Logo
×

Follow Us

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

‘গোলাপি ধোঁকা’য় রাজধানীবাসী

Icon

নিশাত বিজয়

প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৫, ১৯:৫৪

‘গোলাপি ধোঁকা’য় রাজধানীবাসী

থামার কথা কাউন্টরে কিন্তু যত্রতত্র থামাই যেন নিয়ম গোলাপি বাসের

সকাল সাড়ে আটটা। বছিলা বাসস্ট্যান্ড থেকে মিরপুরগামী যাত্রী নুরুন নাহার দাঁড়িয়ে ছিলেন ‘গোলাপি বাস’-এর জন্য। প্রজাপতি বা পরীস্থান পরিবহনের যেকোনো একটি আসলেই উঠবেন তিনি। পাঁচ মিনিট অপেক্ষার পরে বাস আসলেও সেটি থামেনি নির্ধারিত বাসস্টপে।

এরপরের বাসে ওঠার সুযোগ পান তিনি। তবে বছিলা থেকে মোহাম্মাদপুর তিন রাস্তা মোড় যেতে লেগে যায় আধা ঘণ্টা। পথে কোনো যানজট না থাকলেও থেমে থেমে যাত্রী তোলায় এই সময় লাগে। বাসে তিল ধারণের জায়গা না থাকলেও মোহাম্মাদপুর বাস স্ট্যান্ডে আবারও ১৫ মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।

এই সড়কে চলাচল করা আরেক কর্মজীবী নারী সালেহা বেগম বলেন, “সকালে বছিলার থেকে মিরপুর যাওয়ার সময় উঠতে পারি সিট খালি থাকায়। কিন্তু ফিরতি পথে উঠতে কমপক্ষে ঘণ্টাখানেক লাগে। ঠিকমতো বাস আসে না।”

এই ভোগান্তি শুধু সালেহার কিংবা নুরুন নাহারের নয়, প্রতিদিন রাজধানীর হাজারো নারী এমন সমস্যার মুখে পড়ছেন। বাস স্টপ ভিত্তিক পরিবহন সেবা চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরিবহন মালিক সমিতির ‘গোলাপি বাস’ এখন তথৈবচ। চালু হওয়ার সময় কথা ছিল- এগুলো শুধু কাউন্টারে থামবে। কিন্তু কথা শুধু কথাতেই রয়ে গেছে।

গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দ্বায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী কমিটি। এরপর এই কমিটি গত ৬ ফেব্রুয়ারি ‘গোলাপি বাস’ চালু করে।

ঘোষণা হয়েছিল, এই বাসগুলো নির্ধারিত বাস স্টপ ছাড়া অন্য কোথাও দাঁড়াবে না। নির্দিষ্ট রুট ও নির্ধারিত ভাড়ায় চলবে।

এই সার্ভিস উদ্বোধন করার সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছিলেন, “শুধু অভ্যাসের পরিবর্তন করলেই ঢাকার পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব।”

বাস্তবে ‘অভ্যাসের পরিবর্তন’ হয়নি। ঢাকার নগর পরিবহনেও আসেনি কোনো পরিবর্তন।

তখন মালিক সমিতি বলেছিল, নগরবাসীর জন্য এটা হবে একটি ‘পরিকল্পিত শহুরে পরিবহন সেবা’। কিন্তু বাস্তব বলছে ভিন্ন কথা।

শুরুতে কয়েকদিন বাসগুলো কিছুটা নিয়ম মানলেও পরে আবার আগের চিত্র ফিরে আসে। রাস্তায় এখন যত্রতত্র বাস থামে। হেলপাররা হাঁক দিয়ে যাত্রী তোলেন। বাসচালকরা নামে প্রতিযোগিতায়; তোয়াক্কা করে না ট্রাফিক আইনের।

ঢাকা সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) ডেপুটি ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ধ্রুব আলম বলেন, প্রকল্পটি তাদের তত্ত্বাবধানে না থাকায় তারা কিছু করতে পারছেন না।

তিনি বলেন, “মালিক সমিতিই এটি পরিচালনা করছে। ফলে নিয়ম না মানলে আমাদের কিছু করার নেই।”

কাউন্টার ছেড়ে সামনে এগোলেও থেমে থেমে যাত্রী তোলে গোলাপি বাস


তিনবারের ব্যর্থতা

রাজধানী ঢাকার সড়ক শৃঙ্খলায় আনতে আগে তিনবার চেষ্টা করেছিল সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তবে প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রান্সসিলভা পরিবহনে ই-টিকেটিং ব্যবস্থা চালু করে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। এরপর আরও একাধিক রুটে ভাড়া নেওয়া, টিকিট দেওয়া ও যাত্রী ওঠানামা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ব্যবস্থা চালু হয়।

শুরুর দিকে কিছু বাসে মোবাইল অ্যাপ ও মেশিন ব্যবহার করলেও পরে মালিক ও হেলপারদের চাপে আবার কাগুজে টিকিটে ফিরতে হয়। যাত্রীদের অভিযোগ ছিল, প্রযুক্তির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের হয়রানি আগের মতোই রয়ে গেছে।

২০২১ সালে সিটি করপোরেশন ও ডিটিসিএ ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে একটি একক ব্যবস্থাপনা চালু করে। এক রঙের বাস, নির্ধারিত ভাড়া ও সময়ানুবর্তিতা—সবই ছিল এই প্রকল্পের অংশ।

কিন্তু কয়েক মাস পর দেখা যায়, বাসগুলো আবার মালিক সমিতির চাপে ভিন্ন রুটে যাচ্ছে। কার্যত নিয়ন্ত্রণ হারায় সিটি করপোরেশন। টেকেনি ওই ব্যবস্থা।

এই ধারাবাহিক ব্যর্থতার তালিকায় আছে ‘সিটিং সার্ভিস’ নামেও পরিচিত ওয়েবিল চালু ব্যবস্থা। এটি মূলত ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে চালু হয়। উদ্দেশ্য ছিল সীমিত স্টপেজে বাস থামিয়ে দ্রুত সেবা দেওয়া।

যদিও আজিমপুর-গাজীপুর রুটের বিকাশ পরিবহন, ঘাটারচর-রামপুরা রুটে রমজান পরিবহন, মোহাম্মাদপুর-কমলাপুর রুটের মিডলাইন পরিবহনে এখনও ‘ওয়েবিল সার্ভিস’ চালু রয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে এই ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হয় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কৌশল হিসেবে। বাসগুলো পুরো রুটে যাত্রী তোলে, নেয় দ্বিগুণ ভাড়া। ‘সিটিং সার্ভিস’ নামের এই ব্যবস্থাকে যাত্রীরা অনেকে বলেন ‘চিটিং সার্ভিস’।

রমজান পরিবহনের যাত্রী কাওসার হোসেন বলেন, “আমি কাঁটাবন থেকে কাকরাইলে টিউশনিতে যাই। এখানে ভাড়া ১০ টাকা আসলেও রমনা পার্কের ওখানে ওয়েবিল স্টপেজ থাকায় আমাকে ২৫ টাকা দেওয়া লাগে।”

একই চক্রে পড়েছে গোলাপি বাস প্রকল্প। স্টপেজ ভিত্তিক সার্ভিস চালু হলেও নিয়ম মানা হচ্ছে না। নাম বদলেছে, রং বদলেছে—কিন্তু চলন বদলায়নি।

সবচেয়ে দুর্ভোগে নারীরা

গোলাপি বাস যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হয়েছিল তা এখন শুধুই মুখের কথা। ভবিষ্যতের সুশৃঙ্খল নগর পরিবহনের প্রতিশ্রুতি, বাস্তবে এখন যেন ধোঁকা।

রওশন আরা নামের এক যাত্রী বলেন, “আমি নিয়মিত ঢাকা থেকে সাভারে যাতায়াত করি। কিন্তু কোনো সময়েই নারীদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে শুধু নারীদের দেখি না, সেখানে পুরুষরা বসে থাকেন। অসুস্থ অবস্থায় থাকলেও কোন নারী উঠলেও তাদেরকে সিট ছেড়ে দেন না।”

একই চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ), ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ), ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা পৃথক জরিপেও।

বিআরটিএ’র ২০২৩ সালের একটি যাত্রী জরিপে ৭২% নারী জানিয়েছেন, ‘বাসে উঠতে সমস্যায় পড়েন কারণ স্টপেজে বাস দাঁড়ায় না।’

৪৬% নারী জানিয়েছেন, তারা বাস না পেয়ে বিকল্প যানবাহন নিতে বাধ্য হন, যার খরচ প্রায় দ্বিগুণ।

বিআরটিএর ২০২৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮৩% বাস চালক স্বীকার করেছেন, তারা প্রতিদিন নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী যাত্রী তুলতে বাধ্য হন। ফলে তারা স্টপ মানেন না, ভাড়া নিয়ে কারচুপি করেন।

ডিটিসিএ’র ২০২৩ সালের পরিবহন পর্যালোচনায় বলা হয়, “ঢাকার কর্মজীবী যাত্রীরা দিনে গড়ে ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট সময় নষ্ট করেন শুধু বাসের জন্য অপেক্ষা ও যাতায়াতে, যা প্রোডাক্টিভ সময়ের ২০%।”

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) ২০২২ সালে জানায়, “শহরে চলাচলকারী বাসের ৭৫% এর বেশি নির্ধারিত স্টপেজে থামে না, ফলে যাত্রী ও ট্রাফিক উভয়েরই সমস্যা বাড়ে।”

এই অনিয়মের কারণে যানজট তৈরি হয় এবং প্রতিদিন প্রায় ৩২ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

বিশ্ব ব্যাংকের ২০২৩ সালের আরবান ট্রান্সপোর্ট রিপোর্ট বলছে, “ঢাকার পরিবহন খাতে সময় ও অর্থ অপচয়ের কারণে প্রতিবছর ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা) ক্ষতি হয়।”

বিআরটিএর ২০২৩ সালের জরিপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ঢাকার বাস যাত্রীদের প্রায় ৬৫% অভিযোগ করেছেন, বাস চালক ও হেলপারদের আচরণ অভদ্র এবং অনিয়মিত।”

একই জরিপে ৫৮% যাত্রী জানান, বাসের ভেতরে নিরাপত্তার অভাবের কারণে তারা বিশেষ করে সন্ধ্যার পর বাসে উঠতে ভয় পান।

কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা

নগরের গণপরিবহন নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে। তিনি বলেন, “ঢাকায় বাস মালিকরা এতটা শক্তিশালী যে সরকারও তাদের বিপক্ষে যেতে চায় না। ফলে পরিকল্পনা যতই হোক, বাস্তবায়নে গিয়ে ধসে পড়ে।”

ঢাকার সড়কে কেন বারবার চেষ্টা করেও শৃঙ্খলা আসছে না-এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি এম এ বাতেন বলেন, “আমরা ব্যর্থ হয়েছি কারণ অধিকাংশ বাসই চুক্তিভিত্তিক চলে। মালিকদের থেকে দৈনিক চুক্তিতে ড্রাইভাররা ভাড়া নেয়। মালিককে যদি ৩ হাজার টাকা দেয় তাহলে ড্রাইভারের আয় হয় ৬ হাজার টাকা। নিয়মে চললে ড্রাইভারের আয় কমে যায়, এজন্য তারা নিয়ম মানেন না।”

ড্রাইভারদেরকে মাসিক বেতনে কেন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ড্রাইভাররা মাসিক বেতনে আগ্রহী না। মাসিক বেতন হলে তারা হয়ত সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ হাজার টাকা পাবে। কিন্তু দৈনিক চুক্তিতে তাদের লাভ অনেক বেশি। এজন্য তাদের পাওয়া যায় না।”

এ পরিস্থিতির কোন সমাধান কী নেই- জানতে চাইলে এম এ বাতেন বলেন, “জাপানি প্রকৌশলীদের সঙ্গে আমাদের ও পুলিশদের সাথে রবিবার একটি মিটিং আছে। আমরা ভাবছি কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।”

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫