
সাবেক স্বৈরশাসক ম্যানুয়েল অ্যান্তনিও নরিয়েগা। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নতুন করে আলোচনা এসেছে মধ্য আমেরিকার দেশ পানামা। শপথ নেওয়ার পর দেশটির গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক জলপথ পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চান ট্রাম্প। প্রয়োজনে শক্তিপ্রয়োগের কথাও বলেছেন তিনি। ট্রাম্পের এই হুমকিধামকির মধ্যেই নতুন করে আলোচনায় এসেছেন পানামার সাবেক স্বৈরশাসক ম্যানুয়েল অ্যান্তনিও নরিয়েগা।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর পানামায় অভিযান চালিয়ে তাকে ধরে এনেছিল দেশটি। তার আগে গ্রেপ্তার এড়াতে নারী সেজে ভ্যাটিকানের দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন নরিয়েগা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, পানামার সাবেক স্বৈরশাসক ম্যানুয়েল নরিয়েগা দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। তবে তার নিষ্ঠুর শাসন, মাদক কারবারে ধৈর্যহারা হয়ে পড়েন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ। নরিয়েগাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ও পানামার নিয়ন্ত্রণ নিতে ২৮ হাজার মার্কিন সেনা পাঠান তিনি। একপর্যায়ে সেনা অভিযান চালিয়ে নরিয়েগাকে ধরে যুক্তরাষ্ট্রে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
২০১৭ সালে ৮৩ বছর বয়সে মারা গেছেন নরিয়েগা। ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা তাকে তুলে নিয়ে যান। এর আগে দুই সপ্তাহজুড়ে তাঁকে ধরতে মার্কিন বাহিনী বিশেষ অভিযান চালায়। এর পর থেকে তার জীবন কেটেছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, পানামার কারাগারে। তার বিরুদ্ধে হত্যা, মাদক কারবারসহ নানা অভিযোগ আনা হয়েছে।
মার্কিন সিনেট উপকমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নরিয়েগা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারেই ‘মাদক ক্লেপটোক্রেসি’ গড়ে তুলেছিলেন যা ওই গোলার্ধের প্রথম মাদক সাম্রাজ্য বলা চলে। এ সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন। অবশ্য গ্রেপ্তারের পর নরিয়েগা অভিযোগ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার সঙ্গে খেলা করেছে। তাকে হাতমোজার মতো ব্যবহার করেছে।
কারাগারে থাকা অবস্থায় নরিয়েগা বলেন, ‘আমার নেতৃত্বে পানামা যা করেছে, তা সবার জানা। পানামা খোলা বইয়ের মতো।’
কিন্তু ২০১১ সালে নরিয়েগা যখন হুইলচেয়ারে করে পানামা ফেরেন, তখন তিনি অনেকটাই দুর্বল হয়ে যান। যে শক্তিশালী জেনারেল হিসেবে পরিচিত ছিল তার, তা আর ছিল না। তিনি নিজের কুখ্যাত শাসনের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তবে বিরোধী নেতা–কর্মীদের খুনের দায়ে জীবনের বাকি দিনগুলো নির্জন বন্দী হিসেবে তাকে কাটাতে হয়।
১৯৬৮ সালে সেনা অভ্যুত্থানে ওমর তোরিজোসের সঙ্গী ছিলেন নরিয়েগা। পরে তোরিজোস তাকে গোয়েন্দাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। তিনি সেনাবাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত বিভিন্ন চুক্তি তদারকি করতেন এবং এর নির্মম গোপন পুলিশ বাহিনী পরিচালনা করতেন।
১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকে সিআইএর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন নরিয়েগা। ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে পানামা, এল সালভাদর এবং নিকারাগুয়ায় মার্কন বাহিনীকে সহায়তা করতে শুরু করেন তিনি। এর পর থেকে নিজের স্বার্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পানামার কর্মকর্তাদের কাজে লাগাতে শুরু করেন।
১৯৮১ সালে তোরিজোস বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলে দুই বছরের মধ্যেই পানামার শাসক হন নরিয়েগা। কিন্তু এর আগে থেকেই তিনি কলম্বিয়ার মাদকসম্রাট পাবলো এসকোবারের মতো অনেককেই যুক্তরাষ্ট্র, পানামাসহ বিভিন্ন স্থানে মাদক পাচারে সুযোগ করে দেন। এর বিনিময়ে ব্যাপক অর্থ পেতে থাকেন তিনি। ১৯৭৮ সাল নাগাদ নরিয়েগার এসব কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধরা পড়ে। ১৯৮৩ সাল নাগাদ তার বিরুদ্ধে অনেক প্রমাণ জোগাড় করা হয়। কিন্তু ওই সময়কার স্নায়ুযুদ্ধের সময় মধ্য আমেরিকায় বামপন্থী উত্থান ঠেকাতে পানামাকে বাফার অঞ্চল হিসেবে দেখা হয়।
১৯৮৫ সালে পানামার নির্বাচনে নিকোলা আদ্রিতো বারলেতা জয়ী হলেও নরিয়েগা তা মেনে না নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত ছিল, পানামা খাল পানামার হাতে তুলে দিতে ওই নির্বাচন হতে হবে।
নরিয়েগার বিরুদ্ধে ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছিল। কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এবং লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে গোপনে সমর্থন দেন তিনি। এ ছাড়া অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মাদক নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ে ৮০টি ফাইল জমা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৌঁসুলিরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার আট সপ্তাহ আগে সিআইএ বলে, তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্য কমছিল।
১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নরিয়েগা কোকেইন চোরাচালান ও অর্থপাচারে অভিযুক্ত হন। যুক্তরাষ্ট্র চাপ বাড়াতে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু দমে যাননি নরিয়েগা। ১৯৮৯ সালে তাকে পানামার জাতীয় পরিষদ সর্বোচ্চ নেতা ঘোষণা করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৮৯ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা ‘অপারেশন জাস্ট কজ’ নামে পানামায় অভিযান শুরু করে এবং নরিয়েগাকে খুঁজতে শুরু করে।
নরিয়েগা পালিয়ে পানামা সিটির ভ্যাটিকান দূতাবাসে আশ্রয় নেন। তিনি সেখানে নারী সেজে যান। মার্কিন সেনারা দূতাবাসে তল্লাশি চালায়। নরিয়েগা ১৯৯০ সালের ৩ জানুয়ারি আত্মসমর্পন করেন। ১৯৯২ সালের ফ্লোরিডায় তার ৪০ বছরের কারাদণ্ড হয়। ১৭ বছর কারাগারে থাকার পর ২০১০ সালে তাঁকে ফ্রান্সে পাঠানো হয়। সেখানে অর্থপাচারের অভিযোগে কারাগারে যান তিনি।