কূটনৈতিক সমাধানের ধারণাকেও ভেঙে দিচ্ছে ইসরায়েল

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৫, ১৫:৪৫

ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলের হামলার পর ধোঁয়ার কুণ্ডলী।
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে আবার জমেছে কালো মেঘ আর এবারের কেন্দ্রে রয়েছে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধের প্রকাশ্য বিস্ফোরণ। কয়েক দশকের দ্বন্দ্ব এখন খোলাখুলি সংঘাতে রূপ নিয়েছে এবং ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আগ্রাসন নতুন এক বিপজ্জনক পর্বের সূচনা করছে। ১৩ জুন রাতের প্রথম প্রহরে ইসরায়েল এক নজিরবিহীন সামরিক অভিযান চালায়, দুই শতাধিক যুদ্ধবিমান একযোগে শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায় ইরানের ভূখণ্ডজুড়ে। তেহরান ও পবিত্র শহর কোম থেকে শুরু করে কারমানশাহ ও হামাদান বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চলা এই হামলায় আঘাত হানে কৌশলগত স্থাপনায়। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, তাদের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কেন্দ্র, সরবরাহ ঘাঁটি এবং ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) কমান্ড সেন্টার।
তবে হামলায় শুধু সামরিক কর্মকর্তারাই নন, টার্গেট করা হয় পারমাণবিক বিজ্ঞানীদেরও। নিহত হন অন্তত ছয়জন বিজ্ঞানী। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতির পরিপন্থি হলেও ইসরায়েল অতীতে যেমন করেছে, এবারও তা উপেক্ষা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতোই এই হামলায় পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির দিক দিয়ে এটি
১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
হামলার পরপরই ইরানে সামরিক নেতৃত্বে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি রিয়ার অ্যাডমিরাল হাবিবুল্লাহ সাইয়ারিকে নতুন স্টাফ প্রধান হিসেবে এবং জেনারেল আহমাদ বাহিদিকে আইআরজিসির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। ইরানি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, এই হামলায় আটটি প্রদেশের অন্তত ৬০টি স্থানে ক্ষতি হয়েছে। তেহরান, ইসফাহান, হামাদান, খুজেস্তানসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উদ্ধার তৎপরতা চলছে।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে খামেনি এ হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ বলে অভিহিত করেন এবং হুঁশিয়ার করেন, ইসরায়েলকে ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। অর্থাৎ পাল্টা জবাব আসবেই, তা সরাসরি বা অন্যভাবে।
এরই মধ্যে এই হামলার কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হয়েছে। ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিশনের সদস্য আলাউদ্দিন বোরুজেরদি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নির্ধারিত ষষ্ঠ দফার পরমাণু আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। তার ভাষায়, ‘এই আগ্রাসনের পর পূর্ববর্তী কাঠামোয় আর আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।’ ইসরায়েল হামলার মাত্রা ও তাৎপর্য গোপন রাখেনি, বরং এটিকে ইতিহাসের একটি মোড় বদলকারী ঘটনা হিসেবে তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, এটাই এক নতুন যুগের সূচনা, আলো ও অন্ধকারের যুদ্ধ।’ এই ধর্মীয় রূপক শুধু অভ্যন্তরীণ আবেগ জাগানিয়া নয়; বরং বিশ্বে একটি বার্তা-ইসরায়েল আর কারো মুখাপেক্ষী নয়, সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। ইসরায়েলের চিফ অব স্টাফ হেরজি হালেভি জানান, ‘এটা কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, বরং বহুস্তরীয়, সুপরিকল্পিত একটি অভিযান।’ শুধু পারমাণবিক সক্ষমতা প্রতিরোধ নয়; বরং তা অর্জনের পথ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়াই ছিল এই হামলার লক্ষ্য।
এখন প্রশ্ন, এই হামলা কি একটি বৃহৎ যুদ্ধের শুরু, নাকি এটি মধ্যপ্রাচ্যের পুরোনো চক্রে-হামলা, পাল্টা জবাব, সাময়িক বিরতি-ফেরত যাবে? নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও এ কথা স্পষ্ট যে অঞ্চলটি প্রবেশ করেছে আরো বিপজ্জনক এক পর্বে। এটি কোনো হঠাৎ উত্তেজনার ফল নয়, বরং মাসব্যাপী জমে ওঠা উত্তেজনা, হুমকি ও কূটনৈতিক ব্যর্থতার যৌথ ফল। জুনের শুরু থেকেই বিশ্লেষকরা ইসরায়েলের প্রস্তুতি, গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থার প্রতি ইরানের অসহযোগিতার কারণে সম্ভাব্য হামলার ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন।
একই সময়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়াচ্ছিল-গাজায় সাফল্যের অভাব, বিচারব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে গণবিক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা-সব মিলিয়ে একটি কৌশলগত মোড় নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ইরানে হামলা ছিল একদিকে বহির্নীতির অংশ, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ সংকট থেকে নজর ঘোরানোর কৌশল। তবে এর কৌশলের ঝুঁকিও রয়েছে। ইরানের জবাব সরাসরি নাও আসতে পারে; কিন্তু তার আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক-হিজবুল্লাহ, ইরাকি শিয়া মিলিশিয়া, হুতি বিদ্রোহীরা বিভিন্ন ফ্রন্টে ইসরায়েলকে ব্যস্ত রেখে প্রতিশোধ নিতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও আগামী পরিস্থিতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বাড়লে ইউরোপসহ বহু দেশে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন কমে আসতে পারে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে পারে, যদিও তারা ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র, তবু আত্মরক্ষার যুক্তিতে এই আগ্রাসন বৈধ প্রমাণ করা সহজ হবে না।
এই হামলা হয়তো একটি কৌশলগত বার্তা হিসেবে শুরু হয়েছিল; কিন্তু তা এখন রূপ নিয়েছে এক অনিশ্চিত ও অস্থির বাস্তবতায়। মধ্যপ্রাচ্য এখন দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারায়, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ ডেকে আনতে পারে স্থায়ী বিপর্যয়।
এখন আর শুধু ইরান বা ইসরায়েলের পরবর্তী পদক্ষেপ নয়, মূল প্রশ্ন হলো বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর কেউ কি এগিয়ে আসবে এই আগুন নেভাতে? কারণ যদি আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তার আঁচ তাদের গায়েও লাগবে। তখন কেউ বলতে পারবে না, আমরা জানতাম না এমনটা হতে চলেছে।