
ফারাক্কা বাঁধ
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহমান দীর্ঘতম নদী গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের সর্বশেষ চুক্তিটির মেয়াদ শেষের দিকে। চুক্তি নবায়ন নিয়ে দুই দেশের আলোচনা শুরু হলেও এর ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান গত ৮ এপ্রিল সংবাদকর্মীদেরকে বলেছেন, “২০২৬ সালে মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের ক্ষেত্রে ভারতের সর্বোচ্চ সহযোগিতার প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ।”
চুক্তি নবায়নের আলোচনা দ্রুত শুরুর লক্ষ্যে ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
চুক্তি নবায়ন আলোচনা
গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তিটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। চুক্তি নবায়নের জন্য দুই দেশ এখন যৌথ কারিগরি কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। উভয় দেশ থেকেই তিনজন করে সদস্য এই কমিটিতে থাকবেন।
যৌথ নদী কমিশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছে, যারা সুপারিশ করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নতুন চুক্তি করতে হবে। সেই আলোকে বাংলাদেশ ভারতের নদী কমিশনকে যৌথ কারিগরি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেবে।
সম্প্রতি কলকাতা ও ফারাক্কায় যৌথ নদী কমিশনের ৮৬তম বৈঠকে চুক্তি নবায়নের বিষয়টি সরাসরি আলোচনায় ছিল না।
১৯৯৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানিপ্রবাহের ভিত্তিতে দুই দেশ পানি ভাগ করে নেয়। নির্দিষ্ট সময়কালে গ্যারান্টিযুক্ত পানি বণ্টনের ব্যবস্থাও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানিপ্রবাহে বৈচিত্র্য এসেছে, যা নতুন চুক্তিতে বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
নদী গবেষক শেখ রোকন বলেন, “উজানে, অর্থাৎ ভারতের উত্তরাখণ্ড, বিহারে বিভিন্ন ড্যাম ও ব্যারাজ দিয়ে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। পুরো নদীর পানিপ্রবাহ হিসেব করে ভাগাভাগি করতে হবে। শুধুমাত্র ফারাক্কার পয়েন্টের হিসাব করলে বাংলাদেশ ন্যায্য পানির হিস্যা পাবে না।”
দুই দেশের যত চুক্তি, তাতে কী ছিল
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৯৭৭ সালের ৫ বছর মেয়াদি চুক্তিতে স্পষ্টভাবে গ্যারান্টি ক্লজ ছিল। সে অনুযায়ী, ফারাক্কায় পানির প্রবাহ ৫৫ হাজার কিউসেক বা তার বেশি হলে বাংলাদেশ পেত ৩৪ হাজার ৫০০ কিউসেক। কম হলেও কমপক্ষে ২৭ হাজার ৬০০ কিউসেক পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল।
কিন্তু ১৯৮২ সালের সমঝোতা স্মারকে এই গ্যারান্টি ক্লজ বাদ দেওয়া হয়, যা বাংলাদেশের পানি-অধিকারকে দুর্বল করে তোলে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেন।
১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সময়েও কোনো শক্তিশালী গ্যারান্টি ছিল না। ১৯৯৬ সালে দুই দেশ ৩০ বছর মেয়াদি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি করে, যেখানে সরাসরি ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ না থাকলেও ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত প্রতি ১০ দিনে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি বণ্টনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এটি গ্যারান্টি ক্লজের বিকল্প হিসেবে কাজ করে।
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, “নতুন চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ থাকলে ভালো। ৯৬ সালের চুক্তিতে গ্যারান্টি ক্লজ নেই, তবে আর্টিকেল ২-এ যা যা বলা আছে, সেটা বহাল থাকলেও ভালো।”
চুক্তিতে কী বিবেচনা
১৯৯৬ সালের তৎকালীন চুক্তিটি হয়েছিল ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ সালের গঙ্গার গড় পানিপ্রবাহের তথ্যের ভিত্তিতে।
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন, উজানে ভারতের পানি প্রত্যাহার ও ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে গঙ্গার পানিপ্রবাহে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ফলে চুক্তি নবায়নে নতুন বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বিবেচনায় নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে
এ অবস্থায় স্থায়ী চুক্তিই ন্যায্য সমাধান বলে মন্তব্য করেছেন শেখ রোকন। তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে ভারত বলেছে—শুধু পানি নয়, ঘাটতিও ভাগাভাগি করতে হবে। সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ তার নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ফারাক্কা পয়েন্টে পানি কমেছে। ফলে বাংলাদেশের দাবি হওয়া উচিত—চুক্তিটি স্থায়ী হতে হবে’।”
স্থায়ী চুক্তির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, “গঙ্গা চুক্তিটি হতে হবে মেয়াদবিহীন। আগের চুক্তিটি পুরো পানিই ভাগাভাগির ফর্মুলায় করা হয়েছিল। কিন্তু নদীর স্বাভাবিক গতি বজায় রাখার বিষয়টি মাথায় রেখে নতুন চুক্তি করতে হবে। ২৫ শতাংশ পানি নদীর জন্য রেখে বাকি পানির সুষ্ঠু বণ্টন করতে হবে। এবং শুধুমাত্র গঙ্গা নদী নয়, গঙ্গা অববাহিকা-ভিত্তিক সব নদীর জন্য চুক্তিটি করতে হবে।”
আন্তর্জাতিক প্রস্তুতির পরামর্শ
গঙ্গাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন প্রশ্নে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এ সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে অন্যতম প্রস্তাব হচ্ছে গঙ্গার প্রধান উৎস নেপালের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা। পানি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতির পরামর্শও রয়েছে।
শেখ রোকন বলেন, ‘‘বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘের নদী বিষয়ক দুই কনভেনশন (ইউএনডাব্লিউসি-১৯৯২ এবং ইউএনডাব্লিউপিসি-১৯৯৭) সই করা। সরকারের একটির বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলো আন্তর্জাতিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।’’
নবায়ন হলে নতুন গ্যারান্টি ক্লজের দাবি
ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে সৃষ্ট পানির সংকট সমাধানে ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করে নতুন গ্যারান্টি ক্লজসহ চুক্তি নবায়নের দাবি জানিয়েছে কেউ কেউ।
‘ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ উদযাপন কমিটি’ বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, “ফারাক্কা ব্যারাজের প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি সংকট দিন দিন ভয়াবহ আকার নিচ্ছে। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আর্সেনিকের উপস্থিতি বাড়ায় অনেক জেলায় নলকূপের পানি আর পানযোগ্য নয়।
“দক্ষিণাঞ্চলে উজানের পানির ঘাটতির কারণে লবণাক্ততা বেড়েছে, যার ফলে ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে এবং সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে।”
ফারাক্কা বাঁধে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়।
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস
ফারাক্কা বাঁধের পরিকল্পনার গোড়াপত্তন ঘটে ব্রিটিশ আমলে, ১৯১৯ সালে। সে সময় হুগলি নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য গঙ্গার অতিরিক্ত পানি হুগলিতে প্রবাহিত করার প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাব ভিত্তি করেই পরে ফারাক্কা প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি হয়।
পরবর্তী দশকগুলোতে একাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং রিপোর্ট ও হাইড্রোলজিক্যাল জরিপ চালিয়ে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করে। তবে তারা সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
লেখক কে এন সিনহা ২০১৪ সালে ইন্ডিয়া ওয়াটার জার্নালে লিখেছেন, ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সালে এই প্রকল্প নতুনভাবে রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার পায় এবং ১৯৬১ সালে তা চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। ওই বছরই শুরু হয় নির্মাণ কাজ।
১৯৭০ সালের মধ্যে বেশিরভাগ নির্মাণ শেষ হয়। বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২ হাজার ২৪০ মিটারভ বনে ফিডার খালের দৈর্ঘ্য ৩৮ কিলোমিটার। এই খালই গঙ্গার পানি হুগলিতে নিয়ে যায়।
দীর্ঘ নির্মাণপ্রক্রিয়া শেষে ভারত সরকার ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে।
এই বাঁধ চালু করাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় দ্বিপাক্ষিক টানাপোড়েন।
ফারাক্কার প্রভাব
ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর পদ্মা নদীর পানিপ্রবাহে শুষ্ক মৌসুমে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সময়কালে পানিপ্রবাহ বিপজ্জনকভাবে কমে যায়, যা কৃষি, মৎস্য এবং পরিবেশের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
গবেষক মোস্তাফিজুর রহমান ২০২১ সালে তার এক প্রতিবেদনে জানান, ফারাক্কা চালুর পর গ্রীষ্মকালে পদ্মায় পানির প্রবাহ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
নদী গবেষক কাজী নূরুল ইসলাম ২০১৯ সাল লিখেছেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে অনেক সময় পদ্মার পানিপ্রবাহ ১০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে গিয়েছিল, যেখানে প্রয়োজন ছিল অন্তত ৫৫ থেকে ৭০ হাজার কিউসেক।
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের শেখ রোকনের বই নদী ও জীবনে লেখা আছে, এই প্রবাহ হ্রাসের কারণে নদীর তলদেশে পলি জমে তা উঁচু হয়ে গেছে এবং বহু শাখা নদী শুকিয়ে গেছে বলে জানান।
পানি সংকটে কৃষিতে সেচ বাধাগ্রস্ত হয়, বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ধান, পাট ও সবজির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনুন নিশাত ২০১৮ সালের জল ও পরিবেশ জার্নালে লিখেছেন, ফারাক্কার কারণে এই অঞ্চলে কৃষি উৎপাদনে দীর্ঘমেয়াদি ধস নেমেছে।
ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বাড়ায় পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে।
মাছের উৎপাদনেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পদ্মার দেশীয় অনেক মাছ হারিয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে রয়েছে।
বাঁধ ভেঙে ফেলতে ভারতে জোর দাবি
এই বাঁধের ফলে ভারতেও পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। এ কারণে বাঁধটি ভেঙে ফেলার দাবি উঠেছে সে দেশেও।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষক, স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশবাদীরা গত কয়েক বছর ধরেই বলছেন, বাঁধের কারণে নদীর স্বাভাবিক জলপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যার ফলে অনেক শাখা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে এবং স্থানীয় মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাঁধটি ভেঙে দেওয়ার দাবিতে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় এই দাবিকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছিল।
২০০০-এর দশকে বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার দিল্লিতে চিঠি লিখে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার দাবি জানান। সেই চিঠিতে তিনি গঙ্গা নদীর পানির অভাবে বিহার ও প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর ক্ষতির বিষয় তুলে ধরেছিলেন।
তবে ভারতের সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনও এই দাবি মানেনি।