
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া প্রথম পূর্ণাঙ্গ রঙিন ছবি প্রকাশ করে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-নাসা
‘আমার লক্ষ্য অতি সাধারণ। মহাবিশ্বের একটি পরিপূর্ণ বোঝাপড়াই আমার লক্ষ্য। এর বিদ্যমান প্রকরণ, কারণ এবং এর অস্তিত্বই এখানে মুখ্য প্রশ্ন।’- স্টিফেন হকিং সেই প্রাচীনকাল থেকেই অনন্ত মহাকাশ নিয়ে আমাদের আগ্রহ। আদিম যুগের মানুষ অবাক হয়ে রাতের তারকাখচিত আকাশের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকত। তারা সূর্যকে দেবতার আসনে স্থাপন করে তার উপাসনা করেছে- এমন অসংখ্য নজির বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি। যিশু খ্রিষ্টের জন্মের প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্র মানুষকে নতুন নতুন চিন্তা করতে শিখিয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর থেকে ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একটি বড় সময় কোনো যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই মানুষকে খালি চোখে আকাশ নিরীক্ষা করতে হয়েছে। পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন গবেষণা পদ্ধতির সূচনা হয়। পোলিশ জ্যোতির্বিদ নিকোলাস কোপার্নিকাস ষোলো শতকের প্রথম ভাগে সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বতত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তাকে তৎকালীন বিজ্ঞান সংস্থা, সমাজ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতি কিন্তু এসব বিরোধিতার কারণে থেমে থাকেনি। প্রতিনিয়তই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশগঙ্গা, ধূমকেতু প্রভৃতি সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য দিয়ে আমাদের চমকে দিচ্ছেন।
১২ জুলাই, ২০২২ দিনটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে যেন স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এই দিনে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া প্রথম পূর্ণাঙ্গ রঙিন ছবি প্রকাশ করেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-নাসা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের নেয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা দিয়ে প্রথম তোলা ছবিগুলোর ভেতর থেকে একটি এদিন প্রকাশ করেন। প্রকাশিত ছবিটি SMACS 0723 গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের। বলা হচ্ছে ছবিটিতে আজ থেকে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছরের আগের মহাবিশ্বের একটি অংশকে ধারণ করা হয়েছে!
জেমস
ওয়েবের তোলা ছবি প্রকাশ করতে গিয়ে বাইডেন বলেন, ‘এ ছবিগুলো বিশ্বকে মনে করিয়ে দেবে,
যুক্তরাষ্ট্র অনেক বড় বড় কাজ করবার ক্ষমতা রাখে। মার্কিন জনগণকে, বিশেষ করে আমাদের
শিশুদের মনে করিয়ে দেবে যে, আমরা পারি না এমন কিছুই নেই।’ নাসার ফ্ল্যাগশিপ মিশন খ্যাত
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপটি আসলে হাবল টেলিস্কোপের উত্তরসূরি। প্রথম প্রকাশ পাওয়া
জেমস ওয়েবের তোলা ঐতিহাসিক ছবিটির বিশেষত্ব হলো, এটি ৪৬০ কোটি বছর আগের সুদূর মহাবিশ্বের
ক্লাস্টার অব গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা সম্মেলনের ছবি। ‘ডিপ ফিল্ড ইমেজ’ হলো মহাবিশ্বের
কোনো অংশের ছবি যখন দীর্ঘ সময় নিয়ে তোলা হয়। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের তোলা ছবিটির ক্ষেত্রে
সে সময়টি ছিল প্রায় সাড়ে বারো ঘণ্টার মতো। নাসার আগের হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে যেসব
জ্যোতিষ্ক দেখতে পাওয়া যেত না, সেগুলোও এবার অনায়াসে দেখা গিয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের
সাহায্যে। জেমস ওয়েবের তোলা ছবিটি মহাবিশ্বের বিশালত্বের তুলনায় যেন এক ধূলিকণার সমান।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের প্রধান মিশন হলো মহাবিশ্বের আদিম আকাশগঙ্গা বা ছায়াপথগুলোর ইতিহাস
ও বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের সামনে উন্মোচন করা। এই টেলিস্কোপের ১০ বছরের পরিকল্পিত মিশনের
এখন পর্যন্ত ছয় মাসের মতো সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। আকাশগঙ্গা সম্মেলনের ছবিটি ছাড়াও নাসা
সম্প্রতি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ধারণকৃত মহাবিশ্বের আরো কিছু ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে।
মহাবিশ্বের আদিমতম সময়ের এই ছবিটিতে সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল ও লম্বাটে যেসব দাগ দেখা যাচ্ছে,
সেগুলো পৃথিবীর আবাসস্থল আকাশগঙ্গা ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির প্রতিবেশী তারকা।
এ ছাড়া অন্য আলোকবিন্দুগুলো কিন্তু একেকটি ছায়াপথ, নক্ষত্র কিংবা গ্রহ।
আমরা
যখন সূর্যের দিকে তাকাই তখন কিন্তু আট মিনিট ১৮ সেকেন্ড আগের সূর্য দেখতে পাই। আমরা
কখনো আমাদের বর্তমান সময়ের সূর্য দেখতে পাই না। তার কারণ হলো, আলো আমাদের চোখে এসে
পৌঁছাতে প্রায় আট মিনিট ১৮ সেকেন্ডের মতো সময়ের প্রয়োজন হয়। এখন যদি সহজ করে বলি,
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে তোলা এই ছবিটির ক্লাস্টার অব গ্যালাক্সি থেকে আলো এসে পৌঁছাতে
৪৬০ কোটি বছর লেগেছে। এত দূরের বস্তু ঝাপসা থাকবার কথা, কিন্তু এখানে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের
ছবিগুলোতে সেগুলো বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অনেক ছায়াপথের ছবি যেন কিছুটা বেঁকে আছে।
এটি হলো স্থান-কাল বক্রতা। জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি অনুসারে, ছবির কেন্দ্রে থাকা
ক্লাস্টার অব গ্যালাক্সি মাধ্যাকর্ষণজনিত বলের কারণে স্থান-কাল-বক্রতা সৃষ্টি হয়েছে।
এ ছাড়া জেমস ওয়েবের ধারণকৃত ছবিটিতে যে গ্যালাক্সি ক্লাস্টার রয়েছে তার মোট ভর এত বেশি
যে, সেটি মহাকর্ষিক লেন্স হিসেবে কাজ করছে। সেই লেন্সের মাধ্যমে পেছনের আরো দূরের ক্ষুদ্র
ক্ষুদ্র আলোকবিন্দুগুলো যেন বড় হয়ে দেখা যাচ্ছে। সেসব আলোকবিন্দুগুলো কিন্তু একেকটি
অদেখা ছায়াপথ, সেখানেও রয়েছে অগণিত গ্রহ-উপগ্রহ এখানে আপনারা বিভিন্ন রঙের গ্যালাক্সি
বা তারকারাজি দেখতে পারছেন। তবে মূল ছবিগুলো কিন্তু এমন বিভিন্ন রঙের নয়।
সেই আশি-নব্বইয়ের দশকের দিকগুলোর কথা একটু মনে করুন।
তখনকার দিনে তো এমন ডিএসএলআর ক্যামেরা বা উচ্চ প্রযুক্তির স্মার্টফোন মোটেও সহজলভ্য
ছিল না। তখন আমরা কোনো ছবি তুলতে চাইলে আব্বা কাছের কোনো স্টুডিওতে নিয়ে যেতেন। আমরা
ফটো তুললে তখন ছবিটির একটি নেগেটিভ দোকানদারের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিতাম। সেই নেগেটিভ
দিয়েই পরবর্তী সময়ে নতুন কোনো ছবির প্রয়োজন হলে ওয়াশ করে নেওয়া হতো। এই ছবিটিও আসলে
এমন একটি বর্ণহীন ছবি, বলা যেতে পারে সাদাকালো একটি ছবি। এই সাদাকালো ছবিগুলো নাসা
প্রকাশ করার সময় রঙিন কীভাবে হলো? তাহলে কি ছবিগুলোকে এডিট করা হয়েছে? আসলে আমাদের
মহাবিশ্বে অবস্থিত নক্ষত্রগুলোর তাপমাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। ফলে এগুলো থেকে যে আলো বাইরে
আসে, সেটাও ভিন্ন হয়। বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য একে অপরের থেকে আলাদা। নীল বা
ভায়োলেট রঙের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম, তাই এই রঙের আলো সবচেয়ে কম দূরত্ব অতিক্রম করে।
অন্যদিকে লাল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি, তাই লাল আলো সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রম
করে। ঝ ০৭২ঝগঅঈ৩ গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের ইনফারেড ছবিটিকে এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে ভিত্তিতে
রঙিন করা হয়েছে। ছবিটিতে লাল রঙের যে বিন্দুগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো সবচেয়ে দূরে অবস্থিত।
একইভাবে অন্যান্য রঙের বস্তুগুলো আমাদের পৃথিবী থেকে বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত। জেমস
ওয়েব টেলিস্কোপটিকে ২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার ফরাসি গায়ানার কুরু শহরে
অবস্থিত গায়ানা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে ফরাসি বাণিজ্যিক রকেট উৎক্ষেপণ কোম্পানি আরিয়ানেস্পাসের
তত্ত্বাবধানে একটি আরিয়ান ৫ রকেটের মাধ্যমে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়।
টেলিস্কোপটি
উৎক্ষেপণের মূল লক্ষ্য হলো ছায়াপথের জন্ম ও বিবর্তন এবং নক্ষত্র ও গ্রহগুলোর সৃষ্টি
সংক্রান্ত গবেষণা করা। সম্প্রতি বিগ ব্যাং সংঘটিত হওয়ার পর মহাবিশ্বে প্রথম যে আলোর
সৃষ্টি হয়েছিল, তার ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। বিগ ব্যাংয়ের প্রায় ৩৩ কোটি বছর পর এই আলোর আবির্ভাব ঘটেছে,
অন্তত বিজ্ঞানীরা এমনটাই দাবি করছেন। সে সময় হাইড্রোজেন গ্যাসের ঘন কুয়াশার কারণে অন্ধকার
ভেদ করে আলো ছড়িয়ে পড়া বেশ কঠিন ছিল। তবে জেডস বা জেএডিইএস-জিএস-জেড১৩-এলএ নামের এক
ছায়াপথ থেকে যেভাবেই হোক, এই আলো ছড়িয়ে পড়েছে, যা ধরা পড়েছে জেমস ওয়েবের রাডারে। জেডস
নামের ছায়াপথটি মহাবিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী ছায়াপথের মধ্যে একটি। ২০২৫ সালে এর পাঠানো
মহাবিশ্বের নতুন ছবিগুলোকে আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার নতুন যুগের সূচনা বলতে
পারি। আশা করা যায়, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ অদূর ভবিষ্যতে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্বতত্ত্বের
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গবেষণার দ্বার উন্মোচন করবে। মানুষের বসবাসযোগ্য সম্ভাব্য
এক্সোপ্লানেটগুলোর আবহমণ্ডলের বিস্তারিত খুঁটিনাটি জানাও সম্ভব হবে। উপরন্তু এটি সৌরজগতের
অন্যান্য গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহের বিষয়ে আমাদের আরো নতুন নতুন তথ্য দিতে সক্ষম হবে।
লেখক: চিকিৎসক, বিজ্ঞান লেখক ও অনুবাদক
তথ্যসূত্র
: নাসা, বিবিসি, দ্যা সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান, ডেইলি মেইল, অ্যাস্ট্রনমি টুডে