
বাংলাদেশের পুরোনো পত্রিকাগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘দৈনিক ইত্তেফাক’। মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ১৯৫৪-এর মার্চে দৈনিকে রূপান্তরিত হয়, এর ঠিক দুই মাসের মাথায় এক রাতের ব্যবধানে ভাসানীর হাত থেকে কার্যত ছিনিয়ে নেওয়া হয় পত্রিকাটি। সেই ঘটনার ৭০ বছর পেরিয়েছে সদ্য। একসময় যে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার ওপরের কোণে লেখা হতো ‘প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’ হঠাৎ করেই একই জায়গায় লেখা হতে থাকল ‘তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া’র নাম। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে তোলপাড়ও কম হয়নি। ইত্তেফাকের ইতিহাসের সেই ‘আলোচিত-সমালোচিত’ অধ্যায় নিয়ে আজও চর্চা হয় লেখক-গবেষক কিংবা বুদ্ধিজীবী মহলে। ইত্তেফাকের জন্ম আওয়ামী লীগ গঠনের পর ভাসানী একটি দৈনিক পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তারাই সূত্রধরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাহায্য চাইলেন তিনি। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী তাকে ফিরিয়ে দিলেন। সোহরাওয়ার্দী ফিরিয়ে দিলেও ভাসানী থেমে যাননি। মওলানার রাজনৈতিক ইতিহাসে কখনোই অর্থনৈতিক সংকটে জনকল্যাণকর কাজে ঠেকে থাকেননি। মওলানা যেকোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নে গণচাঁদার সাহায্য নিতেন। ইত্তেফাকের ক্ষেত্রেও তিনি গণচাঁদার সাহায্য নেন। এ বিষয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘ভাসানী চরিতÑমওলানা ভাসানীর পূর্ণাঙ্গ জীবনী’তে উল্লেখ করেছেন, ‘মওলানা ইত্তেফাক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। জুলাই মাসে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত এক ঘরোয়া সভায় তিনি এই পত্রিকা প্রকাশের কথা ঘোষণা করেন। উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে আবেদন করেন সাধ্যমতো চাঁদা দিতে। তৎক্ষণাৎ চারশ টাকার মতো ওঠে, ইত্তেফাক প্রকাশের প্রথম তহবিল। দেশের অন্যান্য জায়গা ঘুরে তিনি আরো চাঁদা তোলেন। সেই টাকায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক আত্মপ্রকাশ করে ১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট। প্রথম অফিস ছিল ৭৭ মালিটোলা, পরে ৯৪ নবাবপুর রোডের আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিস থেকেই তা বের করা হতো। শুরুতে সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন মওলানা ভাসানী। কিছুকাল পরে প্রকাশনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। পরে এর সম্পাদক নিযুক্ত হন তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া)।’
কে ছিলেন মানিক মিয়া?
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী। যদিও ইত্তেফাকের সম্পাদক হওয়ার আগে তিনি তেমন পরিচিত বা প্রভাবশালী ছিলেন না। মানিক মিয়া বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে ১৯৩৫ সালে বি এ পাস করেন। পিরোজপুর মহকুমা হাকিমের আদালতে সহকারী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু। পরবর্তী সময়ে তিনি বরিশালে জেলা জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে নিয়োগ লাভ করেন। বরিশালে কর্মরত থাকাকালে ১৯৪৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর কথায় সরকারি চাকরি ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কার্যালয়ে সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি এই চাকরি ছেড়ে হাশিম-সোহরাওয়ার্দীর প্রতিষ্ঠিত দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার পরিচালনা বোর্ডের সেক্রেটারি পদে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে কলকাতা ছেড়ে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় ফেরার পর বেকার জীবন যাপন করতে থাকেন মানিক মিয়া। আওয়ামী লীগের প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদক ও ভাষাসৈনিক অলি আহাদ ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫’ বইতে লিখেছেন, “জনাব তফাজ্জল হোসেন কলিকাতা হইতে ঢাকা আগমন করিবার পর জনাব খয়রাত হোসেনকে সঙ্গে লইয়া ইয়ার মোহাম্মদ খানের সহিত দেখা করেন এবং ইত্তেফাক পত্রিকার সমস্যাবলি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন। যেহেতু জনাব তফাজ্জল হোসেন পূর্বে কলিকাতার ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’-এর সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন, সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাও তাহার আছে; তদুপরি তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের গোঁড়া সমর্থক, সেহেতু আলোচনায় স্থির হয় যে, অতঃপর জনাব তফাজ্জল হোসেন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করিবেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান লিখিতভাবেই জনাব তফাজ্জল হোসেনকে উক্ত ক্ষমতা দান করেন, মওলানা ভাসানী ইহার প্রতিষ্ঠাতা ও জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রকাশক ও মুদ্রাকর রহিয়া গেলেন।”
এক রাতে মালিকানা বদল
মানিক মিয়ার আগ্রহ এবং বেকারত্ব উভয় দিক বিবেচনায় মওলানা ভাসানী তাকে ইত্তেফাক সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পারিশ্রমিক নির্ধারণ করেছিলেন মাসে ‘ষাট টাকা’। তবে মওলানা ভাসানী যদি ইত্তেফাকের জন্য কোনো টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হতেন, তার পুরোটাই মানিক মিয়ার হাতে তুলে দিতেন। কিন্তু ভাসানীর এই আস্থা ও বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেননি মানিক মিয়া। ফজলুল হকের সরাসরি হস্তক্ষেপে এক রাতের ব্যবধানে মওলানা ভাসানীর হাতছাড়া হয় তারই প্রতিষ্ঠিত ইত্তেফাক। অলি আহাদ লিখেছেন, ‘স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন উজিরে আলা (এপ্রিল-মে ১৯৫৪) শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের নির্দেশে ঢাকা জেলার তদানীন্তন প্রশাসক সিলেট নিবাসী ইয়াহিয়া চৌধুরী ১৯৫৪ সালের ১৪ মে গভীর রাতে অন্যায়ভাবে ইয়ার মোহাম্মদ খানের অজ্ঞাতসারেই সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেনকেই ইত্তেফাক-এর প্রিন্টার ও পাবলিশার করিবার ব্যবস্থা করেন।... সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থেই ভাসানী ও জনাব ইয়ার মোহাম্মদ খান ইত্তেফাক-এর উপর নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করেন নাই।’ সম্ভাব্য কারণ মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে মওলানার জ্বালাময়ী বক্তৃতা-বিবৃতি সোহরাওয়ার্দী গ্রুপের অস্বস্তির কারণ ছিল। যার ফলে মার্কিন সরকারের আনুকূল্য লাভের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। মওলানা কমিউনিস্টদের সামনে ঢাল হয়ে ছিলেন, ফলে সোহরাওয়ার্দীরা আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাসের মাথায় ইত্তেফাক মওলানার হাত থেকে কার্যত ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ভাসানীকে খানিকটা দুর্বল করে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজটি করা হয় বলে রাজনৈতিক ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন। অথচ যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়ের নেতৃত্বেই ছিলেন ভাসানী! ভাসানীর নামেই পাঠকপ্রিয়তা মওলানা ভাসানীর নামের ওপরই ইত্তেফাক পাঠকপ্রিয় হয়। সৈয়দ আবুল মকসুদ উল্লেখ করেছেন, “...ভাসানীর খবরের জন্য পত্রিকার পাঠক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত। তাঁর খবর কম থাকলে সেদিন কাগজ বিক্রি হতো কম। হকারদের রোজগার কম হতো। একদিন গুলিস্তান চত্বর ও সদরঘাট মোড়ে দাঁড়িয়ে হকাররা চিৎকার করতে থাকেন, ‘মওলানা ভাসানীর খবর নাই’। অল্প সময়ের মধ্যে সব কাগজ বিক্রি হয়ে গেল। আসল ব্যাপার হলো, সেদিন ভাসানীর কোনো বক্তৃতা-বিবৃতি ইত্তেফাকে ছিল না।”
ভাসানী কিছু করেননি কেন?
ইত্তেফাকের মালিকানার দাবিতে ভাসানী অনেক কিছুই করতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের অত্যাচার অবিচার ও বৈষম্যে জর্জরিত পূর্ব বাংলার মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে সেদিন এবং তার পরেও এই নিয়ে তিনি কোনো শক্তি প্রদর্শন করেননি। তা ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্যের দিকটিও তিনি মাথায় রেখেছিলেন। এ ঘটনার অনেক পরে আইয়ুব খান নিজের মসনদ রক্ষায় ভাসানীকে খুশি করার উদ্দেশ্যে ইত্তেফাকের মালিকানা ভাসানীকে পুনরায় হস্তান্তর করার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু মওলানা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তিনি আইয়ুবের সঙ্গে আপস করবেন না।
ভাসানীকে হেয় প্রতিপন্ন করা
মানিক মিয়ার হাতে ইত্তেফাকের মালিকানা আসার পর বিভিন্নভাবে ভাসানী ও কমিউনিস্টদের হেয় প্রতিপন্ন করে লেখা হতে থাকে। আর এর সীমা ছাড়িয়ে যায় ১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে ভাসানীর ন্যাপ গঠনের পর। মওলানা ভাসানীকে উদ্দেশ করে ইত্তেফাকে বিভিন্ন সময় ছাপা হতে থাকে ‘বিদ্যাবুদ্ধিহীন, মূর্খ, লুঙ্গিসর্বস্ব মৌলবি ও ভারতের দালাল’।
ভাসানীর বিবৃতি
ইত্তেফাকে ভাসানীর বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচারের জবাবে ১৯৬৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের সন্তোষ থেকে সংবাদপত্রে প্রেরিত এক লিখিত বিবৃতিতে ভাসানী বলেছিলেন, “আমি সাপ্তাহিক ও দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম কি না, তাহা সরকারী দপ্তরে এবং উভয় পাকিস্তানের হাজার হাজার ইত্তেফাক পাঠকের ঘরে পুরাতন কাগজ অনুসন্ধান করিলেই দেখিতে পাইবেন। সাপ্তাহিক ও দৈনিক ইত্তেফাকে বড় অক্ষরে লেখা থাকিত ‘প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানী’। এডিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট আলী রেজার মাধমে ঢাকা কোর্ট থেকে আমি সর্বপ্রথম সাপ্তাহিক, মাসিক ও দৈনিক ইত্তেফাকের ডিক্লারেশন প্রাপ্ত হই। পরে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের ডিক্লারেশন ইয়ার মোহাম্মদ খানের নামে পরিবর্তন করি। কী কারণে কী অবস্থায় আমার কাগজ আমার বিনানুমতিতে হস্তান্তরিত হইয়াছে, তাহাও আজ পর্যন্ত আমি কাহারও নিকট ব্যক্ত করি নাই। কিন্তু প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক আমি ছিলাম, তাহা পাক-ভারতের কোটি কোটি মানুষ অবগত আছেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী আওয়ামী সম্মেলনে যখন আমি পাক-মার্কিন যুদ্ধজোটের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইয়া বৈদেশিক নীতি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করার প্রস্তাব করি, তখনো আমার বিরুদ্ধে দেশময় প্রচার করা হয় যে, আমি হিন্দুস্তানের দালাল ও আমি হিন্দুস্তানের অর্থে রাজনীতি করি। বর্তমানেও একশ্রেণির লোক প্রচার করিতেছে যে, বিভিন্ন লোকের নিকট হইতে আমি লক্ষ লক্ষ টাকা পাইয়াছি। এই অপপ্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে আমি পাকিস্তান সরকার ও দেশবাসীর নিকট দাবী করিতেছি যে, আপনারা সারা পাকিস্তান তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করুন যে, আমার নিজস্ব বাড়ী ঘর, জমি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কোন ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স আছে কি না...।”
মওলানা ভাসানীর হাত থেকে ইত্তেফাক ছিনিয়ে নেওয়ার ৭০ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু আজও ইত্তেফাকের প্রসঙ্গ এলে আসে মওলানা ভাসানীর নাম, আসে এক রাতে মালিকানা বদলের ইতিহাস। যে ইতিহাস কখনো মুছে ফেলা যায় না