
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার বড় এক হাতিয়ারের নাম মামলা। কারও কারও ক্ষেত্রে তো এটি এক ধরনের নেশা, মতের অমিল হলেই ঠুকে দেয়া হয় মামলা। বিষয়টি এমন যে, ‘গঞ্জে যখন আইছি, মামলাডা কইরাই যাই!’
বাঙালির হাইকোর্ট দেখা ও দেখানোর স্বভাবটা আসলে বেশ পুরনো। এ কারণেই নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে দেশের উচ্চ আদালত পর্যন্ত দিন দিন বাড়ছে মামলার জট। আর বছরের পর বছর ধরে তা ঝুলে থাকায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তাই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ছোটখাটো বিরোধ স্থানীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রাম আদালত।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাদী-বিবাদীর পক্ষে মনোনীত দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে এটি গঠন হয়। মামলা করতে সর্বোচ্চ খরচ ২০ টাকা।
মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে ‘বেঙ্গল গ্রাম চৌকিদারি আইন-১৮৭০’ অনুযায়ী ‘পঞ্চায়েত’ নামে প্রথম সালিশি ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। ১৯১৯ সালে ‘বেঙ্গল ভিলেজ সেলফ গভর্মেন্ট আইন-১৯১৯’ এর মাধ্যমে কিছু ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিষয়ে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে চালু করা হয় ইউনিয়ন আদালত। প্রায় একই ধরনের ক্ষমতা দিয়ে ‘কনসিলিয়েশন কোর্টস অর্ডিন্যান্স-১৯৬১’ এর মাধ্যমে কনসিলিয়েশন কোর্ট প্রতিষ্ঠা হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালে ‘গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ-১৯৭৬’ এবং ২০০৬ সালে ‘গ্রাম আদালত আইন’ পাস হয়।
কম খরচে, সহজে, দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দুর্ভোগ কমানো ও অন্যায়ের প্রতিকারের জন্য আইনটিকে আরো শক্তিশালী করে সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে। এখন এ আইনে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে চলছে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও পারিবারিক বিচার।
সহজে ও স্বল্প সময়ে বিচারিক কার্যক্রম শেষ হলেও গ্রাম আদালত সম্পর্কে সাধারণ মানুষের রয়েছে নেতিবাচক ধারণা। রাজনৈতিক বিভাজন ও দুর্বৃত্তায়নের কারণে সেখানে তেমন কেউ যেতে চান না। অধিকাংশ সময় নোটিশের পরও হাজির হন না অভিযুক্তরা। কিন্তু সমন জারির এখতিয়ার না থাকায় তখন কিছু করারও থাকে না সংশ্লিষ্ট আদালতের। আবার সবকিছু সামলিয়ে বিচার হলেও রায় মানতে চান না অনেকেই। তাই ছোটখাটো বিষয়ে থানা কিংবা আদালতের দারস্থ হন গ্রামবাসী।
এজন্য অবশ্য গ্রাম আদালতের বিচারিক প্যানেলের পক্ষপাতিত্ব আচরণ ও দক্ষতার অভাবকেই দায়ী করছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দুর্বৃত্তায়িত ও বিভাজনের রাজনীতির কারণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আজ ভেঙে পড়েছে। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন ব্যবস্থা সুশাসনের পথ রুদ্ধ করেছে। ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছে। তবে দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে জনপ্রতিনিধিরা যদি মানুষের সেবা করার মানসিকতা লালন করেন তাহলেই কেবল গ্রাম আদালতগুলো সক্রিয় হতে পারে। সাধারণ মানুষ তখনই এটির প্রতি আস্থা রাখতে পারবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকেও বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। কিন্তু বর্তমানে নানান চাপে গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।’
যদিও সরকারি এক হিসেবে জানা যায়, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের আগস্ট- এ দুই বছরে দেশের ২৭ জেলার ১২৮টি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে এক লাখ ৩৩ হাজার ৬৬৪টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে গ্রাম আদালতে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে এক লাখ ৬ হাজার ৭০২টি। ক্ষতিপূরণ হিসেবে মামলার আবেদনকারীরা পেয়েছেন ১০৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে সাত হাজার ২৩টি মামলা গ্রাম আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে।
তবে গ্রাম আদালতের ওপর মানুষের আস্থা বাড়লে উচ্চ আদালতে মামলাজট কমবে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘গ্রামের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা আস্থা অর্জন করতে পারলে সাধারণ মানুষ ছোট ছোট সমস্যা নিয়ে গ্রাম আদালতের শরণাপন্ন হবেন। এতে ছোটখাটো মামলার মীমাংসা হবে খুব সহজেই। কর্মঘণ্টাও কমবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর।’
ইউএনডিপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় বর্তমানে গ্রাম আদালত পরিচালিত হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
দেশে দেশে গ্রাম আদালত
এ উপমহাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্যে স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষতিপূরণ ও আপস, মীমাংসা, সালিশের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। অনাদিকাল ধরে আমাদের দেশে মুরব্বিরা ছোটখাটো বিরোধের মীমাংসা করতেন, যাকে বলা হয় ‘সালিশ’ বা ‘দরবার’। এ ধারণাটিকেই আনুষ্ঠানিকতা ও আইনি কাঠামো দেয়ার লক্ষ্যে ‘গ্রাম আদালত আইন’ প্রণয়ন করা হয়।
ভারতে এ আদালত ‘পঞ্চায়েত’, আফগানিস্তানে ‘পাখতুন জিগরা’, মধ্যপ্রাচ্যে ‘সুলাহা’ নামে পরিচিত।
যেসব বিরোধ নিষ্পত্তি হয়
চুরি, ঝগড়া-বিবাদ, কলহ বা মারামারি, দাঙ্গা, প্রতারণা, ভয়ভীতি দেখানো বা হুমকি দেয়া, কোনো নারীর শালীনতাকে অমর্যাদা বা অপমানের উদ্দেশ্যে কথা বলা কিংবা তাকে উত্ত্যক্ত করা, গচ্ছিত কোনো মূল্যবান সম্পত্তি আত্মসাৎ, পাওনা টাকা আদায়, স্থাবর সম্পত্তির দখল ও পুনরুদ্ধার, অস্থাবর সম্পত্তি উদ্ধার বা তার মূল্য আদায়, কোনো অস্থাবর সম্পত্তির জবর দখল বা ক্ষতি করার জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়, গবাদিপশুর অনধিকার প্রবেশের কারণে ক্ষতিপূরণ, গবাদিপশু মেরে ফেলা বা গবাদিপশুর ক্ষতি করা, কৃষি শ্রমিকের পরিশোধযোগ্য মজুরি ও ক্ষতিপূরণ- আদায় এসব বিরোধ নিষ্পত্তির এখতিয়ার আছে গ্রাম আদালতের।
ফৌজদারির ক্ষেত্রে বিরোধীয় ঘটনা সংঘটনের ৩০ দিনের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হয়। দেওয়ানি মামলা করতে হবে ৬০ দিনের মধ্যে।
বিচারিক প্যানেল
সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানই গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান। বিচারিক প্যানেলে বাদী-বিবাদী (আবেদনকারী ও প্রতিবাদী) উভয়পক্ষের মনোনীত দুজন করে ও চেয়ারম্যানসহ পাঁচজন থাকেন। কোনো পক্ষ চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের পরিবর্তে অন্য কোনো ব্যক্তিকেও প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন করতে পারেন। মামলায় নারী স্বার্থসংশ্লিষ্ট হলে বিচারিক প্যানেলে নারী থাকেন।
চেয়ারম্যানের নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনো পক্ষ আপত্তি করলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে আবেদন করা যাবে। ইউএনও আবেদনটি যথাযথ মনে করলে ইউনিয়ন পরিষদের যেকোনো সদস্যকে গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করতে পারেন।
লাগে না কোনো আইনজীবী
দেশের মূলধারার বিচারব্যবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ভার ও আইন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ বিচার পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। তাই জনগণের কাছে স্থানীয় বিচারব্যবস্থার সুযোগ পৌঁছে দিতে গ্রাম আদালতগুলো সচল করেছে সরকার। এ আদালত ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে। আইনজীবী নিয়োগের বিধান না থাকায় নিজের কথা নিজেই বলতে পারেন বাদী ও বিবাদী।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ মশিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রচলিত বিচারব্যবস্থা জনসংখ্যার তুলনায় অপর্যাপ্ত। এ শূন্যতা পূরণে ছোটখাটো বিরোধ মিটাতে গ্রাম আদালত খুবই কার্যকর। নিষ্ক্রিয় আদালতগুলো পুরোপুরি সক্রিয় করতে পারলে মামলার জট কিছুটা হলেও কমবে। দুর্ভোগ থেকে রেহাই মিলবে সাধারণ মানুষের। তবে অবশ্যই সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে এসব আদালত তদারকি করাতে হবে। তাহলেই কেবল ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যেতে পারে। কেননা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অনেক ক্ষেত্রেই সুবিচার করেন না। বরং কখনো কখনো বিচারপ্রার্থীরা নির্যাতনের শিকার হন।’
তবে গ্রাম আদালতের বিরোধিতা করে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বিচার বিভাগের বাইরে স্থানীয় সরকার আলাদা কোনো আদালত সৃষ্টি করতে পারে না। আইন বিষয়ে অজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত নন, এমন লোকদের হাতে তো আর বিচারের ভার দেয়া যায় না। তাছাড়া ইউপি চেয়ারম্যানরা দলীয়ভাবে নির্বাচিত। দলীয় ব্যক্তি কীভাবে নিরপেক্ষ বিচার করেন?’
পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বিচার প্রশাসনকে উপজেলা পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। গ্রাম আদালত স্থাপন করতে হবে উপজেলা আদালতের অধীনে। তাহলেই কেবল মানুষ এর সুফল পাবে।’