনোই তাদের অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি। তাই আমার আন্দোলন জুলাই থেকে নয়, আওয়ামী দুঃশাসনের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়েছিল। আমি তাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছি। আমি মনে করি, একজন লেখকের জন্য এটা বড় দায়িত্ব। লেখকের সামনে যখনই কোনো বেইনসাফি ঘটবে, তখনই তিনি ইনসাফের কথা বলবেন। আমি সেই জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করে গেছি। সুতরাং আমার আন্দোলনটা কেবল জুলাইতে সীমাবদ্ধ নয়। তবে আমরা দীর্ঘদিন ধরে যে আন্দোলনটা করে আসছিলাম, সেই আন্দোলনের পূর্ণতা দিয়েছে জুলাই। তাই অবশ্যই জুলাইয়ের কথা আলাদা করে বলতে হবে, বারবার বলতে হবে। আমরা দেখেছি জুলাইজুড়ে আন্দোলনটা দানা বেঁধেছে। আর ১৯ জুলাই থেকে সর্বোচ্চ পরিণতির দিকে এগোতে থাকে। মূলত আবু সাঈদের শাহাদাতের মাধ্যমে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। তাকে যখন প্রকাশ্যে গুলি করে মারা হলো, তখন বুঝে গেলাম আর না, হাসিনার জন্য এবার টিকে থাকা সম্ভব হবে না। আমরা অ্যাক্টিভিস্টরা রাস্তায় নেমে পড়লাম। অবশ্য আমি কখনো নির্দিষ্ট কোনো দল বা ব্যানারের হয়ে আন্দোলন করতাম না। কারণ ফ্যাসিবাদবিরোধী যেকোনো মঞ্চকে আমি আমার মঞ্চ মনে করতাম। তাই যখনই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে, আমি সেখানে গিয়েছি।
কোটা আন্দোলন কীভাবে সরকার পতনের আন্দোলন হয়ে উঠল?
আসলে কোটা আন্দোলন খুবই মাইনর একটা আন্দোলন ছিল। কারণ এর আগেও অনেক বড় বড় ইস্যুতে আন্দোলন হয়েছিল। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকার খুব আগ্রাসীভাবে সেগুলো দমন করেছে। কিছুদিন আগেও বিএনপির একটি বড় সমাবেশ হয়েছিল, সেই সমাবেশটাও আওয়ামী সরকার দমন করেছিল। তাই বলা যায়, ফ্যাসিস্ট সরকারের আত্মবিশ্বাস ছিল আকাশচুম্বী। তারা ভেবেছিল, কোটা আন্দোলন দিয়ে কী হবে! কী করতে পারবে ওরা! আল্লাহ তাআলা অনেক ছোট ছোট বিষয় রাখেন, যেগুলো থেকে অনেক বড় কিছু ঘটে। এখানেও তাই হয়েছেÑআওয়ামী লীগের পতনের বীজ কোটা আন্দোলনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বাঁকবদল হলো কখন থেকে?
প্রথমত, আবু সাঈদের শাহাদাত, সেটা এই আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কারণ আবু সাঈদের মৃত্যুর পর সব শ্রেণি-পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। কেউ আর ঘরে বসে থাকেনি। এরপর আন্দোলনটা ধীরে ধীরে যখন আসা শুরু করল, তখনই আন্দোলনের বাঁকবদল হতে থাকে। আমরা ১৫ বছর ধরে অত্যাচারিত হতে হতে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এই ফ্যাসিস্টকে আর সরানো সম্ভব হবে না। ফলে আমরা বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। তবে একটা বিষয়ে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল। সেটা হলো হাসিনাকে সরাতে হবে, আওয়ামী লীগকে সরাতে হবে। এটাই ছিল সবার এক দফা। আর পৃথিবীর সব স্বৈরশাসক কিছু ভুল করে থাকে। হাসিনাও এই আন্দোলনের সময় একের পর এক ধারাবাহিকভাবে ভুল করা শুরু করল। তখন দফাও ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল। একসময় আন্দোলন ৯ দফা থেকে ১ দফায় পৌঁছে গেল। আর এখানে পৌঁছাতে দুই হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হলো। আসলে আমরা ব্যাপকসংখ্যক মানুষ প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আর অনেক মানুষ যখন প্রাণ দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়, তখন কোনো আন্দোলন রোধ করার ক্ষমতা থাকে না।
আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, এই আন্দোলনে না থেকেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিলেন আবরার ফাহাদ?
আজ পুরো জাতির মধ্যে ভারত বিদ্বেষ, ভারত বিরোধিতা। এটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এই যে ভারত বিরোধিতা এবং ভারতের মিথ্যা তথ্য ছড়ানো- এই দুটো জিনিস আমাদের আরো ঐক্যবদ্ধ করছে। আবরার তো সেই ভারত বিরোধিতার অগ্রসৈনিক, যে এই লড়াইয়ে শহীদ হয়েছে। তার চিন্তা, চেতনা স্পষ্ট ছিল। শহীদ আবরার আসলে আমাদের নেতা। আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার নেতা হচ্ছে আবরার। তাই আবরার আমাদের মাঝেই আছে। আমাদের চিন্তা ও চেতনায় আছে। আমাদের এখনকার মূল লড়াই ভারতের সাম্রাজ্যবাদিতার বিরুদ্ধে। এই বাস্তবতাকে মানতেই হবে।
আওয়ামী সরকারের সময় দেশের লেখক, শিল্পীদের বেশির ভাগ নীরব ছিলেন। এমনকি আন্দোলনের সময় ‘আলো আসবেই’ নামে একটি গ্রুপ খোলা হয়েছিল, যেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা জোরদারের পরামর্শও দিয়েছিলেন কেউ কেউ। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
এমন একটা মহান আন্দোলনের সময়েও আমরা লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীদের পাইনি। সবার কথা বলছি না। তবে বলব, দেশের ৯৫ শতাংশ লেখক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীদের আমরা আন্দোলনে পাশে পাইনি। এর মধ্যে একটা হতাশাও ছিল। কারণ হাসিনার পতন হবে এমন কোনো আশা আমাদের মধ্যে আর ছিল না। তাই সবাই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছেন। তারা হিসাব-নিকাশ করেছেন হাসিনার বিরুদ্ধে দাঁড়ালে কী কী হতে পারে? তো ওই হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে তারা দেখেছেন ফলাফল ভয়ংকর! এ কারণে আর ঝুঁকি নেননি। এটা খুব সাধারণ মানুষের চিন্তা। কিন্তু সৃজনশীল মানুষ কখনো এভাবে ভাবতে পারেন না। কারণ তার চিন্তায় জাতি গঠিত হয়। সৃজনশীল মানুষ একটি জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই বলব, বাংলাদেশের লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীদের এই চিন্তা হলো তাদের ভাবনার দৈন্যদশা। এ ধরনের চিন্তার মানুষ সৃজনশীল হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কারণ সৃজনশীল মানুষের চিন্তা কখনো সাধারণ মানুষের মতো হবে না। তাদের চিন্তার স্তরটা আরো উঁচু হবে। এই বিষয়ে আমার মন্তব্য, আমরা যে অর্থে ওই মানুষগুলোকে ইন্টেলেকচুয়াল ভাবছি, তারা আসলে ইন্টেলেকচুয়াল ছিলেন না। আবার একদল বুঝতেন এই রেজিম কী, কীভাবে এটাকে সরানো যাবে, তারাও ফ্যাসিস্টের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে ওদের হয়ে কাজ করেছেন। আর হাসিনা তাদের ব্যবহার করেছেন। কারণ তিনি জানতেন, তার পক্ষে জনমত তৈরি করতে হলে একদল ইন্টেলেকচুয়াল লাগবে, একদল খেলোয়াড় লাগবে, একদল নায়ক-নায়িকা, একদল ভাঁড় লাগবে। স্বৈরশাসকের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে এগুলো লাগে। তাদের পক্ষে একদল ইউটিউবার ছিলেন। যারা বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে মানুষের মনোযোগ অন্যদিক সরিয়ে রাখতেন। আজ অবশ্য কেউ নেই তারা। খেয়াল করলে দেখবেন, সার্কাসে খেলার ফাঁকে ফাঁকে কিছু জোকার আসেন। তারা কিছু ক্যারিকেচার করে মানুষকে হাসিয়ে চলে যান। পুরো আওয়ামী রেজিমকে যদি সার্কাস ধরা হয়, তাহলে এই ইন্টেলেকচুয়ালরা ছিলেন এই সার্কাসের জোকার। তারা সুবিধাভোগী ছিলেন, মেরুদণ্ডহীন ছিলেন। এটা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের একটা কু-অধ্যায় ছিল। ইতিহাসে খুব বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে তাদের অবস্থান।
শহীদদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? আর অন্তর্বর্তী সরকার কয়েক মাসে সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন?
সম্প্রতি এক অভিনেতা বলেছেন, এ রকম অরাজকতা উনি নাকি দেখেননি! উনি মতামত দিতেই পারেন। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ উনি যে অরাজকতার কথা বলছেন, এটা গত ১৬ বছর ধরে ছিল। কিন্তু আওয়ামী সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে চেপে রেখেছিল। মানে আওয়ামী লীগ আমাদের গলা চেপে রেখেছিল। তাই চিৎকারটা কারো কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ওই অভিনেতাও সেই চিৎকার শুনতে পাননি। তার শোনার মতো দূরদর্শিতা ছিল না। আর যখন গলা থেকে হাতটা সরে গেছে, তখন চিৎকার সামান্য হলেও শোনা যাচ্ছে। তাই এটা বলা যাবে না, এটা এখনকার অরাজকতা, বরং এটা ফ্যাসিস্ট আমলের অরাজকতা, যেটা এতদিন আমাদের দেখতে দেওয়া হয়নি, শুনতে দেওয়া হয়নি। তাই এ ধরনের মানুষ অরাজকতার কথা বলে আমাদের এই অর্জনটাকে নষ্ট করে দিতে চান। আমি একটা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আছি। এখানে আসার পর দেখলাম, কীভাবে হাসিনা সরকার লেয়ারের পর লেয়ার তাদের লোক বসিয়ে রেখেছে। আর এই লোকগুলো চাইবে না বর্তমান সরকার ভালো করুক। তাই আমাদের সময় লাগবে। মানে যে প্রত্যাশা নিয়ে এই সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, সেগুলো অর্জন করতে হলে সময় দরকার। ১৬ বছরের আবর্জনা, জঞ্জাল দূর করা কয়েক মাসে সম্ভব নয়!
জানতে চেয়েছিলাম এখন কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান বা কেমন দেশের স্বপ্ন দেখেন?
আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সেটা অনেক বড়। এত বড় স্বপ্ন আসলে দেখে লাভ নেই। কারণ পৃথিবী এখন যে তন্ত্র ও মন্ত্রে চলছে, তাতে কোথাও শান্তি নেই। আমি বাংলাদেশে যে রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের কথা বলি, সেটা হলো যতটা কম দুঃশাসন, যত বেশি সাম্য, যত বেশি ইনসাফের কাছাকাছি দেশটাকে নেওয়া যায়, সেই চেষ্টা থাকবে। আমাদের তো গণতন্ত্রের মধ্যে থাকতে হবে। এটা হলো সো-কলড গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র দিয়ে পৃথিবীর কোথাও শান্তি আসেনি, বাংলাদেশেও আসবে না। আমার চাওয়া হবে যতটা বেশি ইনসাফের কাছাকাছি থাকা যায়- এমন রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করা। ইনসাফ এমন একটি শব্দ- এর মধ্যে সব আছে। আলাদা করে ন্যায়বিচার, মানবিক মূল্যবোধ, সাম্য, মানবাধিকার- এগুলো বলার দরকার হয় না। এই আন্দোলনে আমরা শুধু হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই করিনি। আমাদের ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। কারণ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে তাদের অবদান ছিল। তাই আমরা এমন বাংলাদেশ চাই, যেখানে কোনো সাম্রাজ্যবাদ আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।
নজরুল ইনস্টিটিউট নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
আমি এই শহরে ৩০ থেকে ৩৫ বছর শিল্প-সাহিত্য চর্চা করছি। কিন্তু কখনো নজরুল ইনস্টিটিউটে আসিনি। আমি এখানে জয়েন করার পর চিনেছি নজরুল ইনস্টিটিউট কোথায়! তার মানে নজরুল ইনস্টিটিউটকে আকর্ষণীয় করা হয়নি। যাতে শিল্প-সাহিত্যের মানুষ এখানে ছুটে আসেন। অথচ আমি নিজের মধ্যে নজরুলের চেতনা ধারণ করি। আমি সারাজীবন নজরুল হতে চেয়েছি। এখানে এসে দেখলাম, গবেষণার অনেক কাজ হয়েছে। এটা অনেক রিসোর্সফুল একটা জায়গা, একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি আছে। আর আমি এমন সময়ে দায়িত্ব নিয়েছি যখন দেশে একটা বিপ্লব শেষ হয়েছে, আর সেই বিপ্লবে প্রচণ্ডভাবে নজরুলের চেতনা কাজ করেছে। তাই এটা তাৎপর্যপূর্ণ সময়। সুতরাং আমি গাইডলাইন পেয়ে গেছি, বিপ্লব আমাকে গাইডলাইন দিয়েছে। আর নজরুল আছে চেতনায়। তাই নজরুলের দ্রোহ ও বিপ্লবের দ্রোহ দুটোকে মিলিয়ে আমি কিছু কর্মসূচি সাজিয়েছি। বর্তমানে ধারাবাহিক সেমিনার করছি, বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছি। টাইটেল হচ্ছে ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে আমাদের নজরুল’। আমি চেষ্টা করছি, নজরুলের চেতনাকে ফ্যাসিবাদী চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে। ফ্যাসিস্টরা চায়নি, নজরুল চর্চা হোক।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh