গণ-অভ্যুত্থান : জনতার স্রোত যখন ইতিহাস বদলায়

শাহেরীন আরাফাত
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০:৪০

জুলাই গণঅভ্যুত্থান। ফাইল ছবি
জুলাই ফিরে এসেছে। তবে এবারের জুলাই শুধুই একটি মাস নয়- সেই সময়, যখন বাংলাদেশের ইতিহাস নতুন বাঁক নেয়। গত বছর এ সময়ে শেখ হাসিনার দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে যে অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান দেখা গেল, তা যেন অতীতের সব রাজনৈতিক সমীকরণ ভেঙে দিল। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন শক্তির সক্রিয় মদদ, ছাত্রলীগ ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর হিংস্র দমননীতিও প্রতিরোধের ঢেউ থামাতে পারেনি। প্রতিদিনই ক্ষুব্ধ, বঞ্চিত মানুষের ঢল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সেই মিছিলে।
‘উন্নয়ন’-এর মুখোশে একনায়কতন্ত্র
আওয়ামী শাসনামলে রাষ্ট্র পরিচালনার ধরন হয়ে উঠেছিল ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক বন্দনা’র এক প্রবল অনুশীলন। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার মুখে বিদেশ সফরের সাফল্যের গল্প শোনার পর মন্ত্রী আমলা-সাংবাদিকরা পালাক্রমে উচ্চারণ করতেন ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’, ‘বঙ্গরত্ন’, ‘বিশ্বনেতা’, এমনকি ‘হবু নোবেল বিজয়ী’। তার শাড়ি, স্মার্টনেস ও সাজগোজ নিয়েও আলোচনা হতো! এসব বন্দনার পেছনে চাপা পড়ে যেত মানুষের দুর্দশা, বিরোধী মত দমন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের চিত্র। একপর্যায়ে শেখ পরিবারের নামে ক্যান্টনমেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তার নামকরণ, পাঠ্যপুস্তকে ছবি এবং ‘মুজিব কর্নার’-এর বন্যা। দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এক ধরনের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম নেতৃত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে বড় করার নামে ইতিহাসের অন্য নায়কদের মুছে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাজউদ্দীন আহমদ, মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, সিরাজুল আলম খান, সিরাজ সিকদার প্রমুখ হয়ে ওঠেন ব্রাত্য। জিয়াউর রহমানকে বলা হয় পাকিস্তানের এজেন্ট। এই একপক্ষীয় বয়ান তরুণদের মনে জন্ম দেয় বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক চেতনা।
বৈষম্যের গর্ত
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে প্রকাশিত এক শ্বেতপত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশের পাঁচটি বার্ষিক বাজেটের সমান। গড়ে উঠেছে ‘বেগমপাড়া’, সেকেন্ড হোম, বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন। বিপরীতে সাধারণ মানুষের জীবন নাভিশ্বাসে ভরা- দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, সেবা খাতের অব্যবস্থা এবং চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিশাপ। বাকস্বাধীনতাও ছিল অকল্পনীয়- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন, লেখক মোশতাকের মৃত্যু, কার্টুনিস্ট কিশোরের ওপর নির্যাতন, সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের গুম, সেই সঙ্গে হামলা-মামলা-খুন সব মিলিয়ে রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল এক ভয়াবহ দমনযন্ত্র।
ভাগ করো, শাসন করো
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকার পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার রূপরেখা আঁকে। ২০১৩ সালে তথাকথিত ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ দিয়ে শুরু হয় ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মীয় রাজনীতির কৃত্রিম দ্বন্দ্ব। এ বিভাজন আসলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতিরই আরেকটি রূপ। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে নিষ্ক্রিয় ও চরমভাবে দলীয়করণ করা হয়। ২০১১ সালে সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসনের জোরে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে আওয়ামী লীগ। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এই তিনটি নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকারকে পরিণত করা হয় এক প্রহসনে। বিরোধী দলের অনুপস্থিতি, পোষ্য বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, আগের রাতে সিল মারা, ভোটারদের ভোট না দেওয়ার সুযোগ-সব মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক ‘গৃহপালিত গণতন্ত্র’। জনতার অধিকার হয়ে ওঠে কেবলই কাগুজে শব্দ।
প্রশ্নবিদ্ধ গঠন
অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে জাতি হিসেবে উল্লেখ করে অখণ্ড ভারতের বক্তব্য হাজির করে হিন্দুত্ববাদের প্রধান প্রথম দিকে আন্দোলন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সীমিত ছিল। এরপর শাহবাগে এলো। জুলাইয়ের ৫ তারিখ থেকে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও তা ছড়িয়ে পড়ল। আন্দোলনের ভাষাও রাজনৈতিক হতে থাকল। দাবিদাওয়া থেকে হত্যার বিচার; এরপর একদফা ও অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। ক্ষোভ ও যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট সুবিধাবঞ্চিত নানা পেশা ও শ্রেণির মানুষ বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের মিছিলে যোগ দিল। বিএনপি, বাম ও ইসলামী দলের কর্মীরাও মিছিলে একাকার হলো। অংশ নিয়েছিল লেখক-শিল্পী সাংবাদিক- বুদ্ধিজীবীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। তবে ছাত্র-জনতাই অভ্যুত্থানের মূল শক্তি। এটিকে বলা যায়, স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ। জনগণের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছিল ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা, সেবা খাতের অব্যবস্থা ও পীড়ন এবং পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ স্বেচ্ছাসেবক লীগের নির্যাতন প্রচারক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) ও হিন্দু মহাসভা। পরবর্তী সময়ে দ্বিখণ্ডে বিভাজিত দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রসার ঘটে মুসলিম লীগের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ সত্ত্বেও পূর্ব বাংলা কখনো দ্বিজাতি তত্ত্বে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান বিলোপ করেনি। এখানকার সামাজিক কাঠামো, ভাষা সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক বোধ সব সময়ই একটি পৃথক রাষ্ট্রীয় চেতনার জন্ম দিয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-সবই এই জনচেতনার বহিঃপ্রকাশ। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১০ এপ্রিল ১৯৭১ প্রণীত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। ইংরেজিতে এটিকে বলা হয় ‘প্রোক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’-এই তিন মূলমন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়। কার্যত এই ঘোষণাপত্রই ছিল বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, যার ভিত্তিতে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে ওঠে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াই, একটি দলনির্ভর অভিজাত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। কোনো গণপরিষদ বা সংবিধান সভা ছাড়াই পাকিস্তানি কাঠামোর উত্তরাধিকারী প্রতিনিধিদের দ্বারা ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয়, তা জনগণের সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’-এর জায়গা নেয় ভারতীয় সংবিধান থেকে ধার করা বিভ্রান্ত ধারাবিবরণী। এই সংবিধান ১৮টি মৌলিক অধিকারের কথা বললেও সেগুলোর বাস্তবায়নে রাষ্ট্র বাধ্য নয়। ফলে কাগজে-কলমে থাকা অধিকার লঙ্ঘনে নাগরিকদের প্রতিকার চাওয়ার সুযোগও থাকে না। ‘জনস্বার্থে’ চুক্তি গোপন রাখা বা সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়ার সুযোগও রেখে দেয় এই সংবিধান। অন্যদিকে সংসদের এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেই সংবিধানে যেকোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব, ফলে ক্ষমতাসীন দল একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। অথচ সংবিধান বা রাষ্ট্রের মূল কাঠামো সংসদের অধীন নয়, এটি কেবল জনগণের গঠনতান্ত্রিক অধিকার। গণভোট বা রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনগণই হতে পারে সর্বশেষ সিদ্ধান্তদাতা। কিন্তু এই গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার অর্থ হলো সংসদই হবে সার্বভৌম, আর বাস্তবে সংসদ হয়ে উঠবে এক ব্যক্তির অধীন প্রতিষ্ঠান। ফলে সার্বভৌমত্ব কেন্দ্রীভূত হয় কেবল একজনের হাতে। এই অসার ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো রাষ্ট্রব্যবস্থা ধীরে ধীরে আরো পচন ধরে। বারবার শাসকের মুখ বদলালেওÑসামরিক শাসন, স্বৈরতন্ত্র, নির্বাচিত সরকার, জনগণের অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র গড়ে ওঠেনি। ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান সামরিক স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিল বটে, কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামো ছিল পুরোনো জায়গাতেই স্থবির।
গণ-অভ্যুত্থান এক বিস্ময়কর ঐক্য
বাংলাদেশে সব সরকারের আমলেই আমলাতন্ত্রকে দলীয়করণের নিদর্শন দেখা গেছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতন্ত্রায়ণ না হওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে। তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। সে সময় সরকারি চাকরির অর্ধেকেরও বেশি ছিল কোটাব্যবস্থার অধীন, যার বেশির ভাগই ছিল মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের জন্য এক অযৌক্তিক কোটা। এই কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলন হয়। তখন আন্দোলন দমাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটাব্যবস্থাই বাতিল করে। ২০২৪ সালের জুন মাসে উচ্চ আদালতে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবার আগের মতো কোটাব্যবস্থা ফেরত আনা হয়। এর বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের মতো ২০২৪ সালেও আন্দোলন হয়, রাজপথ রঞ্জিত হয় রক্তে। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মর্মকথা ছিল অযৌক্তিক কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়ার অধিকার। সেই আন্দোলন আর সেখানে থাকেনি। ধীরে ধীরে তা চরম পর্যায়ে গেছে। প্রথম দিকে আন্দোলন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সীমিত ছিল। এরপর শাহবাগে এলো। জুলাইয়ের ৫ তারিখ থেকে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও তা ছড়িয়ে পড়ল। আন্দোলনের ভাষাও রাজনৈতিক হতে থাকল। দাবিদাওয়া থেকে হত্যার বিচার; এরপর একদফা ও অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয়। ক্ষোভ ও যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট সুবিধাবঞ্চিত নানা পেশা ও শ্রেণির মানুষ বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের মিছিলে যোগ দিল। বিএনপি, বাম ও ইসলামী দলের কর্মীরাও মিছিলে একাকার হলো। অংশ নিয়েছিল লেখক-শিল্পী সাংবাদিক- বুদ্ধিজীবীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ। তবে ছাত্র-জনতাই অভ্যুত্থানের মূল শক্তি। এটিকে বলা যায়, স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ। জনগণের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছিল ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা, সেবা খাতের অব্যবস্থা ও পীড়ন এবং পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের নির্যাতন। দিনে দিনে জমে ওঠা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে গণবিস্ফোরণ, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান। জুলাই-আগস্টে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, ছাত্রলীগ এবং ভাড়াটে বাহিনী মিলে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে। গুম, হামলা, মামলা, ধরপাকড় সব কিছুর মধ্যেও আন্দোলন থেমে যায়নি। ভারত সরকার হাসিনা সরকারকে পুরোপুরি সমর্থন দিলেও শেষ পর্যন্ত তা ফ্যাসিবাদকে রক্ষা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়।
রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন ও সম্ভাবনা
এই গণ-অভ্যুত্থান নবজাগরণ এনেছে। জাতীয় ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি করেছে। বাঙালি, আদিবাসী, প্যান্ট-শার্ট পরা বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ পড়ুয়া এবং টুপি-লম্বা কোর্তা পরা মাদ্রাসায় পড়া ছাত্রদের এক মিছিলে দাঁড় করিয়েছে। আন্দোলনের মিছিলে নারীর উপস্থিতি ছিল ব্যাপক, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। আমাদের সমাজে মানুষে-মানুষে, ধর্মে-বর্ণে যে দূরত্ব ছিল, তা ঘুচিয়ে দিয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। গত বছর ৩ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের প্রধান নেতা নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন, ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এক দফা দাবির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। দফাটি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এই সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপ।’ তিনি আরো বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আমরা খুব দ্রুতই ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানের জন্য সর্বস্তরের নাগরিক, ছাত্রসংগঠন ও সব পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত মোর্চা ঘোষণা করব। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা হাজির করব। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে চাই, যেখানে আর কখনো কোনো ধরনের স্বৈরতন্ত্র-ফ্যাসিবাদ ফিরে আসতে না পারে।’ তার মানে নতুন রাষ্ট্রকাঠামো গঠনের পথই তিনি বাতলে দিচ্ছিলেন। তবে ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে নানাভাবে বিদ্যমান কাঠামো টিকিয়ে রাখার লড়াই শুরু হয়। নতুন কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব না হলেও গণ অভ্যুত্থান দেখিয়েছে, রাজপথে আমরা কীভাবে নিপীড়িতের পক্ষে রক্ত ঝরাতে পারি; দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ফ্যাসিবাদকেও ধরাশায়ী করতে পারি। এটাই জনতার শক্তি, গণশক্তি।
গণ-অভ্যুত্থানে ঐক্যের শক্তি দেখা গেলেও এই শক্তি যখন রাজপথ থেকে সরে গেছে, তখন হয়েছে বিভাজিত এবং সেই সঙ্গে গোষ্ঠীগত স্বার্থ সামনে এসেছে। ফলে গাঠনিক শক্তির প্রয়োগ দেখা যায়নি। আর এ কারণে চূড়ান্ত লক্ষ্য কাঠামোতে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী উপাদানের বিলোপ সম্ভব হয়নি। আগামী দিনে সেই উপাদানের পথ ধরে আবারও স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে; তাই আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিবাদী শক্তি, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবারের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। যারা পুরোনো ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায়, তারা কিন্তু খুব ভালো সুযোগ নিয়ে নিয়েছে।
উপদেষ্টারা পুরোনো ব্যবস্থার অধীনে শপথ নিলেন পুরোনো ব্যবস্থার প্রেসিডেন্টের কাছে। তাদের শপথ এই সংবিধান রক্ষা করা। এর অর্থ, বর্তমান ফ্যাসিবাদী কাঠামোকেই তাদের বজায় রাখতে হবে। বিদ্যমান আইনের মধ্যে এই সরকারকে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। এই সরকার কীভাবে নিজেদের বৈধ প্রমাণ করবেন, তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। সর্বোচ্চ আদালতের যে মতামত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটিও খুব জোরালো বৈধতা প্রদান করে না; কারণ এই রায়ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বদলে যেতে পারে। তারা যতটুকু করবেন, জোর করে করবেন, যতটুকু তাদের হাতে ক্ষমতা আছে, ততটুকু তারা করবেন। কিন্তু বিদ্যমান সংবিধান ও আইন অনুযায়ী তা কখনো বৈধ হবে না।
আমাদের যে নতুন রাষ্ট্র গঠন করার আকাক্ষা, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যার প্রকাশ ঘটেছে, এটার ধারেকাছে আমরা যেতে পারিনি এখনো। পুরোনো সংবিধান রেখে দেওয়া হলে আজ থেকে ২০ বছর পরও যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তাহলে গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সবার বিচার হবে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। আর বিদ্যমান আইন ও রাষ্ট্রকাঠামোয় তা খুবই সম্ভব। আর এ রাষ্ট্র কাঠামোতে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী বীজ বিনষ্ট করা সম্ভব না হলে স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ যেমন মাথাচাড়া দিতে থাকবে, তেমনি আগামী দিনে আবারও বিপ্লবীরা রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণের দাবিতে।
গণ-অভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে শেষ কথা বলে জনগণ। ভোট দেওয়া মানে এই নয় যে, জনগণ নিজের সার্বভৌমত্ব অন্য কারো হাতে তুলে দিচ্ছে। তবে এই শক্তিকে যদি একটি কাঠামোগত বা গাঠনিক শক্তিতে রূপ না দেওয়া যায়, তবে তা আবারও দমন ও বিভ্রান্তির শিকার হতে পারে। এখন প্রয়োজন এক বৈপ্লবিক স্বপ্ন-একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের, যেখানে ক্ষমতার উৎস হবে জনগণ; আর প্রতিষ্ঠিত হবে গণসার্বভৌমত্ব। বাংলাদেশের কাঠামো আজ দাঁড়িয়ে আছে একদলীয় কর্তৃত্ববাদ এবং জনগণবিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্তের অদ্ভুত মিশ্রণে। ‘গণসার্বভৌমত্ব’ ধারণার বাস্তবায়ন এ দেশে কখনোই ঘটেনি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ কেবল নির্বাচন নয়, প্রয়োজন নতুন করে রাষ্ট্র গঠনের সাহসী প্রশ্ন তোলা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে একটি নতুন গঠনতন্ত্র রচনার উদ্যম। এ পথেই নিহিত ভবিষ্যতের সম্ভাবনা।