কোনো দেশে এমন ‘অন্ধ’ জুডিশিয়ারি নাই: মাসদার হোসেন

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৫, ১৯:১৬

বাংলাদেশে বিচারে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন বিচার ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য মাসদার হোসেন। তিনি কটাক্ষ করে বলেছেন, দুনিয়ার কোনো দেশে এমন ‘অন্ধ’ বিচার ব্যবস্থা নেই।
শুক্রবার সকালে ঢাকার পান্থপথে ‘ডি জুরি একাডেমি’ আয়োজিত ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংবিধানিক শাসন: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ পথচলা’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
সেমিনারটিতে একাডেমির শিক্ষার্থী, প্রশিক্ষক ও আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশে বিচারে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে কোরিয়ার উদাহরণ টানেন মাসদার। তিনি বলেন, “কোরিয়াতে একটি মামলা করবেন, প্রথমদিনেই যে একটা ক্লেইম স্টেটমেন্ট সাবমিট করবেন আর যাওয়া লাগবে না। অনলাইনে ডাকবে, ডিউ ডেইট এবং প্রথমদিনেই বলে দেবে কবে রায় হবে।”
“আর মাশাআল্লাহ আমাদের দেশে যদি একটা মামলা করে এর ফুলস্টপ নাই, কেয়ামত পর্যন্ত দাদা-নাতি…; আমি সিরাজগঞ্জ থাকতে ‘মাত্র’ ৭৪ বছর বয়সে সিভিল একটা মামলা ডিসপোজাল করেছি। তারপর হাইকোর্টে এসেছে, আরও ৭৪ বছর থাকবে। ১৪ পুরুষ শেষ। তো এটার রিফর্ম হওয়া উচিত। দুনিয়ার কোনো দেশে এইরকম অন্ধ, অপদার্থ জুডিশিয়ারি নাই।”
কে এই মাসদার
প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করার ক্ষেত্রে মাসদার হোসেন একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি সাবেক জেলা ও দায়রা জজ এবং বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব।
১৯৯৫ সালে তিনি এবং ৪৪১ জন বিচারক হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ এই মামলার রায়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার আদেশ দেয় এবং বিচার বিভাগের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় ১২ দফা নির্দেশনা দেয়। তবে আদালতে এখনও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে বলে সমালোচনা হয়।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ‘কেউ চায়নি’
ব্রিটিশ রাজ, পাকিস্তান আমাল আর বাংলাদেশ সরকার ১৮৬ বছরে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগকে প্রকৃত অর্থে আলাদা করতে পারেনি বলে মন্তব্য করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের এই সদস্য বলেন, “পেছনে একটা শক্তি আছে যারা চায় না বিচার বিভাগ আলাদা হোক। আর আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি অন্তরায় হয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব।
যারাই ক্ষমতায় এসেছে কেউ চায় না। কোনো নির্দিষ্ট দলের কথা বলছি না, তারা সবাই সমান। তারা তাদের স্বার্থকে, তাদের অবৈধ সুবিধাকে নিশ্চিত করার জন্য এস এ টুলস হিসেবে তারা এটাকে ব্যবহার করতে চায়। আর এজন্যই জুডিশিয়ারি আলাদা হচ্ছে না।”
তিনি বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো ও হাইকোর্টকে জনগণের কাছে নেওয়ার দাবি করেছেন। বলেন, “মানুষের দোরগোড়ায় হাইকোর্টকে আর লোয়ার কোর্টকে নিয়ে যান। আমার কাছে মুখ্য হলো- জনগণের বিচারপ্রাপ্তির অধিকারকে তার দৌড় গোড়ায় নিয়ে যাওয়া।
“বিশ্বের অনেক দেশে কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে প্রমাণ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। আমাদেরও তাই করা উচিত।”
‘আইন দিয়ে নির্যাতন নয়, ন্যায়বিচার করতে চাই’
আইনের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “বিখ্যাত বিচারক লর্ড ডেনিম বলেছেন, ‘আমি বিচারকের চেয়ারে বসে এই প্রচলিত আইন দিয়ে মানুষকে নির্যাতন করতে চাই না’।
“আমরাও আইন দিয়ে মানুষকে নির্যাতন করতে চাই না, আইন দিয়ে ন্যায়বিচার করতে চাই৷ আমি আমার ৩৬ বছরে বিচারক জীবনে আইন অনুসরণ করেছি মাত্র ১০ শতাংশ। ৯০ শতাংশ আমার বিবেচনামূলক ক্ষমতা ব্যবহার করেছি, বিবেচনামূলক ক্ষমতা দিয়ে ফাঁসি দিয়েছি।”
ডি জুরি একাডেমি কী?
ডি জুরি একাডেমি একটি বাংলাদেশভিত্তিক আইন শিক্ষার প্রতিষ্ঠান, যা আইনজীবী, বিচারক, ও আইন পেশায় আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও কোর্স পরিচালনা করে।
প্রতিষ্ঠানটি অনলাইন এবং অফলাইন উভয় মাধ্যমেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে, যার মধ্যে রয়েছে লাইভ ক্লাস, ভিডিও কোর্স, মক ভাইভা, এবং বিভিন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতি।