
প্রতীকী ছবি
ফৌজদারি মামলায় সরকার বা বাদীপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী অ্যাডভোকেট পাবলিক প্রসিকিটর এবং দেওয়ানি মোকদ্দমার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষে যারা আইনি লড়াই করেন তাদের আখ্যায়িত করা হয় Government pleader বা জিপি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯২ ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করে সরকার দায়রা আদালতে বাদীপক্ষে অর্থাৎ সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য নিজদলীয় অ্যাডভোকেট নিয়োগ করে। বর্তমানে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রসিকিউশন ব্যবস্থা ও সরকারি দলের দখলে। দেওয়ানি কার্যবিধির ২(৭) ও ২৭ নং আদেশের ৮ নং নিয়মের জিপি নিয়োগ প্রক্রিয়াও ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া মালিকানায়। এই নিয়োগগুলোর যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কী তা আমরা জানি না। শুধু দেখি ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই নতুন গোষ্ঠীর আইনজীবী বন্ধুরা প্রসিকিউশনে বা জিপি পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। নিয়োগ যোগ্যতার একমাত্র ব্যারোমিটার হচ্ছে দলের প্রতি আনুগত্য। আইন পেশায় যোগদানের সময়কাল, মামলা মোকদ্দমা পরিচালনার দক্ষতা, মেধা ও যোগ্যতা এসবের কিছুই ধর্তব্য নয়। সর্বোচ্চ আদালতের অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা চলছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৪, ১৯৭২ সালের ৬ নং আদেশে মাননীয় রাষ্ট্রপতির ওপর অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ, মেয়াদকাল ও পারিশ্রমিকের বিষয়াদি অর্পণ করা হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার এতিমি হালের কথা আমরা সবাই অবগত। প্রধানমন্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দের বাইরে রাষ্ট্রপতি কবর জেয়ারত আর পুষ্পমাল্যও অর্পণ করতে পারেন না। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, দলীয়করণ এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতি। বিগত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ তো প্রকাশ্যে বলেছেন, আমাদের দলীয় লোক ছাড়া সরকারি কোনো পদে লোক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। সরকারি নিয়োগের সব ক্ষেত্রে এ রকমই চলছে। কোটা না মেধা, মেধা মেধা স্লোগানে দেশ প্রকম্পিত করে যে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসল, তারাও মেধা ও যোগ্যতার বিচার না করে বিএনপি, জামায়াতের আইনজীবীদেরই প্রসিকিউশনে বসিয়েছেন, ব্যতিক্রম কিছু দেখছি না। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে আইনজীবী হিসেবে মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার গুণগত মান বিবেচনায় সর্বোচ্চ আদালত থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পর্যন্ত সরকারি আইনজীবী নিয়োগ হয়েছে বলে আমরা দেখিনি। একসময় বিজ্ঞ জেলা জজরা সরকারি আইনজীবী নিয়োগের সুপারিশ করে তালিকা পাঠাতেন সরকারের কাছে। সেই তালিকাই ছিল সরকারি আইনজীবী নিয়োগের ভিত্তি। জেলা জজরা তাদের সহকর্মীদের সহায়তায় অভিজ্ঞ, মেধাবী ও দক্ষ আইনজীবীদের নাম সরকারি আইনজীবী হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করতেন। কারণ আইনজীবীরা জজদের সম্মুখেই মামলা-মোকদ্দমা উপস্থাপন করেন। সাক্ষীকে জেরা করেন, জবানবন্দি গ্রহণ করেন, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। কাজেই তারাই সবচেয়ে বেশি অবগত কোন আইনজীবী কেমন অভিজ্ঞ, দক্ষ ও মেধাবী। এখন সরকারি আইনজীবী নিয়োগে জেলা জজদের কোনো ভূমিকা আছে বলে আমাদের জানা নেই। আইনজীবী নেতাদের প্রদত্ত তালিকা চোখে বন্ধ করে স্বাক্ষর করেন এটাই বাস্তবতা। তবে কিছু যোগ্য আইনজীবী যে প্রসিকিউশনে যাচ্ছেন না, সেটা নয়। কিন্তু সেই সংখ্যা একদম নগণ্য।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায়, দুদক তার সংস্থায় নিয়োজিত প্যানেলভুক্ত ১৪ জন আইনজীবীর নিয়োগ বাতিল করেছে। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ বাতিল হওয়া আইনজীবীরা বাদীপক্ষের আইনজীবী হয়েও আসামিপক্ষকে সহায়তা করেন। এটি শুধু দুদকের চিত্র নয়, সমগ্র দেশের আদালতগুলোতে সরকারি আইনজীবীদের মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা আর আসামিপক্ষের সঙ্গে দহরম-মহরমের দৃশ্য দেখলে মনে হয় সরকারি আইনজীবীই আসামিপক্ষের আইনজীবী। আদালত অঙ্গনের একজন হিসেবে সরকারি আইনজীবী নিয়োগ প্রক্রিয়ার সীমাহীন অব্যবস্থাপনা, মামলা পরিচালনায় তাদের কা-কীর্তন আমাদের, বিশেষ করে প্র্যাকটিশনার আইনজীবীদের দৃষ্টি এড়ায় না।
একটু আলোকপাত করা যাক নিয়োগ প্রক্রিয়ার নৈরাজ্য নিয়ে। ক্ষমতার পালাবদল হলেই দেখি গদি দখলকারী দলের অনুসারী আইনজীবী বন্ধুরা প্রসিকিউশন আর সরকারি আইনজীবীর পদগুলো দখল করে আছেন। যারা এতদিন মিটিং-মিছিলে ছিলেন, রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের সন্তুষ্টিতে নৈবেদ্য দিয়েছেন, মামলা-মোকদ্দমা ট্রায়ালের ধারে-কাছেও ছিলেন না, তারা এখন বড় বড় পদাধিকারী। এসব নিয়োগে দলীয় আনুগত্যের বাইরে তদবির ও আর্থিক লেনদেন, আইনজীবী নেতার চেম্বারের জুনিয়র, রাজনীতিক নেতার আত্মীয়- এসব যোগ্যতাহীন গুণগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারি আইনজীবী নিয়োগে শৃঙ্খলা আনার জন্য গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার স্থায়ী প্রসিকিউশন ব্যবস্থা গঠনের জন্য অ্যাটর্নি সার্ভিস নামের একটি আইন প্রণয়ন করেছিল। পরবর্তী সময়ে সে আইন আর আলোর মুখ দেখেনি। নিম্ন আদালতগুলোতে সরকারি আইনজীবীদের মামলা পরিচালনার দুর্বলতা ও অদক্ষতার কারণে প্রায় সব মামলায়ই সরকারপক্ষ হেরে যায়। সরকার হেরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে দেশ, জনগণ পরাজিত হওয়া। এই পরাজয়ের পরিণতি সুদূরপ্রসারী, যার মাশুল দেশ ও জাতিকে কড়ায়গণ্ডায় দিতে হয়।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রসিকিউশন ব্যবস্থা যখন পুলিশ বিভাগের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখনকার অবস্থা আর এখনকার অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। সিএসআই নিয়মিত কোর্টে থাকতেন, বাদীপক্ষে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতেন, জামিনের বিরোধিতা করতেন। এখনকার আমাদের প্রসিকিউশনের বন্ধুরা তদবির বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকেন, আসামিদের জামিন পাইয়ে দেওয়ার চুক্তি করেন। আসামিপক্ষের সঙ্গে তাদের ওঠাবসা, বাদীদের খবরও রাখেন না।
মাঝেমধ্যে হতবাক হতে হয়, আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তির পর আদালতে কোনো দিন আবেদনও উপস্থাপন করেনি, অথচ রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে বড় পদ দখল করে আছেন। প্রসিকিউশন ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলের দখলে আসার পরে মামলা নিষ্পত্তি ও সরকারপক্ষের মামলায় জেতার হার হতাশাজনক। কারণ পুলিশ প্রসিকিউশন কর্মকর্তাদের বিভাগীয় জবাবদিহিতার ব্যবস্থা ছিল। এখন আমাদের আইনজীবী বন্ধুরা কেউ মন্ত্রী, কেউ এমপি, কেউ আইনজীবী নেতার লোক। কে কার জবাব নেবে। জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকলে নিশ্চয় পরিস্থিতির অবনতি না হয়ে উন্নতি হতো। পরিণামে সরকার মামলা হারছে, নির্যাতিত মানুষ অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালত। সে আদালতেরই একটি অংশ হচ্ছে প্রসিকিউশন ব্যবস্থা। এ অংশটিতে পচন ধরেছে, অনেক আগে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের হীন স্বার্থে এর চিকিৎসা না করে আরো বেশি পচতে দিচ্ছে। আমরা শুধু বিচার নেই বিচার নেই বলে হাহাকার করছি। কিন্তু বিচারের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে আগে সরকারি আইনজীবী নিয়োগের নৈরাজ্য দূর করতে হবে। শৃঙ্খলা আনয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করে মেধা, যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : আইনজীবী